জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কোনো অর্থ আত্মসাৎ হয়নি বলে তদন্ত শেষে রবিবার (১০ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান। এই মামলায় হাইকোর্টের ১০ বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার করা পৃথক লিভ টু আপিলের ওপর শুনানির শেষ দিনে আদালতকে তিনি এ তথ্য জানান।
এদিকে শুনানি শেষ হওয়ায় সোমবার (১১ নভেম্বর) এ বিষয়ে রায় (আদেশ) ঘোষণা করতে পারেন সর্বোচ্চ আদালত।
রবিবার আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য এই দিন ধার্য করেন।
দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান আদালতে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র ও সাক্ষ্যের অংশ তুলে ধরেন। তিনি মামলার নথি থেকে খালেদা জিয়া এ মামলার অভিযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন- এমন উপাদান পেশ করেন। মামলার চার্জশিট পড়ে আদালতকে তিনি বলেন, ‘তদন্তে আমরা জিয়া অরফানেজের এক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেক অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরের তথ্য পেয়েছি, তবে এখানে অর্থ আত্মসাতের কোনো প্রমাণ পাইনি। মামলার এফআইআরে অর্থ আত্মসাতের তথ্য মেলেনি। বরং সুদে-আসলে সব অর্থ ব্যাংকেই জমা আছে। কোনো টাকা ব্যয় হয়নি।’
এর ফলে এই মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া তার খালাসের বিরুদ্ধে আজ আপিলের অনুমতি পেতে পারেন। ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ আপিল বিভাগে দুটি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছিলেন খালেদা জিয়া। পরে গত ৪ নভেম্বর তার ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলের ওপর শুনানির জন্য গতকাল আপিল বিভাগে শুনানি নেন চেম্বার জজ বিচারপতি মো. রেজাউল হক। আদালতে খালেদার পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও রুহুল কুদ্দুস কাজল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি আদালতের অনুমতি নিয়ে এ মামলায় বিচারিক আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেওয়া জবানবন্দি উপস্থাপন করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে। কারণ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের জবানবন্দি ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। খালেদা জিয়ার এ জবানবন্দি তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব বহন করে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে খালেদা জিয়া তার বিরুদ্ধে বিচারের প্রেক্ষাপট, হয়রানির বিষয় এবং বিচার বিভাগের ওপর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণের নানা দিক তুলে ধরেন। আদালত থেকে বের হয়ে আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা আইনগতভাবে এই মামলার মোকাবিলা করব। খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই এ রায় দেওয়া হয়।’
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। এই মামলায় খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাশাপাশি ছয় আসামির প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। বাকি চার আসামি হলেন সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক এমপি ও ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও জিয়াউর রহমানের ভাগনে মমিনুর রহমান। এর মধ্যে পলাতক আছেন তারেক রহমান, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান। পরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া আপিল করেন।
একই বছরের ২৮ মার্চ খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে দুদকের করা আবেদনে রুল দেন হাইকোর্ট। পরে সাজা বৃদ্ধিতে দুদকের আবেদনে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার সাজা ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন। আর সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে করা লিভ টু আপিলের (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) শুনানি শেষ হয় রবিবার।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। একই সঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। গত ৪ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার অংশ হিসেবে নিজের খরচে পেপারবুক (মামলা বৃত্তান্ত) তৈরির আবেদন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি।
তবে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমার পরও মামলা দুটি আইনগতভাবে লড়ার কথা জানিয়ে বিএনপির আইনজীবী বলেন, খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করেছেন। সেখানে ক্ষমার কথা আছে। খালেদা জিয়া ক্ষমার প্রতি বিশ্বাসী নন। তিনি অপরাধ করেননি। তিনি ক্ষমাও চাননি। মামলাটি আইনগতভাবে মোকাবিলা করতে তিনি আইনজীবীদের বলেছেন।