দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তিনটি মামলার বিচার চলছে, আরেকটি তদন্তাধীন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দেশের একটি মাছের খামার থেকে তিনি ৯ লাখ টাকা আয় করেন। ইনকাম ট্যাক্সে হঠাৎ করেই ১০ থেকে ৩০ ভরি স্বর্ণ বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন অসংগতি পাওয়া গেছে। তিনি যতই বলুক না কেন তিনি ব্রিটিশ, আমরা উপযুক্ত কাগজপত্র পেয়েছি যে, তিনি বাংলাদেশি। এখন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সুবিধার জন্য কখনো ব্রিটিশ, কখনো বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিচ্ছেন। তবে, দুদকের দৃষ্টিতে তিনি শুধুই একজন অভিযুক্ত। আমরা আমাদের নাগরিকের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
সোমবার ( ১৬ জুন) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন দুদক চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘টিউলিপ নিজেকে নির্দোষ দাবি করলে মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন কেন? তার আইনজীবী দুদকে চিঠি লিখলেন কেন? আমরা তার আইনজীবীকে জানিয়েছি, আমাদের আইনের বিধান অনুযায়ী তাকে (টিউলিপ) আমাদের আদালতে মোকাবিলা করতে হবে।’
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘টিউলিপ যদিও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা তাকে দেননি এবং কেন সেটা হয়নি তার যথাযথ ব্যাখ্যা প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে এমন সাক্ষাতের সুযোগ নেই।’
যুক্তরাজ্যে আরও সম্পদ জব্দের চেষ্টা: মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, ‘সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি এবং এনআরবিসি কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের সম্পত্তি জব্দ করতে বাংলাদেশের আদালতের আদেশসহ প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাপ্ত মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্টের (এমএলএআর) মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য লন্ডনে পাঠানো হয়েছে।’
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও আমার লন্ডন সফর আগেই নির্ধারিত ছিল। একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টার সফরও সেখানে ছিল। কাজেই আমাদের যাওয়াটা একসঙ্গে হয়েছে। কিন্তু প্রোগ্রামটা আলাদা ছিল। আমরা (গভর্নর ও দুদক চেয়ারম্যান) আগেই ঠিক করেছিলাম যে, লন্ডনে জাতীয় অপরাধ সংস্থা (ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি-এনসিএ) এবং আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন সংস্থার (ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার) সঙ্গে আমাদের বৈঠক হবে। আমরা বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদের একটি প্রাথমিক তালিকা এবং আদালতের আদেশ সংযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি। আমি বলতেই পারি, এনসিএ খুবই কার্যকরভাবে কাজ করেছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদের পাচার করা টাকায় কেনা অনেক সম্পদ তারা জব্দ করতে আমাদের সহায়তা করেছে। এনসিএর এই বন্ধুসুলভ সহযোগিতার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি। আমরা লন্ডনে উপস্থিত থাকার সময়ই সম্পদ জব্দের আদেশ জারি হয়। বিভিন্ন দেশে জাভেদের ৫৮০টি বাড়ির খোঁজ আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে ৩৪৩টি যুক্তরাজ্যে, ২২৮টি সংযুক্ত আরব আমিরাতে এবং ৯টি যুক্তরাষ্ট্রে।
বাংলাদেশের থাকা বাদ দিয়ে শুধু যুক্তরাজ্যের ৩৪৩টি বাড়ির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৭৩.১৫ মিলিয়ন পাউন্ড, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০২৫ কোটি টাকা। এনসিএ ইতোমধ্যে এই সম্পদ ফ্রিজ করেছে। এ ছাড়া তার প্রায় ২৫ লাখ ডলারের সমপরিমাণ ব্যাংক আমানত (প্রায় ৩৫ কোটি টাকা) ফ্রিজ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট’ পাঠানো হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য যে, যুক্তরাজ্য প্রথমে সাড়া দিয়েছে। লন্ডন সফরের সময় ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে একটি ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামো’ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের অনুসন্ধান ও আইনি ব্যবস্থায় বাংলাদেশ এখনো অভিজ্ঞ নয়, তাই এনসিএ আমাদের প্রশিক্ষণ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে একজন বিদেশি প্রশিক্ষক আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকও এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে। গভর্নর নিজে লন্ডনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে পৃথক সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। এখানে একটা সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে- জব্দকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনতে হলে আমাদের দাবি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে হবে। আমাদের আদালতের আদেশের পাশাপাশি এনসিএর সহযোগিতায় যুক্তরাজ্যের আদালতেও একইভাবে প্রমাণ করতে হবে। এরপর সেসব অর্থ-সম্পদ আনার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব।’
মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, ‘যারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অর্থ ফেরত আনার একটি প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা হয়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে আমরা শুধু বলতে চাই, দুদকের যেসব মামলা রয়েছে, তার কোনোটিই আপস বা মীমাংসাযোগ্য নয়। যেহেতু দুদকের মামলা ফৌজদারি প্রকৃতির, সেগুলোর নিষ্পত্তি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব নয়। তবে গভর্নর যে দেওয়ানি মামলার কথা বলেছেন, তা আমাদের আওতাভুক্ত নয়। আমরা দুদকের বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় থেকে যতটুকু করণীয়, তা করে যাচ্ছি।’
আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের আসামি প্রত্যর্পণ আইন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ফেরানোর বিষয়ে সরকার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন (ইউএনসিএসি) এবং ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইমের (ইউএনটিওসি) আওতায় আনার প্রচেষ্টা রয়েছে।’