সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের আস্থা ভোটের পক্ষে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশির ভাগ দলই ঐকমত্য পোষণ করেছে। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চায় বেশির ভাগ দল। তবে দলগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কার অধীনে হবে তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন চায় না বিএনপি। ঠিক বিপরীত অবস্থানে নিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই স্থানীয় নির্বাচন চায় জামায়াত ও এনসিপি।
মঙ্গলবার (৩ জুন) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় এ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। দুপুরে পৌনে ১২টার দিকে আলোচনা শুরু হয়ে শেষ হয় ৬টার দিকে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল ও দুটি জোট অংশ নেয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, নিম্নকক্ষে নারী আসন নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধি নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও সময় স্বল্পতার কারণে আর হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে এবং উপমহাদেশের চর্চা বিবেচনা করে তার দলের পক্ষ থেকে উপযুক্ত মত হচ্ছে, ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আস্থা ভোট না থাকলে সরকার পরিচালনায় স্থায়িত্ব থাকবে না। প্রতিনিয়ত সরকার পরিবর্তিত হতে থাকবে, যা শোভনীয় হবে না। আস্থা ভোট, অর্থবিল এবং সংবিধান সংশোধন এই তিনটি ছাড়া সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রদান করবেন, এতে বিএনপি একমত। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে এই আস্থা ভোটের বিষয়টি ৭০ অনুচ্ছেদে যুক্ত করতে বিএনপি প্রস্তাব করেছে। যদি কোনো সময় যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তাহলে যাতে পার্লামেন্ট মেম্বাররা তার জন্য ভোট দিতে পারেন, সেটা ৭০ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল, আস্থা ভোট ও সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার পক্ষে আমরা মতামত দিয়েছি।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘অর্থ বিলের পাশাপাশি আস্থা ভোট থাকতে হবে। কারণ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা যেমন দরকার, তেমনি সরকারের স্থিতিশীলতা দরকার।’
আস্থা ভোট রেখে দিলে প্রধানমন্ত্রী আনচ্যালেঞ্জড থেকে যাবেন, উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘এ প্রসঙ্গে কোনো উপায় বের করতে হবে। এক দিনে শেষ না করে আরেকটি আলোচনায় বসে কোথায় ঐকমত্য হলেও তা চূড়ান্ত করতে হবে।’
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে মতামত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, আমাদের প্রস্তাব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে।
অপরদিকে, এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হোক সবাই চায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হলে ভালো হবে। কারিগরি দিক নিয়ে আমাদের আরও আলোচনা করতে হবে।’
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্ধারণ
বৈঠক সূত্র জানায়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে ৫০ শতাংশ বিরোধী দল থেকে করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে বিএনপিসহ সব দলই একমত পোষণ করে। তবে বিএনপি চারটি কমিটির সভাপতি পদে বিশেষ করে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি, প্রিভিলেজ ও এস্টিমেট কমিটির ছাড়া বাকিগুলোর ব্যাপারে একমত বিএনপি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কয়েকটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিরোধীদলীয় সদস্যদের দেওয়ার ব্যাপারে তখনই প্রায় সব দল একমত হয়েছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে আরও কয়েকটি এ জাতীয় সংসদীয় কমিটি দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে সংসদে জবাবদিহি এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়।’
তিনি বলেন, ‘কয়টি সংখ্যা ও কী কী মন্ত্রণালয় সেটি এখনই নির্ধারণ হবে না। সেটি জাতীয় সংসদে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এবং সাইজ অব দ্য অপজিশন পার্টি, সেটিও ম্যাটার করে। সেই সংখ্যা তখন নির্ধারণ করা যাবে। কারণ, বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা কম হলে এখনই পার্সেন্টেজ নির্ধারণ করা হলে সেটি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির বিষয়ে আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছি মৌলিক চারটি কমিটি- পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি, প্রিভিলেজ ও এস্টিমেট কমিটিতে বিরোধী দলের নির্বাচিত এমপিদের পক্ষ থেকে প্রদান করা হবে। আর বাকি যে কমিটিগুলো সেখানে সংখ্যানুপাতিক হারে বিরোধী দল থেকে করা হবে।’
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম জানান, ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় প্রস্তাবিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর সভাপতি পদ বিরোধী দল থেকে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি। কারণ সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সরকার দলের সদস্য সংখ্যাই বেশি থাকে।
নারীদের আসন ১০০ করার ব্যাপারে একমত সব দল, পদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত
বৈঠক সূত্র জানায়, সংসদের আসন ৩৫০ থেকে ৪০০ আসনে করার ব্যাপারে সবাই একমত পোষণ করেছে। সে ক্ষেত্রে নারীদের আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ আসন করার ব্যাপারে সব দলই নীতিগতভাবে একমত পোষণ করছে। তবে নারীরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, ভোট না বর্তমান পদ্ধতি থাকবে, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে দলগুলোর মধ্যে। কোনো কোনো দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নারী আসন চায়, আবার কোনো কোনো দল চলমান পদ্ধতি চায়। এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংরক্ষিত আসন বাড়ানো হলেও এটিতে আপাতত মনোনয়নের পক্ষে বিএনপি। আমরা মনে করি, নারীর সংরক্ষিত আসনে এখনই নির্বাচনের সময় হয়নি। তবে এর নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে, এ বিষয়ে কোনো ঐক্য এখনো হয়নি। আরও আলোচনা হবে। দেশের নারী সমাজকে আরও বেশি এগিয়ে নেওয়ার জন্য বর্তমান বিধান রাখা উচিত।’
নারী আসন প্রসঙ্গে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসলিম জারা বলেন, ‘আমরা চাই জাতীয় সংসদের ন্যূনতম ২৫ শতাংশ নারী জনপ্রতিনিধি সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হোক। ৩০০ আসন বাড়িয়ে ৪০০ করা হলে ১০০ আসনে নারীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং সেখান থেকেই তৃণমূল নেতৃত্ব উঠে আসবে। তিনি বলেন, নারীরা নিজস্ব আসন থেকে নির্বাচিত হলে তারা নির্বাচনী মাঠ, প্রচারণা, জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি এবং কাজের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ পান।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন চায় বিএনপি, বিপক্ষে এনসিপি
চার মাস নয়, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন রাখা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শুধু জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মতামত দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের বেশি হওয়া উচিত নয়। যদিও কমিশন প্রস্তাব করেছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস হওয়া উচিত।’
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাসের প্রস্তাবে এনসিপি একমত বলে জানিয়ে সরোয়ার তুষার বলেন, ‘কয়েকটি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছয় মাস রাখার পক্ষে। বিষয়টি নিয়ে এখনো আলোচনা হয়নি। মেয়াদ তিন মাস বা চার মাসের বিষয়ে আমরা নমনীয় থাকব। স্থানীয় সরকার নির্বাচন অন্তর্ভুক্ত হলে চার মাস প্রয়োজন হতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও অংশ নিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাসদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন, গণফোরাম, সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জাকের পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, আমজনতার দল, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোট।