
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির ব্যাপারে একমত থাকলেও তাতে মতামত দিতে সময় চেয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। পাশাপাশি বৈঠকের দাওয়াত এবং অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া পেতে দেরি হওয়ায় বৈঠকে অংশ নিয়ে অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) বিকেল ৪টা ২০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রাজধানীর হেয়ার রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম, গণতন্ত্র মঞ্চ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনডিএমসহ ১৬টি রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারাও বৈঠকে অংশ নেন। সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও বৈঠকে ছিলেন। প্রায় সব দলই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটা ঘোষণাপত্র করার দরকার আছে। তবে ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক বা আইনগত প্রকৃতি কী হবে, সেটা স্পষ্ট করতে হবে। রাজনৈতিক শক্তি, ছাত্র-জনতাসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে হবে। এটার জন্য যত সময় প্রয়োজন নেওয়া যেতে পারে।
বৈঠকের শুরুতে ঐক্যবদ্ধভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করতে না পারলে উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যখন আমরা নিজেরা নিজেরা কাজ করি, তখন দেখি একা পড়ে গেছি, আশপাশে কেউ নেই আপনারা। তখন একটু দুর্বল মনে করি। যখন আবার সবাই একসঙ্গে কাজ করি, তখন মনের মধ্যে সাহস বাড়ে, একতাবদ্ধভাবে আছি। এ শক্তি কাজে লাগিয়ে আমাদের জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করতে হবে। তা না হলে উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।’
ঘোষণাপত্রটি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে যদি দেশের সামনে আসতে পারি, তবে তা দেশের জন্য ভালো হবে। আন্তর্জাতিকভাবেও ভালো হবে। সবাই দেখবে যে এ জাতির মধ্যে বহু ঠোকাঠুকি হয়েছে কিন্তু নড়ে না। স্থির হয়ে আছে, শক্ত হয়ে আছে। তা সারা দুনিয়াকে জানাতে চাই, দেশবাসীকে জানাতে চাই।’
বৈঠকের সূত্রমতে, বৈঠকের দাওয়াত সঠিক সময়ে না পাওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছে বেশির ভাগ দল। এ ছাড়া ঘোষণাপত্রের কাগজপত্র দুই-এক ঘণ্টা আগে পাওয়ায় তারা গাড়িতে বসে দেখেছেন এবং নিজ দলের মধ্যেও আলোচনা করতে পারেননি, তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন দলগুলোর নেতারা। জোট এবং দলের মধ্যে আলোচনা করে মতামত দিতে সময় চেয়েছেন তারা। ঘোষণাপত্রের অথরিটি কে বা কারা? এটা কি ছাত্ররা করেছেন নাকি ব্যক্তিগত উপদেষ্টারা করেছেন- তা জানতে চেয়েছে বেশির ভাগ দলই। বৈঠকে ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য একটা ‘ড্রাফট কমিশন’ গঠন করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ কমিশনের সদস্যরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নিয়ে ঘোষণাপত্র তৈরি করবেন। অথবা সংবিধান সংস্কার কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কারণ ঘোষণাপত্র পরবর্তী সময়ে সংবিধানের অংশ হবে। তবে বৈঠকে অংশ নেওয়া সব দলই ঘোষণাপত্র তৈরির পক্ষে একমত পোষণ করেছে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা সবাই একত্রে ছিলাম এবং এই ঐক্য যেন ভেঙে না যায়। ঘোষণাপত্র নিয়ে খুব বেশি তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। সবাই মিলে ধীরগতিতে পরামর্শ করে সবাই যেন একমত হতে পারি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে যেন প্রশ্ন না তৈরি হয় এবং এটা প্রশ্নবিদ্ধ হোক, আমরা তা চাই না।’
সূত্র আরও জানায়, জুলাই অভ্যুত্থানে যাদের অবদান রয়েছে, তাদের স্বীকৃতি যেন তুলে ধরা হয়। কাউকে যেন হেয়প্রতিপন্ন বা খাটো না করা হয়। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এক দিনে গড়ে ওঠেনি। গত ১৬ বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সফলতা পেয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৮ সালেই শুরু হয়েছিল, তারও একটা স্বীকৃতি থাকা দরকার। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, তা যতদিন থাকবে তিনি ততদিন থাকবেন। ঐক্যর ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কার হবে বলেও বার্তা দিয়েছেন তিনি।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আমাদের রাজনৈতিক ঐক্যে যাতে ফাটল না ধরে, সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। আমরা প্রশ্ন করেছি, আসলে সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কি? যদি থেকে থাকে, সেটার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক এবং আইনি গুরুত্ব কী, সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে। সেই ঐক্যকে গণঐক্যে রূপান্তর করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি যাতে আমাদের ভেতরে অনৈক্যের বীজ বপন করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যদি কোনো রাজনৈতিক দলিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে আমরা অবশ্যই সম্মান করি। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়, সেই পরামর্শ আমরা দিয়েছি।’
বৈঠক শেষে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সবাই একমত হয়েছে। তবে তাড়াহুড়ো করতে গেলে অভ্যুত্থানের চেতনার ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে।
তবে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে দুই দিন আগে থেকে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া খসড়াগুলো অনেকেই সময়মতো পায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা পরামর্শ দিয়েছি সরকারের এমন একটি মূল্যবান দলিল তৈরির পেছনে কোনো অস্থিরতা, অসংগতি বা সমন্বয়হীনতার প্রয়োজন নেই। ধীরস্থিরভাবে আমাদের এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের জন্য আরও মতবিনিময় হওয়া দরকার।’
এবি পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, তড়িঘড়ি না করে একটি কমিশনের মাধ্যমে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি ঘোষণাপত্র সরকারের পক্ষ থেকে জাতির উদ্দেশে ঘোষণা করা উচিত। যেখানে বলা থাকবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা কী ছিল? তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রদের যেমন অবদান আছে, তেমনি গত ১৫ বছর রাজনৈতিক দলগুলোর স্যাক্রিফাইস ও অবদান সম্মানের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে এবং প্রবাসীদের অবদান স্বীকার করতে হবে।
ঘোষণাপত্র তৈরিতে তাড়াহুড়া ও যেনতেন প্রক্রিয়া যেন অবলম্বন না করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার আহ্বান জানিয়েছেন গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি জানান, ‘আমরা বলেছি, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। আশা করি, আমাদের প্রস্তাবগুলো অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার কর্মপন্থা তৈরি করবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজন মিলে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি। ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জারি হবে, এটা এখন নিশ্চিত। পরবর্তী ধাপে আলোচনা করব জুলাই ঘোষণাপত্রে কী কী থাকবে। আমরা আশাবাদী, অবিলম্বে ঐকমত্যে পৌঁছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জাতির সামনে তুলে ধরতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দিতে পারব।’
বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েও অংশ নেয়নি অনেক দল
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠকে অংশ নেয়নি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদ এবং বাংলাদেশ লেবার পার্টি। তবে বৈঠকের আমন্ত্রণ পায়নি ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়বাদী সমমনা জোট।
সিপিবি ও বাসদ-এর বার্তায় বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে তারা বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে আমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন। তাদের বলা হয়েছিল বিকেল ৪টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে থাকতে। কিন্তু ঘোষণাপত্রের বিষয়ে বাম জোট ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আগেই তারা এই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।