‘গ্রামের আলপথ ধরে দৌড়ে যাচ্ছে এক দুরন্ত কিশোর। সেই কিশোর সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীতে। কখনো আবার গাছের খোঁড়ল থেকে পাখি খুঁজছে। গোধূলিবেলায় শখের ঘুড়ির ভোঁ-কাট্টা হলে বেজায় মন খারাপ হয় তার।’ একদিন গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন; ততদিনে তিনি টগবগে যুবক। শহরে এসে কেমন বদলে গেলেন। পড়াশোনা হয়ে উঠল তার ধ্যানজ্ঞান।
সারা বেলা রাজ্যের বই কোলে করে ঘুরে বেড়াতেন শহরের এ গলি, সে গলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে মেধা-সৌকর্যে তার নাম ছড়াল দিকে দিকে। এক দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন সবার প্রিয় ‘আরেফিন স্যার’।
সদ্যপ্রয়াত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের স্মরণসভায় কৈশোরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন তার অনুজ আতিক উল্লাহ সিদ্দিক। প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে কাটানো নানা মুহূ্র্তের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্মরণসভায় অশ্রুসজল হলেন আরেফিন সিদ্দিকের শিক্ষার্থী ও সহকর্মীরা।

শনিবার (২২ মার্চ) বিকেলে রাজধানী বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এই স্মরণসভার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাকিল হাসানের সঞ্চালনায় এই আয়োজনে যোগ দেন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম শহীদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাওন্তী হায়দার, সাইফুল হক, ড. আবদুর রাজ্জাক খান, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চেয়ারপারসন শারমিন আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের জনসংযোগ ও তথ্য অধিকার বিভাগের পরিচালক শামসুল আরেফিন, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি শামসুল হক, সাবেক সভাপতি স্বপন দাশগুপ্ত, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রঞ্জন কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রদীপ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি মেহেদি হাসান, বর্তমান সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহিসহ আরও অনেকে। অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকের পারিবারিক বন্ধু ব্যবসায়ী ও গীতিকার গোলাম মোর্শেদও এই আয়োজনে অংশ নেন।
প্রিয় শিক্ষক স্মরণে আবু আলম শহীদ খান বলেন, ‘মানুষ হিসেবে স্যারকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা করা যাবে। কিন্তু তার ১০০টি কাজের ৯৯টি সত্যিকারের কাজই ছিল। একটি কাজ হয়তো ভালো করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত কলেজের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যে কথাগুলো উঠেছে, উপাচার্য হিসেবে স্যার হয়তো সেই সময় সব নীতি মেনে কাজটি করতে পারেননি। তাই বলে স্যারকে নিয়ে অযাচিত সমালোচনা ঠিক না।’
জুডিশিয়াল সার্ভিসে চাকরি করে আসা শামসুল হক বলেন, ‘আমরা যারা সরকারি চাকরি করে এসেছি, তারা জানি পরিস্থিতি আমাদের কত কিছু করতে বাধ্য করে। স্যারকেও হয়তো অনেক কিছু করতে বাধ্য হতে হয়েছে।’
অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকের সমালোচনার তীব্র নিন্দা জানান শিক্ষক শারমিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যারা স্যারের সমালোচনা করেন, তারা কীসে প্রলুব্ধ হয়ে স্যারের সমালোচনা করেন, বুঝি না। একজন শিক্ষকের ১০টি গুণের কথা যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, তবে তার সবগুলো গুণ আরেফিন স্যারের ছিল। এই সমালোচকদের বলছি, শিক্ষকদের অসম্মান করে তারা কে কত দূর যাবেন, জানি না।’
শামসুল আরেফিন বলেন, ‘ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক তৈরি করে গেছেন আমাদের স্যার। তার সমকক্ষ আর কেউ হতে পারবেন না। নিজের ব্যক্তিত্বের গুণেই তিনি সকলের সমীহ আদায় করে নিতে পারতেন। আমরা কারণে-অকারণে স্যারকে মিস করব।’
স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘এত উঁচু মাপের মানুষ ছিলেন স্যার। সহজেই তিনি মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। কেউ নেতিবাচক কথাবার্তা বললেও দেখতাম স্যার মনোযোগ দিয়ে সব শুনছেন।’
অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে এসে শাওন্তী হায়দার বলেন, ‘প্রতিবার ঈদে আমি আমার শিক্ষকদের ফোন করি। ফোনে ডায়াল করতে গেলে আগে স্যারের নামটিই আসত। স্যার আমাকে বলতেন, কেউ ফোন না করলেও তুমি যে ফোন করবে জানতাম। এবার ঈদে স্যারকে আর ফোন করতে পারব না।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে শাওন্তীর। স্মৃতিচারণ সভায় আগত শিক্ষার্থীদের চোখ তখন ছলছল করে ওঠে। অনুষ্ঠান শেষ হয় প্রিয় শিক্ষকের দ্যুতিময় ব্যক্তিত্বের সুখকর স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধায়।