দেশের বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলো ভারতীয় আগ্রাসন ও পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সৃষ্ট জাতীয় সংকট মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে একমত পোষণ করেছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় তারা সরকারের পাশে থাকবে।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ৪০টির বেশি রাজনৈতিক দল এ বৈঠকে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ১৪ দলসহ গত নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এই বৈঠক বিকেল সোয়া ৪টায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে শেষ হয়।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বসবেন। সংলাপে অংশ নিতে বিকেল পৌনে ৪টার দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রবেশ করে।
অন্যরা হলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম অংশ নেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম, তারা এটাকে মুছে দিয়ে আগেরটায় ফিরে যেতে চায়। মুখে বলছে না যে আগেরটা, কিন্তু ভঙ্গি হলো আগেরটা ভালো ছিল। তাদের শক্তি এত বেশি যে তারা মানুষকে এর ভেতরে ভেড়াতে পারছে। তাদের কল্পকাহিনির কারণে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছে যে এটা কী ধরনের সরকার হলো।’
বহির্বিশ্বের মিডিয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার তাদের বলছি যে আপনারা আসেন এখানে, দেখেন, এখানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু না, তারা ওখান থেকেই কল্পকাহিনি বানিয়ে যাচ্ছেন। এখন আমাদের সারা দুনিয়াকে বলতে হবে যে আমরা এক, আমরা যেটা পেয়েছি সেটা একজোট হয়ে পেয়েছি, কোনো মতবাদের কারণে পাইনি, ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি, যারা আমাদের ওপর চেপে ছিল, তাদের উপড়ে ফেলেছি। এটাই সবার সামনে তুলে ধরতে হবে, সবাই মিলে যেন এটা করতে পারি। আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রাপথে এটা মস্তবড় একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
জানা গেছে, বৈঠকে মূলত আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের পতাকা অবমাননা এবং দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের আন্তর্জাতিকভাবে যে গল্প শোনানো হচ্ছে, এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চাওয়া হয়। বৈঠকে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন নেতারা। এগুলো হলো বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূতাবাসে আগের সরকারের নিয়োগপ্রাপ্তদের সরিয়ে বিপ্লবের পক্ষের শক্তিকে নিয়োগ দেওয়া, আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছর ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি করেছে তা প্রকাশ করা এবং স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল করাসহ ক্ষতিপূরণ আদায়, জাতীয় ঐক্যের প্রতীকী সংহতি দিবস হিসেবে একদিন পালন করা এবং এই দিন যার যার অবস্থান থেকে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসা, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন, আন্তর্জাতিক মহলের প্রোপাগান্ডা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাবলিক রিলেশন সেল গঠন করা এবং তা বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে প্রকাশ করার পক্ষে মত দেন।
সংলাপে এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু যেকোনো একদিন জাতীয় ঐক্যের প্রতীকী সংহতি হিসেবে সর্বস্তরের নাগরিকদের সারা দেশে একযোগে একই সময়ে যার যার অবস্থানে জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী কর্মসূচির প্রস্তাব দেন। তার এই প্রস্তাবকে অধিকাংশ দলের নেতারা সমর্থন জানান। এ ছাড়া সংলাপে বিএনপির বক্তব্যের প্রশংসা করেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে কয়েকটি দলের উত্থাপিত দাবি এ আলোচনার বিষয়ে তিনি ইতিবাচকভাবে নেননি।
সূত্র জানায়, বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডার কঠোর জবাব দিতে আহ্বান জানান। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় দূতাবাস এবং দেশের যেসব প্রতিষ্ঠান ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের সহযোগী যারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন তাদের সরিয়ে দিতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কারণ এদের রেখে বিপ্লব সফল হবে না। গণ অধিকার পরিষদ জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিলে অন্য দলগুলো তাতে সম্মত হয়নি। বেশ কয়েকটি দল মাঝে মাঝে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টাকে বৈঠক করার পরামর্শ দেয়। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের সমঝোতা দলিল প্রণয়ন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার লক্ষ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ভলান্টিয়ার গঠন। সরকারের পক্ষে থেকে বলা হয়, দেশের জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশ ঐক্যবদ্ধ আছে। কেউ যদি আমাদের ক্ষতি করে তাহলে সেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে সরকারের জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে সার্বিক সংস্কারের পর রোডম্যাপ ঘোষণা করে দ্রুত নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমরা ঐকমত্য প্রকাশ করেছি, যেভাবে সবাই মিলে জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করেছি, সেভাবেই ছাত্র-জনতা মিলে ফ্যাসিস্টদের ষড়যন্ত্রও মোকাবিলা করব।’
