ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলের মতো দেশের স্বাধীনতার পর ক্ষমতার পালাবদলে উন্নতি হলেও সমাজের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতীতেও সমাজে যেমন মানুষের মধ্যে রাজা-প্রজার সম্পর্ক ছিল, এখনো সেই সম্পর্ক বিরাজমান। সমাজের এই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যেটি বাস্তবায়নে গঠন করতে হবে যুক্তফ্রন্ট। তবে এটি নির্বাচনমুখী হবে না, হবে সমাজ বদলের যুক্তফ্রন্ট। যদি যুক্তফ্রন্ট গঠন করা যায়, তা হলে বুর্জোয়াদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই সম্ভব হবে।
শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের তিন দিনব্যাপী বিজয় উৎসবের উদ্বোধনকালে সমাজ বদলের জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠনের কথা উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের উন্নতি হয়েছে, পাকিস্তানেও উন্নতি ছিল। তবে আইয়ুব শাসনামলে গণতন্ত্র ছিল। আজকে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে সেটি পুঁজিবাদী উন্নয়ন। এই উন্নয়নের ফলে বৈষম্য, মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা ও দেশপ্রেমের অবনতি ঘটেছে। শতকরা ২০ ভাগ মানুষের উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমলে সংগ্রাম করল। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, আজ বাংলাদেশও উপনিবেশ হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে ধনীদের উপনিবেশ, এ ধনীরা লুণ্ঠন করে ধনী হয়েছে যেভাবে আগে লুণ্ঠিত হয়েছে। ২৩ বছরের শোষণ গেল, ৫৩ বছরের উন্নতি হলো, কিন্তু সমাজ আগের জায়গায় রয়ে গেল।’
সমাজে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক রাজা-প্রজার মতো অতীতেও ছিল, এখনো রয়েছে উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সংস্কারের মাধ্যমে কী সমাজবদল সম্ভব! বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসহ সবগুলোই বুর্জোয়া। যে দল পালিয়ে গেল তারা যেমন বুর্জোয়া ছিল, তেমনি আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল। যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে তারাও ওই একই ধারার। যে রাজনীতি বাংলাদেশে প্রয়োজন সেটি হলো বিরোধী রাজনীতি। এই রাজনীতির জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের জন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন।’
মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা মিললেও মুক্তি মেলেনি উল্লেখ করে ঢাবির এই ইমেরিটাস অধ্যাপক আরও বলেন, ‘স্বাধীনতা পেলেও আমরা সমাজকে বদল করতে পারিনি। ফের ওই জমিদার-প্রজার সম্পর্ক রয়ে গেছে। তাই ধনী-দরিদ্রের বিভাজন মুছে ফেলতে হবে। পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাকে মুছে ফেলে সামাজিক মালিকানার উন্নয়ন করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। গ্রাম-গঞ্জে এই সংস্কৃতি চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে এবং পুরোটাই হবে আদর্শ নির্ভর। সেই আদর্শ হচ্ছে সমাজ বদলের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার মূলে রয়েছে সমাজ বিপ্লবের চেতনা। সেই আদর্শ নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।’
তরুণদের সম্পৃক্ত করে সমাজের এ বিপ্লবের জন্য বাম ঘরনার যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তাদের যুক্তফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘অনেক ছোট ছোট দল রয়েছে। যারা ভেঙে ভেঙে ছোট হয়ে আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে। সে সব দলের উচিত একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা। এই যুক্তফ্রন্ট গঠন না হলে আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করতে পারব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তফ্রন্টে থাকবে বাম গণতান্ত্রিক, বামপন্থি এবং সমাজপন্থিদের ঐক্য। ১৯৫৪ সালে আমরা যুক্তফ্রন্ট দেখেছি, সেই যুক্তফ্রন্ট ছিল নির্বাচনের যুক্তফ্রন্ট। তবে এবার যুক্তফ্রন্ট হবে সমাজ পরিবর্তনের যুক্তফ্রন্ট। এ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনি যুক্তফ্রন্ট হবে না।’
গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের তিন দিনব্যাপী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের সমন্বয়ক জামসেদ আনোয়ার তপন, মুক্তিযোদ্ধা ও বাসদের সাবেক সম্পাদক খালেকুজ্জামান, মুক্তিযোদ্ধা নূর মুহাম্মদ, আরিফ রহমানসহ আরও অনেক বক্তব্য রাখেন।
উদ্বোধনী দিনের ওই সন্ধ্যায় শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আলোক প্রজ্জ্বলন, গান, কবিতা আবৃত্তি ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল। শনিবার থেকে শুরু হওয়া ওই আয়োজন চলবে আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত।
আরিফ জাওয়াদ/এমএ/