
চারদিকে এখন পলাশ, শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার সমারোহ; যেন আগুন ছড়িয়ে এসেছে ফাগুন। ষড়ঋতুর পালাবদলে এই বঙ্গে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। ফাগুনের বাতাসে সেজেছে প্রকৃতি; খুশি-রঙ্গে-তরঙ্গে গাছে গাছে নাচছে কোকিল, দোয়েল, টিয়া। বসন্তের প্রথম প্রহরে আবির ছড়িয়ে ঋতুরাজকে বরণ করে নিতে নগর আর গ্রাম সেজেছে বর্ণিল উৎসবে।
এবার এই বঙ্গে বসন্ত এল এক ভিন্ন আবহে। গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্মৃতিতে এখনো শোকাতুর এই দেশ। হাজারও মানুষের মৃত্যু-ব্যথা এখনো জাগরূক অন্তরে।
বুকে অনন্ত শোক চেপে তবুও মানুষ উদযাপন করবেন বসন্ত উৎসব। রাগ বসন্ত বিহারে নগরে বসন্তকে স্বাগত জানাবেন কিন্নরকণ্ঠী তরুণীরা। মাদল-তালে সম্মেলক নৃত্যে ফাগুয়ার রঙ ছড়াবে কিশোরীরা।
২০২০ সালে বাংলা একাডেমির সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বাংলাদেশে বসন্ত উৎসব পালিত হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি।
ইতিহাস বলছে, ১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রতি বছর ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব। ১৯০৭ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে যাত্রা শুরু করে বসন্ত উৎসব, যা ‘ঋতুরঙ্গ উৎসব’ নামেই পরিচিত।
স্বাধীন বাংলাদেশে বসন্ত উৎসবের গোড়াপত্তন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। সেই সময়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ছোট্ট পরিসরে শুরু হয় বসন্ত উৎসব। রঙিন কাগজের ফুল, প্রজাপতি ও পাখির অবয়ব নিয়ে চারুকলা অনুষদের ৮৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করেন। পরে বাংলা ১৪০১ সালে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ-এর আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় শুরু হয় বসন্ত উৎসব।
আজ শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল সোয়া ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনটি একই সময়ে শুরু হবে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে।
এবার বসন্তের প্রকৃতির পালাবদল নিয়ে প্রকৃতিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় বলেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তনে এখন আর ষড়ঋতুর পালাবদল ঠিক বোঝা যায় না। কোনো বৈশিষ্ট্যেই যেন ঋতুগুলোকে আর আলাদা করতে পারি না আমরা। কিন্তু তবুও তো ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে। নগর জীবন, গ্রামীণ জীবন আর অরণ্য- এই তিনভাবে আমরা ঋতুরাজের পালাবদল দেখি। আমাদের রমনায় এখন মাধবীলতায় ফুল ফুটছে, গ্রামের গাছে গাছে পাখি গাইছে, অরণ্যে গামারি গাছে ফুটেছে নতুন ফুল। বসন্ত যে আলাদা সত্তা নিয়ে প্রতিভাত হয়েছে এই দেশে, তাকে কি আমরা বরণ করে নেব না? যে বসন্ত আমাদের উদ্দীপ্ত করে, সেই বসন্তকে নানা উপচারে স্বাগত জানাব আমরা।’
তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বসন্ত উৎসবের রঙও কিছুটা ফিকে হয়েছে এবার। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি স্থপতি সফিউদ্দিন আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বসন্ত এই বঙ্গে আসে মিলনের বারতা নিয়ে। কিন্তু এই বসন্তে আমরা দেখছি মানুষে-মানুষে বিচ্ছিন্নতা। সমাজে বিভিন্ন রকমের মানুষের বাস। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে তারা ভাবছেন, আমাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রটা বুঝি আলাদা।’
ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের পরে দেশে সংস্কৃতি চর্চার প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় কবিতা পরিষদের আহ্বায়ক কবি মোহন রায়হান। তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেখানে আমরা নতুন একটা রূপ দেখছি। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জুলাই বিপ্লবের একটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির কাজে বাধা দিচ্ছে। তাই এবার বসন্ত উৎসবের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।’