
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার ১৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের অনিয়ম অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্তের প্রথম দিন বেশ কয়েকটি প্রকল্প পরিদর্শন এবং প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কাগজপত্রাদি সংগ্রহ করেছেন কমিটির সদস্যরা।
বিষয়টি নিশ্চিত করে তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব ও সিডিএর সচিব রবীন্দ্র চাকমা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা তদন্তের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আউটার রিং রোড, বায়েজিদ লিংক রোড, সিডিএ স্কয়ার পরিদর্শন করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য প্রকল্পও পরিদর্শন করব। যেহেতু তদন্তকাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে, তাই এই মুহূর্তে কোনো প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে মন্তব্য করার সুযোগ নেই। সব কাগজপত্র পর্যালোচনা তদন্ত শেষে বলতে পারব, কোনো প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে।’
এই তদন্ত কমিটির সদস্যরা হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামাল উদ্দিনকে আহ্বায়ক এবং সিডিএর সচিব রবীন্দ্র চাকমাকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন পরিকল্পনা শাখার উপসচিব-২ মো. নাজমুল আলম, সিডিএর বোর্ড সদস্য স্থপতি সৈয়দা জেরিনা হোসাইন ও অ্যাডভোকেট সৈয়দ কুদরত আলী।
তদন্তাধীন সিডিএর ১৩ প্রকল্প হলো ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ২ হাজার ১৭ কোটি টাকার বাকলিয়া এক্সেস রোড, ৬৯৮ কোটি টাকার মুরাদপুর ফ্লাইওভার, ১৪৭ কোটি টাকার বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার, ৫৮ কোটি টাকার কদমতলী ফ্লাইওভার, ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার কালুরঘাট-চাক্তাই রিং রোড প্রকল্প, ৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকার চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্প, ৩২০ কোটি টাকার বায়েজিদ লিংক রোড প্রকল্প, ৩৫ কোটি টাকার সল্টগোলা ডরমেটরি প্রকল্প।
এ ছাড়া সিডিএর ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প- সিডিএ স্কয়ার, কল্পতরু প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মাস্টার প্ল্যান প্রকল্প নিয়েও তদন্ত করবে কমিটি। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। তদন্তাধীন প্রকল্পের মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য
প্রকল্পকাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনায় ছিল।
বাকলিয়া এক্সেস রোড
বাকলিয়া এক্সেস রোডের ওপর ১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে আলোচনায় আসে সড়কটি। নবাব সিরাজউদৌল্লাহ সড়ক থেকে বাকলিয়া থানা পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণকাজ শুরুর আগেই সড়কের অ্যালাইনমেন্টের ওপর ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় সিডিএ। পরে এই ভবনের কারণে সড়কটি বাঁকা করে নির্মাণ করা হয়।
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার
চট্টগ্রাম শহরের প্রথম ফ্লাইওভার হলো বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার। ২০১২ সালে এই ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জন নিহত হন। আলোচিত সেই দুর্ঘটনায় আট আসামির সাত বছর করে কারাদণ্ড হয়। নির্মাণের এক দশক পার না হতেই ফ্লাইওভারটির চান্দগাঁও আবাসিকগামী র্যাম্পের একটি পিলারে ফাটল ধরার ঘটনা ধরা পড়ে। যদিও সিডিএ বিষয়টি অস্বীকার করে। তবে ওই র্যাম্প দিয়ে ভারী যানবাহন ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
প্রকল্পের নাম ‘লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। কিন্তু লালখান বাজারেই এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি ওঠার র্যাম্প নেই। এই মোড়ে শুধু নামার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ কারণে শুরু হয়েছে উল্টোপথে যানবাহন চলাচলের প্রবণতা। যারা শৃঙ্খলা মেনে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে চান, তাদের ঘুরতে হবে দুই কিলোমিটার। এদিকে এই এক্সপ্রেসওয়েতে ১৪টি র্যাম্প নির্মাণের প্রস্তাব থাকলেও ৫টির কাজ আপাতত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। মূলত র্যাম্প নির্মাণের কারণে যানজটের সৃষ্টি হতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই র্যাম্পগুলো নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। অন্যদিকে বাওয়া স্কুলের সামনে র্যাম্প নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে।
