আওয়ামী লীগের শাসনামলের বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গুমের ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। শনিবার বিকেলে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের (দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স) সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাবকে বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে।
শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে কমিশন সদস্যরা এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগের মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনপ্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, তারা তিন মাস পর মার্চে আরও একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেবেন। কাজটি শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন বলেও এ সময় জানান গুম কমিশনের প্রধান।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় কমিশনের প্রধান ছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সমাজ কল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।
ওই প্রতিবেদন অনুসারে, গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। এ ছাড়া শেখ হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং সাবেক এসবিপ্রধান মো. মনিরুল ইসলাম ও ডিএমপির সাবেক ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গুমের এসব ঘটনায় বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র্যাব বিলুপ্তিরও সুপারিশ করেছে গুম কমিশন।
প্রধান উপদেষ্টা গুম কমিশনের সদস্যদের তাদের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি এ সময় গুম কমিশনকে কাজটি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
এ বিষয়ে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনপ্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী আরও জানান, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছেন, যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন ফোর্স নিজেদের মধ্যে ভিকটিম বিনিময় করেছে এবং পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্নভাবে বাস্তবায়ন করেছে। তিনি জানান, গুমের শিকার অনেকে এখনো শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। তাদের ওপর এতটাই ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল যে তারা এখনো ট্রমায় ভুগছেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার সর্বশেষ বক্তব্যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সঠিক বিচারের আশ্বাস দেওয়ার পর এ ধরনের ঘটনার রিপোর্টের সংখ্যা অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে কমিশনের সদস্যরা অধ্যাপক ইউনূসকে আয়নাঘর পরিদর্শনের অনুরোধ জানান। তারা বলেন, ‘আপনি আয়নাঘর পরিদর্শন করলে ভিকটিমরা অভয় পেতে পারেন।’ প্রধান উপদেষ্টা তাদের এ অনুরোধে সম্মতি দিয়ে জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল, যা আয়নাঘর নামে পরিচিতি পেয়েছে সেগুলো দেখতে যাবেন।
গুম কমিশন গঠন প্রক্রিয়া
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই গুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবি ওঠে। এরই মধ্যে গোপন বন্দিশালা বা তথাকথিত আয়নাঘর থেকে অনেকেই দীর্ঘদিন পর মুক্ত হন। এতে করে গুমের তদন্ত ও বিচারের দাবি আরও তুঙ্গে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর সরকার এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এই কমিশনের কাছে ২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে গুমের শিকার ভুক্তভোগী নিজে অথবা পরিবারের কোনো সদস্য বা আত্মীয়স্বজন কিংবা গুমের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ জানানোর আহ্বান জানানো হয়। এরপর অপর এক প্রজ্ঞাপনে এই কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়।
কমিশনের আওতাধীন কর্মপরিধি
প্রজ্ঞাপনে বেসামরিক বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাকেও কমিশনের তদন্তের আওতায় রাখা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা (এসবি), গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলপ্রয়োগকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্তে কমিশনটি গঠন করা হয়েছে।’
যে উদ্দেশ্যে গুম তদন্ত কমিশন
২০১০-এর ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত করা এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিল সেটা নির্ধারণ করাই এই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য বলে জানা যায়। জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলোর বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা এবং এ ব্যাপারে সুপারিশ প্রদান, গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে আত্মীয়স্বজনকে অবহিত করা ও গুমের ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত তদন্তের তথ্য সংগ্রহ করা।
অভিযোগ ওঠা কর্মকর্তাদের বক্তব্য নিয়েছে কমিশন
গুমের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তার কাছ থেকে বক্তব্য গ্রহণ করেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না বলা হলেও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ডিজিএফআইয়ের সদস্য ছিলেন। প্রাথমিকভাবে গুমের সঙ্গে ডিজিএফআই, র্যাব, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি ও পুলিশের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলেও জানান গুম কমিশনের তদন্তসংশ্লিরা।