
দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি এবং পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান সরকারি-বেসরকারি সাত ব্যাংক থেকে মোট ৪১ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা ঋণ করেছেন। নানা ফন্দি করে নতুন নতুন আইডিয়া দিয়ে ঋণ নেওয়া ছিল তার নেশা। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিপুল অঙ্কের মুনাফা করা সত্ত্বেও তার ঋণ পরিশোধের ইতিহাস অনিয়মিত। ফলে তার প্রতিটি ঋণই মেয়াদোত্তীর্ণ ও খেলাপি হয়ে পড়েছে।
দেশের প্রথমদিকের শিল্প গ্রুপ বেক্সিমকোর মালিক হওয়ার সুবাদে তিনি বিগত সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরে রাজনৈতিকভাবে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন। আর এ প্রভাব কাজে লাগিয়ে তার মালিকানাধীন নানা প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া ছিল তার নেশা। এ কাজে তিনি সরকারের মন্ত্রী, ব্যাংক চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের সহায়তা নিতেন। বেক্সিমকো গ্রুপের ১৭টি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও সেগুলোসহ নামে-বেনামে নানা কোম্পানির জন্য তিনি ঋণ করেছেন। তার এই অস্বাভাবিক ঋণ এবং ঋণ পরিশোধ না করার বিষয়গুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার দাপটের সামনে কোনো প্রতিবাদ বা ঋণ অনুমোদন না করার সাহস পেত না। সর্বদা সাদা দাড়ি-গোঁফ ও সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়সহ মন্ত্রী-আমলা ও সরকার ঘনিষ্ঠ রাজনীতিক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সব সময় ওঠাবসা করায় তিনি লোকমুখে ‘দরবেশ’ নামে পরিচিত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণের মনে প্রশ্ন জাগে এতগুলো ভালো কোম্পানির মালিক হওয়া সত্ত্বেও এত টাকা ঋণ নিয়ে কী করতেন ‘দরবেশ সাহেব’!
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে দেশে থাকা তার ঘনিষ্ঠজনরাও আত্মগোপনে চলে যান। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের মূল ভিত্তি ছাত্র-জনতার রোষানল থেকে রেহাই পেতে চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে সালমান এফ রহমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একসঙ্গে ধরা পড়েন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এ সময় দেখা যায় ‘দরবেশ সাহেব’ দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন। এরপর থেকে অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তার নেতৃত্বাধীন আইএফআইসি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা এতদিন প্রবেশ করতে পারেনি তাদের কেউ কেউ অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘দরবেশ সাহেবে’র ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকে বারবার যোগাযোগ করেও তার ঋণের প্রকৃত পরিমাণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অনানুষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী ‘দরবেশ সাহেবে’র ঋণ রয়েছে দেশের সরকারি বেসরকারি সাতটি ব্যাংকে। এগুলো হলো রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী এবং বেসরকারি ন্যাশনাল, আইএফআইসি ও এবি (আরব-বাংলাদেশ) ব্যাংক। এর বাইরে বেসরকারি প্রাইম, শাহজালাল ইসলামী ও সাউথইস্ট ব্যাংকে তার ঋণ থাকলেও তার পরিমাণ জানা যায়নি।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, তার ঋণের পরিমাণ জনতা ব্যাংকে ২৩ হাজার কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকে ১ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকে ১ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকে ৯৬৫ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকে ২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকে ১১ হাজার কোটি টাকা এবং এবি ব্যাংকে ৬০৫ কোটি টাকা। ‘দরবেশ সাহেব’ তার প্রতিষ্ঠিত ভালো কোম্পানিসহ নামে-বেনামে নানা প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে এসব ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, সম্মান-সমীহ ব্যাপারটা ‘দরবেশ সাহেব’ খুব পছন্দ করতেন। তার সঙ্গে কেউ নিজেকে অধীন ও বিশ্বস্ততা দেখাতে পারলে তাকেই তিনি একটি ব্যবসার আইডিয়া দিতেন। আর বলে দিতেন, টাকা নেই, চিন্তা করো না। আমি অমুক ব্যাংকে বলে দিচ্ছি। আবেদন কর। ঋণ হয়ে যাবে। এসব ‘সাময়িক ধারণা’র প্রতিষ্ঠানে তাকে অংশীদার করা হলে তিনি সানন্দে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতেন। এভাবেই তার নিজের ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকের তহবিল নেওয়া হতো বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে কর্মকর্তাদের একজন খবরের কাগজকে জানান, শুধু জনতা ব্যাংকেই বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। বেক্সিমকোকে ঋণ দিয়ে রাষ্ট্রের একটি ভালো ব্যাংক বর্তমানে তারল্যসংকটে ভুগছে। একক গ্রাহক ঋণসীমা মানা হয়নি বেক্সিমকোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে।
২০১০ সালে সালমান রাতারাতি আইএফআইসি ব্যাংক দখলে নেন। এরপর নানা প্রতিষ্ঠানের নামে যে ঋণ নেন তার পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকে বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও বেক্সিমকো কমিউনিকেশন লিমিটেডের ঋণ দাঁড়িয়েছে মোট ১ হাজার ৪০৯ কোটি। ন্যাশনাল ব্যাংকে বেক্সিমকোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ৮৩৬ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকটিতে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ ৮২৩ কোটি টাকা এবং বেক্সিমকো এলপিজির ঋণ ১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা রয়েছে। বেসরকারি এবি ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ রয়েছে ৬০০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে নথিভুক্ত করার জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলেও অধিকাংশ ব্যাংক তা করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ব্যাপারে মৌন ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন মুখপাত্রকে এই ব্যাপারে বিস্তারিত চেয়ে টেক্স্ট পাঠানো ও ফোনে যোগাযোগ করা হলেও গত এক সপ্তাহে তারা কোনো সাড়া দেননি।