গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের অসন্তোষ কোনো উপায়েই কমানো যাচ্ছে না। সরকারের উপদেষ্টা মহলের সঙ্গে বৈঠকের পর ব্যবসায়ী নেতাদের সংগঠনগুলো নানা উদ্যোগ নিলেও শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়ায় বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে তাদের বিক্ষোভ-আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে স্থিতিশীল পরিস্থিতির মাঝেই মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) তিনটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে এক নারী শ্রমিক মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০ জন। তবে শিল্পাঞ্চলের ডিইপিজেডসহ অন্যান্য পোশাক কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও বেশকিছু কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে শিল্প পুলিশ।
এ ছাড়া গাজীপুরে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে দুটি ওষুধ কারখানার শ্রমিকদের পাশাপাশি পোশাকশ্রমিক এবং চট্টগ্রামের সিইপিজেড এলাকার সি টেক্স নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। চট্টগ্রাম ব্যুরো, গাজীপুর ও সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধির পাঠানো খবর:
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ম্যাসকট গার্মেন্টস লিমিটেড, রেডিয়্যান্স ও সাউদার্ন গার্মেন্টসের শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে রোকেয়া বেগম (৩৫) নামে ম্যাসকট গার্মেন্টসের এক সেলাই মেশিন অপারেটর মারা যান বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, চলমান শ্রমিক অসন্তোষের জেরে গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৩ (১) ধারায় (কোনো প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকরা বে-আইনি ধর্মঘট ডাকলে মালিক চাইলে ওই প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারেন। এক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশ নেওয়া শ্রমিকরা ওই সময়ের জন্য কোনো মজুরি পাবেন না) বন্ধ ছিল জিরাবো এলাকার ম্যাসকট গার্মেন্টস লিমিটেড। সকালে শ্রমিকরা কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে এর সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে ম্যাসকট গার্মেন্টসের শ্রমিকদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী রেডিয়্যান্স ও সাউদার্ন নামে দুটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মাঝে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ থেকে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় ত্রিমুখী সংঘর্ষে শ্রমিকদের ছোড়া ইটের আঘাতে রোকেয়া বেগমসহ অন্তত ২০ শ্রমিক আহত হন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় রোকেয়াকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ বিষয়ে আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, ‘সকাল পৌনে ১০টার দিকে ম্যাসকট ও রেডিয়েন্স কারখানার দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নারী শ্রমিক নিহত হয়েছেন। লাশ জিরাবোর পিএমকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে। তবে কোথাও কোনো সড়ক অবরোধ নেই।’
অন্যদিকে বিজিএমইএ ও শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আশুলিয়ায় ডিইপিজেডসহ অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক রেখেছেন। তবে শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৩ (১) ধারায় এখনো ১৫টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। আরও চারটি কারখানায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েও অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে কাজ না করে চলে যান।
গাজীপুরে আন্দোলনে শ্রমিকরা
গাজীপুরে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী, কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা, চক্রবর্তী, গাজীপুর সদরের শিরিরচালা এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। এতে মহাসড়কের বেক্সিমকো থেকে জিরানি পর্যন্ত যানজট তৈরি হয়। গতকাল সকাল থেকে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। আন্দোলন নিরসনে দাবি দাওয়ার বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে কাজ করছে পুলিশ।
গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় মাহমুদ জিন্স লিমিটেড ও নায়াগ্রা টেক্সটাইল লিমিটেডের শ্রমিকরা সকালে আন্দোলনে নামেন। এ ছাড়া জয়দেবপুর থানার শিরিরচালা এলাকার এক্সিকিউটিভ হাই ফ্যাশন লিমিটেড এবং গাজীপুর সদরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় বেতন বৃদ্ধির দাবিতে তাসমিয়া হারবাল লিমিটেডে কর্মবিরতি পালন করেন শ্রমিকরা। এ ছাড়া জেলার টঙ্গী খাঁ পাড়ায় সিজন ড্রেস, ভেরিটাস ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেড এবং চক্রবর্তী এলাকায় বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিকরা আন্দোলন করেছেন। এ সময় শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
চট্টগ্রামে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ
চট্টগ্রামের সিইপিজেড এলাকার সি টেক্স লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা তাদের দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। গতকাল সকাল থেকে কাজে যোগ না দিয়ে চট্টগ্রামের এশিয়ান গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সি টেক্স লিমিটেডের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। এ কারখানার তিনজন কর্মকর্তার পদত্যাগ, বেতনবৈষম্য দূর করা এবং চাকরি স্থায়ী করাসহ ১৫ দাবির জন্য শ্রমিকরা এ আন্দোলন করেন বলে জানা যায়। শ্রমিকরা এ সময় সিইপিজেড এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখলে প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকায় যানজট সৃষ্টি হয়।
এদিকে বেলা ১১টায় শ্রমিকদের দাবি নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (বেপজা) ডেপুটি ম্যানেজার আব্দুস সোবহান। বৈঠকে সেনাবাহিনী, শ্রমিক নেতা, শিল্প পুলিশের প্রতিনিধিও ছিলেন। এ বিষয়ে বেপজার ডেপুটি ম্যানেজার আব্দুস সোবহান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সি টেক্স লিমিটেডের শ্রমিকরা কাজ না করে আন্দোলন করছেন। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বৈঠকে বসেছি। শ্রমিকদের ছোট সব দাবি কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছেন। কিন্তু শ্রমিকরা তিনজন কর্মকর্তার পদত্যাগ চেয়েছেন। সেখানে দুজনের পদত্যাগের জন্য আমরা সুপারিশ করেছি। সবাইকে তো আর পদত্যাগ করানো সম্ভব না। তবে এ কারখানার সমস্যার সমাধান হয়েছে।’