এ ছাড়া টাইগারপাসের দৃষ্টিনন্দন দুটি পাহাড়ের সৌন্দর্য মলিন করে র্যাম্প নির্মাণের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছিল চট্টগ্রামের সচেতন মহল। এমনকি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র টাইগারপাস রক্ষার জন্য সিডিএকে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু সিডিএ তাতে সাড়া দেয়নি। তারা টাইগারপাসের দুই পাহাড়ের একাংশ কেটে র্যাম্প নির্মাণ করে। এ ক্ষেত্রে সিডিএ নিজেই নিজের আইন ভঙ্গ করে। কারণ চট্টগ্রামের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) এবং মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বাটালী হিল থেকে শুরু করে সিআরবি পর্যন্ত এলাকা ‘হেরিটেজ জোন’ হিসেবে চিহ্নিত। টাইগারপাসের পাহাড়গুলোও এই জোনের অন্তর্ভুক্ত।
১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পায়। ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথমে ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ হয়েছিল। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকায়। সম্প্রতি এই এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায় শুরু করেছে সিডিএ।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প
সিডিএর চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প প্রথম দফায় সংশোধন করায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। শুরুতে ব্যয় ছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। তিন বছরের কাজ সাত বছরেও শেষ করতে না পারায় একলাফে ব্যয় বৃদ্ধি পায় ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। বর্ধিত ব্যয়ের মধ্যে অর্ধেক ১ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা সরকার প্রকল্পের জন্য দিতে রাজি হয়। বাকি ১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার মধ্যে ঋণ হিসেবে ৭৫৩ কোটি টাকা দেবে সরকার। বাকি ৭৫৩ কোটি টাকা সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে দিতে হবে।
এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৭২ শতাংশ। সিডিএর যে আর্থিক সামর্থ্য, তাতে সরকারি ঋণ ও নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাই ১ হাজার ৫০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা সরকারের তহবিল থেকে অনুদান প্রয়োজন। বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজের অগ্রগতির কথা দাবি করা হলেও বাস্তবে বর্ষা এলেই নগরবাসী জলাবদ্ধতায় ভোগেন। নতুন নতুন এলাকায় পানি জমছে। সেই অর্থে এই প্রকল্পে তেমন সুফল মিলছে না।
চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড
১৩ বছর ধরে কাজ চললেও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড। নগরের পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের এই প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১১ সালে। মূল সড়কের কাজ শেষে যান চলাচল শুরু হয়েছে। ২০১১ সালে মূল প্রকল্প অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। তৃতীয় দফা সংশোধনের পর প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকায়। তবে এ টাকায় কাজ শেষ করতে পারেনি সিডিএ। নতুন করে মেয়াদ যুক্ত করায় খরচ ৬৪৮ কোটি টাকা বেড়ে মোট ব্যয় ৩ হাজার ৩২৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা দাঁড়ায়। চতুর্থ দফায় বৃদ্ধি পাওয়া টাকার মধ্যে ৩৮৮ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিতে রাজি হয় সরকার, কিন্তু ঋণ নিয়ে তা পরিশোধের সামর্থ্য নেই সিডিএর।
বায়েজিদ লিংক রোড
চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত লিংক রোড নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ২০১৬ সালে ছাড়পত্র নেয় সিডিএ। কিন্তু ছাড়পত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে পাহাড় কাটার কারণে সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। অত্যন্ত খাড়াভাবে কাটা সড়কের পাশের পাহাড়গুলো বর্ষাকালে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠে। প্রতি বর্ষায় পাহাড়ধসের কারণে এই সড়কটি বেশ কয়েকবার বন্ধ হয়েছে।