
ব্যবহারের পরে নষ্ট করে ফেলা যায় এমন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন মাত্র ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ নারী চা শ্রমিক। ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ নারী ঋতুস্রাবকালীন সময়ে এখনও পুনরায় ব্যবহারযোগ্য কাপড় ব্যবহার করেন। ৭৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ নারী শ্রমিক ঋতুস্রাবের প্রথম অনুভূতি বুঝতে পারেন না। ৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ নারী শ্রমিক ঋতুস্রাবকালীন সময়ে করণীয় কী তা জানেন না। ৯২ শতাংশ নারীকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলাতে হয় চা বাগানের কোনো ঝোঁপের আড়াল বা উন্মুক্ত স্থানে।
গিভ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (জিবিএফ) এর অধীনে ‘আনচার্টেড রেড ওয়াটারস’ প্রকল্পের অধীনে সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।
শনিবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর ফার্মগেটে ডেইলি স্টার ভবনে ‘বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মাসিক সমতা: নীতি ও কর্মসূচির আলোকে’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকে এই তথ্য উপস্থাপন করা হয়। প্রকল্পের গবেষক ফারিয়া রহমান ও বর্ষা আহমেদ এ তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, গত ২৩ নভেম্বর রাজবাড়ির দৌলতদিয়ায় যৌনকর্মীদের নিয়ে, ২১ নভেম্বর মিরপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিশোরীদের ওপর, ১৭ নভেম্বর শ্রীমঙ্গলের চা শ্রমিকদের ওপর এবং ১৫ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় বেদে সম্প্রদায়ের নারীদের ওপর সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে।
রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে গিভ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘মাসিক সমতা ও যৌন-প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার’ সংক্রান্ত গোল টেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: খবরের কাগজ
সমীক্ষায় উঠে এসেছে যৌন পল্লীর ৫৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ নারী স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। সেখানে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার তথ্য পাচ্ছেন। ২৪ শতাংশ নারী বলছেন ঋতুস্রাবকালীন সময়েও তাদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়। বেদেপল্লীতে স্বাস্থ্যসম্মত সেনিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন ৪৮ শতাংশ নারী। এই সমাজে প্রথম ঋতুস্রাবের পরে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে সচেতন নন শতকরা ৭৫ ভাগ নারী। এই সমাজের ৫৮ ভাগ নারী ঋতুস্রাবকালীন জটিলতার জন্য চিকিৎসকের কাছে যান না।
গিভ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের অ্যালামনাই উপমা রশিদের সঞ্চালনায় এই আলোচনায় অংশ নেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মঈনুল হাসান, আইসিডিডিআরবির হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ বিভাগের কর্মকর্তা মাহবুব উল আলম, ইউনাইটেড নেশন্স পপুলেশন ফান্ড-ইউএনএফপিএ এর ঢাকা অঞ্চলের কর্মকর্তা ডা. মেহবুবা নূর প্রথা, সাজিদা ফাউন্ডেশনের সালমা আহমেদ, ব্রাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ আব্দুল জব্বার, ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলের গ্লোরিয়া চন্দ্রাণী বাড়ৈ, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের তেহসিনা খানম, শেয়ার-নেট বাংলাদেশের কান্ট্রি কো অর্ডিনেটর ড. ফারহানা হক, মানবমুক্তি সংস্থার আতাউর রহমান মঞ্জু, হাউজ অব ভলেন্টিয়ারসের সাদিয়া তাসনিম, বি-স্ক্যানের সালমা মাহবুব (বি-স্ক্যান)।
আলোচনা সভার শুরুতে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্বের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ঝর্ণা আক্তার, যৌনকর্মী আশা আক্তার (ছদ্মনাম), শ্রীমঙ্গলের কালিঘাট চা বাগানের শ্রমিক সীমা রাণী তাঁতী তুলে ধরেন ।
গবেষক মাহবুব উল আলম বলেন, ‘হাইজিন ম্যানেজমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সেনিটারি ন্যাপকিন। সেটাকে আসলে ফ্যান্সি পণ্য হিসেবে দেখিয়ে ইমপোর্ট ট্যাক্স হিউজ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় প্রক্রিয়া (এমএসআর) নিয়ে সবাই কথা বলা শুরু করল। তখন এটা কিছু কমানো হয়। আমরা চাই, সেনিটারি ন্যাপকিন কোনো ফ্যান্সি প্রোডাক্টের আওতায় থাকবে না। জীবন রক্ষাকারী এ পণ্যে ভ্যাট-ট্যাক্স কিছুই যদি না থাকে তাহলে দামটাও বেশ কমে আসবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা আমাদের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এখানে ভূমিকা রয়েছে।’
ঋতুস্রাবকালীন কর্মজীবী নারীদের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার সেটি এখনো গড়ে ওঠেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেনিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের পরে সেটি কি গৃহস্থালি বর্জ্য নাকি হাসপাতাল বর্জ্যের সঙ্গে ভাগাড়ে যাবে সেই ব্যবস্থাপনাও করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পুরুষের অন্তর্ভুক্তির বিষয় নিয়ে সামাজিক মহলে সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন মাহবুব উল আলম। তাছাড়া প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আলাদা ব্যবস্থাপনা প্রণয়ণেও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
ডা. মঈনুল হাসান সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে বিনামূল্যে সেনিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করা যায় কি না এমন একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করতে বলেন নাগরিক সমাজকে। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ওষুধ, ইনজেকশন, ভ্যাকসিন ফ্রি দিচ্ছি। আমি মনে করি, এর মধ্যে সেনিটারি ন্যাপকিনটাও ইনক্লুড করা যায় কি না। সর্বমহল থেকে এমন প্রস্তাবনা এলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মুভ করতে পারি। মেডিকেল সার্জিকেল রিঅ্যাজেন্ট প্রকিউরমেন্ট প্রসিডিউরে (এমএসআর) সেনিটারি ন্যাপকিন ইনক্লুড করতে পারি।
মাহফুজ/এমএ/