ঘড়ির কাঁটায় তখন সোমবার বেলা সাড়ে ১১টা। রাজধানীর শাহবাগ থানার সামনে রিকশা আটকে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী। কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে রিকশা চলাচলের নিয়ম নেই; তাই চালক ও যাত্রীদের করজোড়ে অনুরোধ করছিলেন সেখানেই যাত্রা সমাপ্ত করতে। কিন্তু নিয়মভঙ্গের যে ধারা চলে এসেছে এতদিন, সেটি কী আর সহজে থামে!
তরুণদের অনুরোধ উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলেন বেশ কয়েকজন চালক। এদের মধ্যে আবার ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশাও রয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে এগিয়ে এলেন আরও কয়েক তরুণ। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে থামানো হলো বেশ কয়েকজন চালককে। সেখানে বাদানুবাদ চলল যাত্রী-চালক আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বরত শিক্ষার্থীদের কিছু দূরে পুলিশ বক্সে বিশ্রাম নিতে দেখা গেল।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির উদ্যোগে শুরু হওয়া পনের দিনের ট্রাফিক পক্ষের গতকাল ছিল শেষ দিন। ট্রাফিক পক্ষ চলাকালে ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায় পথে নেমেছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ঢাকার সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রতিদিন ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা তারা সড়কে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন। গত ৬ আগস্ট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে তৎপরতার ধারাবাহিকতা রাখতে চান শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, পড়াশোনার পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রমে এই কাজ করতে অনীহা নেই তাদের।
সোমবার সকাল ৮টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড়ে নিয়োজিত তরুণদের একজন ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস-ইউআইটিএসের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষার্থী আফরিন আনোয়ার। তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার বন্ধুরা এতদিন রামপুরা ব্রিজ এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছি।
আজ আমরা শাহবাগ মোড়ে এসেছি। আজ যাদের ক্লাস নেই, কেবল তারাই ডিউটি করেছি। যেদিন আমাদের ক্লাস থাকবে, সেদিন আমার অন্য বন্ধুরা এসে যুক্ত হবেন।’ ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিশাম মো. নাকিব জানান, তিনি ৬ আগস্ট থেকে সড়ক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। শুধু যানবাহন নিয়ন্ত্রণ নয়; সড়কে রোড ডিভাইডারগুলো মেরামত করা, স্পিড ব্রেকারগুলো রাঙিয়ে দেওয়া, সড়কের পাশ থেকে অবৈধ দোকানপাট সরিয়ে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও করেছেন তারা। এসব কাজ করতে গিয়ে রামপুরা এলাকায় তরুণরা একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে সখ্য বাড়িয়ে নিয়েছেন। এতে একই এলাকার তরুণদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতার ক্ষেত্র বেড়েছে বলে জানান নাকিব। ৩০ বন্ধুর দল তারা, ট্রাফিকপক্ষ চলাকালে দলে ভাগ হয়ে রাজধানীর নানা মোড়ে কাজ করেছেন তারা।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেবেন রামপুরার বাসিন্দা ফাতেমা জান্নাত ঋতু। তিনি জানান, রাজধানীর যুব উন্নয়ন কেন্দ্র ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ট্রাফিক নিরাপত্তা নিয়ে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রামপুরার এই তরুণরা। সেখানে ট্রাফিক পুলিশের বেশকিছু নিয়মকানুন ও নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশদ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন বলে জানান তিনি। সড়ক বাতির ব্যবহার, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারের নিয়মকানুন নতুন করে শিখেছেন।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেহেদী হুসাইন বলেন, কোন সিগন্যালে কখন ছেড়ে দিতে হয় জানতে চাইলে দেখি ঢাকার ট্রাফিক সিস্টেম চলে অ্যান্টি ক্লকওয়াইজ। এটি একেবারেই নতুন লেগেছে আমার কাছে। ঢাকার রোডে ট্রাফিক কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেই সিস্টেমটা শিখেছি। এখন সড়কে যেখানেই আমাদের নিয়োজিত করা হোক, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণটা ভালোভাবেই করতে পারব।