
রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এইচএমপি ভাইরাসে আক্রান্ত নারীর মৃত্যু হয়েছে। তবে এইচএমপি ভাইরাসের জন্য নয়, অন্য একাধিক রোগই তার মৃত্যুর কারণ বলে জানিয়েছে সরকার।
বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) দুপুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে বলা যায়, এইচএমপিভির কারণে মৃত্যুর ঘটনা খুবই বিরল। এক মাসের বেশি সময় ধরে ওই নারী অসুস্থ। এক মাস ধরে বাসায় চিকিৎসা নিয়েছেন। তখন কী হয়েছিল, তা ডিটেক্ট করা কঠিন। কয়েক দিন আগে তিনি হাসপাতাল নেটওয়ার্কে আসেন। তিনি ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হন এবং পরবর্তী সময় তার মাল্টি অর্গান ফেইলিয়র হয়। এ ছাড়া তার অবিসিটি, থাইরয়েড ডিসফাংশন ছিল। তার মৃত্যুতে আমরা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। চিকিৎসার একপর্যায়ে নিউমোনিয়া এবং মাল্টি অর্গান ফেইলিয়রের কারণে রোগী মৃত্যুবরণ করে। সেই সঙ্গে রোগী দুর্ভাগ্যজনকভাবে এইচএমপি ভাইরাসেও আক্রান্ত ছিলেন।’
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাসার বলেন, ‘গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে রোগিনী মারা যান। তবে তিনি এইচএমপি ভাইরাসের জন্য মারা যাননি। অন্য কমপ্লিকেশন ছিল, সে জন্য অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কিডনির সমস্যার পাশাপাশি তিনি অনেক মোটা ছিলেন।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আপনারা জানেন কোনো ভাইরাসের যখন বিস্তার হতে থাকে তখন সেটির প্রতিনিয়ত মিউটেশন বা পরিবর্তন হতে থাকে। কোভিড ভাইরাসও অনেক পুরোনো ভাইরাস ছিল। মিউটেশনের কারণে এটি ক্ষতিকর বা প্রাণঘাতী হয়ে যেতে পারে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যতটা সম্ভব এর বিস্তার যাতে রোধ করা যায়। যদি দরকার হয় তাহলে আমাদের কোভিডকালীন যে প্রস্তুতি ছিল সেটা পুনরায় আমরা পুনরুজ্জীবিত করব।’
সম্প্রতি চীন ও জাপানে অনেকেই এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হয়েছেন। ভারতেও বেশ কয়েকজন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। গত ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশেও এক নারীর শরীরে এই ভাইরাস শনাক্তের কথা জানায় দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে ওই নারীর পরিবারের কারও বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই। দেশে থেকেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। গত ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়।
২০১৭ সাল থেকেই দেশে এই ভাইরাস শনাক্তে পরীক্ষা করে আসছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডসিআর)। তখন থেকেই এই রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে ২০১৫ সালে এক গবেষণা চালাতে গিয়ে তখনো ২৬ জন শিশুর শরীরে এই ভাইরাস পাওয়া যায়। কিন্তু কখনো কোনো জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার ইতিহাস নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএমপিভি সবার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। শুধু একাধিক রোগে আক্রান্তদের জন্য ভাইরাসটি ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু এইচএমপিভি নয়, সব ভাইরাসই একাধিক রোগে আক্রান্তদের জীবনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সে জন্য যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি রোগ, সিওপিডি, অ্যাজমা, ক্যানসারের মতো জটিল রোগ আছে, তাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিলে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল ও পুষ্টিকর খাবার খেলে রোগটি ভালো হয়ে যায়। একাধিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়া এই রোগ শনাক্তে পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।
বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ‘হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিভি)-এর উদীয়মান প্রবণতা: বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন হুমকি’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগ আয়োজিত এই সেমিনারে অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম জানান, হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষা ও এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউর সব রকমের প্রস্তুতি রয়েছে।
সেমিনারে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যানসারের রোগীসহ যেসব রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, অবশ্যই তাদের ক্ষেত্রে সতর্কতা থাকা জরুরি। ব্যক্তি পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ইতোমধ্যে আগের তুলনায় নিউমোনিয়া ও অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাই ব্যক্তি পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি হয়ে পড়েছে। যেসব রোগীর বা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা এই সময় সিজনাল ভ্যাকসিন বা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন ও নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নিতে পারেন, যা তাদের জীবনের সুরক্ষা হিসেবে কাজ করবে।’
ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত বলেন, ‘এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত জ্বর, কাশি, নাক বন্ধ, গলাব্যথা এসব লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে। এ ছাড়া চামড়ায় র্যাশ এবং কখনো কখনো শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এইচএমপি ভাইরাসে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, এমন কোনো ওষুধ সেবন করছেন, যেমন- কেমোথেরাপি, স্টেরয়েড ইত্যাদি তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। যদিও এই ভাইরাসটি সাধারণত জটিল আকার ধারণ করে না, তথাপি কিছু ক্ষেত্রে যেমন যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি রোগ, সিওপিডি, অ্যাজমা অথবা ক্যান্সারের মতন জটিল রোগ আছে তাদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।’
এই ভাইরাসটি সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশির ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই কিছু নিয়ম কানুন মেনে চললে খুব সহজেই এই রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব বলে জানান তিনি। ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘বাইরে গেলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, সাবান, পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুতে হবে, হাঁচি কাশি দেয়ার সময় টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে নিতে হবে, আর টিস্যু না থাকলে হাতের কনুই ভাঁজ করে সেখানে মুখ গুঁজে হাঁচি কাশি দিতে হবে, আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, জনসমাগম বা ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে ইত্যাদি।’
সাধারণত শীতকাল ও বসন্তকালে এ রোগের সংক্রমণ বেশী দেখা যায় জানিয়ে ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে সাধারণ ফ্লু-এর মত লক্ষণ প্রকাশ পায় যা ৫ থেকে ৭ দিনের মাঝে আপনা আপনিই ভাল হয়ে যায়, তাই কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন অনেক বয়স্ক মানুষ, ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তি, একইসাথে একাধিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়া এই রোগ শনাক্তকাণের জন্য কোনো পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো সুনির্দিষ্ট এ্যান্টি ভাইরাল ঔষধ বা ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়নি, তবে অন্যান্য সাধারণ সর্দি জ্বরের মতই হওয়াতে এ রোগের জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসার দরকার নেই, শুধুমাত্র লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিলেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। যেমন- জ্বর হলে প্যারিসিটামল, সর্দি কাশি হলে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ দিতে হয়, একইসঙ্গে রোগীকে পর্যপ্ত পরিমাণে তরল খাবার ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিতে হবে। তাই আতংকিত না হয়ে সচেতন হওয়াটা খুব জরুরি।