বিএনপি জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য ও নির্বাচনি রোডম্যাপ চায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পতিত সরকার আজকে বিদেশে গিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। বিদেশের যেসব দেশ পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগিতা করছে- বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি।’
তিনি বলেন, ‘এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা দেশের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। এখন প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে আর কেউ ষড়যন্ত্রের সাহস পাবে না।’
খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। এই সরকার জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে ওয়াদাবদ্ধ। তাই আমরা অতি দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ দিতে বলেছি। যাতে জনগণ রোডম্যাপ পেলে নির্বাচনমুখী হয়।’
বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ভারতের সঙ্গে গত ১৫ বছরে যত চুক্তি হয়েছে তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি রামপালসহ যত ক্ষতিকারক চুক্তি হয়েছে তা বাতিলেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে শক্তিহীন, দুর্বল ও নতজানু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় আমরা সবাই একজোট। যেকোনো ধরনের অপপ্রচার ও উসকানির বিরুদ্ধে আমরা দৃঢ়, একতাবদ্ধ ও সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকব।’
ভারতীয় অপপ্রচার মোকাবিলায় গোটা জাতির ঐক্যবদ্ধ থাকার পাশাপাশি একটি সমাবেশ করার বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই এক জায়গায় ঐকমত্য হয়েছি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়, এ ক্ষেত্রে আমরা সিমেন্টের মতো ঐক্যবদ্ধ। যেমন অতীতে ছিলাম, ৫ আগস্টে ছিলাম, ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। চরমপন্থা যেদিক থেকেই আসুক, বরদাশত করা হবে না।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমরা প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কই রাখতে চাই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ভূমিকা উসকানিমূলক ও সহিংস বলেই মনে হচ্ছে। তারা মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশকে কলুষিত করার জন্য, এ দেশের জনগণ ও সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য অপপ্রয়াস ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমরা আশা করি, ঐক্যবদ্ধভাবে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে চূড়ান্ত সফলতার দিকে এগিয়ে যাবে দেশ। চূড়ান্ত সফলতা না আসা পর্যন্ত আমাদের ঐক্য অটুট থাকবে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘ভারত যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাহলে ভারতকেও বিপদে পড়তে হবে। তাদের আগুন নিয়ে না খেলার আহ্বান জানাই। ভারত ও বাংলাদেশ ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে সবাই একমত হয়েছেন।’
গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘সারা দেশে জাতীয় ঐক্য প্রকাশে সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে সমাবেশ করার আহ্বান করা হয়েছে। একটি জাতীয় কাউন্সিল করার আহ্বান আমরা জানিয়েছি।’
এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বর্তমান সভাপতি শাহ আলম, বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মামুনুল হক, এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ১২-দলীয় জোটের প্রধান নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার, মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম, সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হক হুদা, জাগপা সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, খেলাফত মজলিসের আবদুল বাসিত আজাদ ও জাহাঙ্গীর হোসেন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, জাতীয়তাবদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হাকিম লালা, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বাংলাদেশ জাসদ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য প্রমুখ বৈঠক অংশ নেন।
তবে বৈঠকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং তাদের জোট শরিক ও সহযোগী কোনো দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে রাজনীতিবিদদের নামের তালিকায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নাম না থাকায় তিনি ফিরে গেছেন।