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজটি করতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন ঋতু। তিনি বলেন, ‘যখন আমরা মূল সড়কে রিকশা আটকে দিয়েছি, তখন যাত্রীরা হইচই করেছেন। আমাদের পরিচয় জানতে চেয়েছেন, বলেছেন- ‘তোমরা কোথা থেকে এসেছ, পড়াশোনা বাদ দিয়া রাস্তায় কী কর।’ আমরা তাদের সঙ্গে যতই ভদ্রোচিত আচরণ করার চেষ্টা করেছি, তারা ততই উত্তেজিত হয়েছেন। অটোরিকশা চালকরা বলেছেন- ‘মামা রিকশা চালাতে না দিলে আমরা খামু কী।’ এমন তিক্ততার পাশাপাশি বেশ কয়েকজন সিনিয়র নাগরিক আমাদের কাজের প্রশংসা করেছেন, সহযোগিতা করেছেন। তাদের আগ্রহেই আমরা উৎসাহ পেয়েছি।
শিক্ষার্থীরা সড়কে যতই তৎপরতা দেখান; সাধারণ পথচারী ও যাত্রীদের মধ্যে যদি ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা না থাকে তাহলে সব উদ্যোগ বৃথা যাবে বলে মনে করেন এই তরুণরা
শাহবাগে দায়িত্বরত ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মেহেদী হাসান শাকিল জানান, ট্রাফিক পক্ষ চলাকালে শিক্ষার্থীরা মাঝেমধ্যে এসেছেন। কখনো এক বেলা, কখনো দুই বেলা চার ঘণ্টা করে সড়কে শৃঙ্খলার কাজ করেছেন তারা। এ সময়ে ভিআইপি সড়কে রিকশা চলাচল করতে না দেওয়া, মোড়ের একশ গজের মধ্যে বাস থামতে না দেওয়া, পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার নিশ্চিত করা, যত্রতত্র পার্কিং না করার বিষয়ে তরুণরা আমাদের সহযোগিতা করেছেন।
গত ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবসের আয়োজনে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. মো. আবদুল মোমেন জানিয়েছিলেন, সড়ক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তরুণদের মধ্যে ৩০০ জন তরুণকে প্রশিক্ষণ দেবে সরকার। তারা দ্রুত কাজ শুরু করবে ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে। এ সংখ্যা ক্রমে বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। দায়িত্ব পালন করা শিক্ষার্থীদের মাসোহারা দেওয়ার কথাও বলেছিলেন তিনি।
এ বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান খবরের কাগজে বলেন, ‘ট্রাফিক পক্ষের আগে আমরা ৬৫ জন তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাদের মধ্য থেকে ৩০ জনকে নিয়েছি এবার। সামনের পর্বে আরও কিছু তরুণ যুক্ত হবে। এভাবে ৩০০ জনই সড়কে শৃঙ্খলার কাজে যুক্ত হবেন। আমাদের টার্গেট ৬০০ শিক্ষার্থীকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা।’ এখন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তরুণদের নিয়োজিত করলেও তাদের মাসোহারা দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাশ্রমের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে দেশে যে বিপুল সংখ্যক তরুণ বেকার রয়েছেন, তাদের কিছু দিন প্রশিক্ষণ দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে নিয়োজিত করা যেতে পারে। প্রথমে অস্থায়ী ভিত্তিতে তাদের যাচাই করা হবে, পরে যারা ভালো কাজ করবে তাদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।’
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসিএর হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার সড়কে এখন সাড়ে ৩ হাজারের মতো বাস চলাচল করে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান গবেষণা করে জানিয়েছেন, ঢাকার সড়কের মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ জায়গা পায় গণপরিবহন। এর বাইরে অধিকাংশ জায়গাজুড়ে চলছে ব্যক্তিগত যানবাহন; চলছে রিকশা-অটোরিকশা। এর সমাধান করতে হলে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থায় জোর দেওয়ার কথা বলেন হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসের মতো বাস সার্ভিস চালু করতে হবে দ্রুত। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত পরিবহন চালু করতে হবে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। এগিয়ে আসতে হবে বিআরটিসিকে। বেসরকারি খাতকে দায়িত্ব দিলে ভালো কিছু আশা করা যাবে না। সরকারকে একটি কোম্পানি গঠন করে দিতে হবে এই বিশেষায়িত পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য। আমরা যখন আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব, তখন নগরে ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা কমে আসবে।