গাজীপুর এবং ঢাকার সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছিল উৎপাদন। অস্থিরতার মুখে সাভারে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল দুই শতাধিক কারখানায়। তবে গত দুই দিনে এসব কারখানার অধিকাংশেরই কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। কাজে যোগ দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন কারখানাগুলোর শ্রমিকরা। এদিকে গাজীপুরে বেশির ভাগ তৈরি পোশাক কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে।
সাভারে অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে এখনো ২০টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে শিল্প-পুলিশ। শিগগিরই সংকট নিরসনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের সব কারখানা সচল হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্যরা।
রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সর্বশেষ বন্ধ থাকা ৪৯টি কারখানার মধ্যে ২৯টিতে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন শিল্প-পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম।
শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্যরা আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের চলমান সংকট নিরসনে গতকাল বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন করে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন।
জানা গেছে, গত শুক্রবার আশুলিয়ায় স্থানীয় নেতা ও কারখানার মালিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে বিজিএমইএ সব পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর এই অঞ্চলে সব মিলিয়ে ৪৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। তবে গতকাল বন্ধ কারখানার সংখ্যা নেমে আসে ২০টিতে।
শিল্প-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালে ৪-৫টি কারখানার শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে মালিকপক্ষের সঙ্গে নানা দাবির বিষয়ে আলোচনা করতে কাজ বন্ধ করে রাখলেও পরে কাজ শুরু করেন।
শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে জেনারেশন নেক্সট, সান সোয়েটার, মাসকট ফ্যাশন ও পার্ল গার্মেন্টস। তবে আগের মতোই উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল ডিইপিজেডসহ শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানায়।
আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ী এলাকার ন্যাচারাল ডেনিমস কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সবুজ হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের কারখানায় প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করেন। গত বৃহস্পতিবার কিছুটা স্বাভাবিকের পর গত দুই দিন কারখানা পুরো দমে চলছে। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন আমরা হইনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আমাদের সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন। আজ (গতকাল) সব কটিতেই শ্রমিকরা কাজে ফিরেছেন। শুধু মেহনাজ নামের একটি কারখানা বন্ধ রয়েছে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিরতার জন্য গার্মেন্ট মালিক জড়িত আছেন কি না তা তদন্ত করে দেখা উচিত। সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই এবং ডিইপিজেড নিয়ে এই শিল্প জোনে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কারখানা আছে। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি কারখানায় শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন, যা পার্সেন্ট করলে হয় মাত্র এক-দুই পার্সেন্ট। তাহলে আমার কথা হলো, মাত্র এক-দুই পার্সেন্ট কারখানায় এই আন্দোলন কেন? বারবার বিজিএমইতে আলোচনা হলেও এই কারখানাগুলোতে সমাধান হচ্ছে না কেন?’
তিনি আরও বলেন, আশুলিয়াতে গত ১৫ আগস্টের পর ডিইপিজেডের গেটে চাকরিপ্রত্যাশী ও বহিরাগতরা প্রথমে আন্দোলন করেন এবং তা কিছুদিন পর নিয়ন্ত্রণে আসে। গত ২৫ আগস্ট ডিইপিজেডের বাইরে ডংলিয়ন নামের একটি কারখানায় আন্দোলন হয় এবং ২৬ আগস্ট শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার কারণে শ্রমিকরা কাজে ফিরে যান। এই আন্দোলনের পর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কারখানায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, যা এখন নিয়ন্ত্রণে আছে।
শিল্প-পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, গতকাল এই অঞ্চলে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১৩ (১) ধারায় ১৮টি কারখানা বন্ধ এবং দুটি কারখানায় সাধারণ ছুটি রয়েছে। এর বাইরে শিল্পাঞ্চলের সব কারখানায় স্বাভাবিক রয়েছে উৎপাদন কার্যক্রম। এ ছাড়া শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যৌথ বাহিনীর টহল কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অনন্ত গার্মেন্টস পরিদর্শন শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক সবুর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শিল্পাঞ্চলের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনের লক্ষ্যে আমরা আশুলিয়ায় এসেছি। আমরা চাই তাদের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি জেনে সরকারের কাছে তুলে ধরতে। যদি সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ করার সুযোগ থাকে তবে সেটিও আমরা সুপারিশ করব। যদি সময় লাগে তবে সেটিও সরকারকে জানাব। আমাদের প্রত্যাশা, কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা কাজ করবেন। আমরা আশাবাদী ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
এদিকে গাজীপুর মহানগরীরসহ পুরো জেলায় তৈরি পোশাক কারখানা নারী-পুরুষ শ্রমিকরা স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু করেছেন। গত শনিবার সকাল থেকে শ্রমিকদের বৃষ্টিতে ভিজে কারখানাগুলোতে যেতে দেখা গেছে। প্রতিটি কারখানার নিরাপত্তায় মোতায়েন ছিল শিল্প-পুলিশ। সেনাবাহিনী ও বিজিবির টহল ছিল।
গাজীপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সূত্রমতে, শিল্প অঞ্চলে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক রয়েছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর শিল্প-পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার বলেন, ‘টিএনজেট অ্যাপারেলস লিমিটেড শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের ব্যাপারে গত শুক্রবার রাতে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। তখন বেতন পরিশোধের অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ তা করেনি। এর মধ্যেই কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করার কারণে সকালে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করেন। শ্রমিকরা একপর্যায়ে পাশের কারখানার শ্রমিক জড়ো করতে পাশের অন্য কারখানায় ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। পরে দ্রুত কারখানাটিতে ছুটি ঘোষণা করে মালিকপক্ষ। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কিছু কারখানায় শ্রমিক আন্দোলন ও নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ ছিল। তবে শনিবার সকাল থেকেই গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের প্রায় শতভাগ তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা খুলেছে।’