
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে নাকি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে-এ প্রশ্নে দ্বিমত থাকলেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থানের প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করছে। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার- এই ৩টি বিষয়ে একসঙ্গে চলার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বৈঠক অংশ নেওয়া দলগুলো।
গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এ মতামত দেন।
রাষ্ট্র সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বেলা ৩টার দিকে ঢাকার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠক শুরু হয়। আড়াই ঘণ্ট্যাব্যাপী এই বৈঠক শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টার দিকে। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৬টি রাজনৈতিক দল ও জোটের শতাধিক নেতা অংশ নেন। তবে আওয়ামী লীগের জোটে থাকা কোনো দল ও জাতীয় পার্টিকে এই বৈঠকে ডাকা হয়নি। এর আগে দুপুর ২টার পর থেকেই দলগুলোর নেতারা প্রবেশ করেন। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা চতুর্থ দফায় দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘দেশ, দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দল ছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন গড়ে উঠেছে। সে কারণে অপর পক্ষ সুবিধা করতে পারছে না। পদে পদে তারা ব্যাহত হচ্ছে। বহুবার প্ররোচনা করেও গল্প টিকাতে পারছে না তারা। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অপপ্রচার চালাতে গিয়েও পারেনি। যত ছোট-বড়, মাঝারি ও ধনী রাষ্ট্র- সবাই আমাদের পক্ষে। কারও কোনো দ্বিধা নেই।’
জানা গেছে, জাতীয় ঐকমত্যের কমিশনের বৈঠকে প্রথম দিনে পরিচিত সভা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো বই আকারে প্রতিটি রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠনো হবে। আগামী দিনে প্রতিটি দল ও জোটের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
বৈঠক সূত্র জানায়, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে।
তবে বিএনপি, বিজেপি ও গণতন্ত্র মঞ্চসহ বাকি দলগুলো এর বিরোধিতা করেছে। ওই সব দলের নেতাদের দাবি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে দেশে সহিংসতা বেড়ে যেতে পারে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের দোসররা ফাঁকফোকড় দিয়ে ঢুকে পড়বে। তারা দেশ আবারও অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালাবে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা বলেছেন, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদে কোথাও মেয়র বা চেয়ারম্যান নেই। নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে এবং উন্নয়ন কাজ থেমে আছে। তাই প্রশাসক বা নির্বাচন দেওয়া জরুরি।
সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে বেশির ভাগ দলই জাতীয় নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার- এই তিনটি বিষয়ে একসঙ্গে চলার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। সব দলই এই তিন বিষয়ে একসঙ্গে চলার ব্যাপারে মতামত দেন। তবে জাতীয় নির্বাচন গতানুগতি নাকি সংখ্যানুপাতিক (পিআর)- কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে বৈঠক আলোচনা হয়। এক্ষেত্রে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে আয়োজনের কথা বলেছেন। নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সামনে আরও আলোচনা হবে বলে সরকারের পক্ষে থেকে জানানো হয়েছে। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের পক্ষ থেকে সংস্কার কমিশনকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সুনির্দিষ্ট মতামত পরর্বতী সময়ে তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং তাদের বিচার দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তবে ২০২৪ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন এলডিপির একাংশের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ কোনো কোনো নেতা। ওই দুটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুটি দলকে আমন্ত্রণ জানানোয় উষ্মা প্রকাশ করেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আশা করব দ্রুত এই সংস্কারের ন্যূনতম ঐকমত্য তৈরি হবে। ন্যূনতম সংস্কার শেষে অতি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলোর ওপর প্রতিটি দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে। দলগুলো এটা নিয়ে কমিশনের সঙ্গে কথা বলবে এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সে জন্য আজকে প্রাথমিক আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে হতে হবে, তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে।’
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সব পজিটিভ (ইতিবাচক) সিদ্ধান্তকে জামায়াত ইসলামী সমর্থন জানাবে। আমরা বলেছি এই সংস্কার কমিশন তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পরে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আজকে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। তারা আমাদের সংস্কারের রিপোর্ট বই আকারে দেবেন, সেই বই পর্যালোচনা করে জামায়াত এবং সরকারের যে টিম রয়েছে তাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক হবে। সেখানে আমরা আলোচনা করে মূল সিদ্ধান্ত জানাব।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে বিষয়ভিত্তিক কোনো আলোচনা হয়নি উল্লেখ করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা পরিষ্কারভাবে বলেছেন, কোনো প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব তাদের নেই। আলাপ-আলোচনা করে একটি বোঝাপড়া তৈরি করে যে প্রশ্নে আমরা একমত হতে পারব, সেই ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ তৈরির চেষ্টা হবে। জাতীয় সনদের ভিত্তিতে পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচন বা সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে আলোচনা হবে।’
বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘বৈঠকে ছোট ছোট পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কবে হবে, কোন কোন দল দ্রুত নির্বাচন চায়, এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাই না। কোনো ধরনের সংস্কারের জন্য যেন জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত না হয়, সে বিষয়ে আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি।’ তিনি বলেন, সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনেক জায়গা থেকে আশ্বাস পেয়েছি। আমরা যদি সেই সহযোগিতা পাই তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। জাতিসংঘের যে সহযোগিতার কথা বলেছে, সেটি আমাদের জন্য বিরাট মাইলফলক। কিন্তু বিদেশিরা বলেছেন আমরা তোমাদের অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে পারব কিন্তু তোমাদের যে সংস্কার সেটি আমরা করতে পারব না।’ তাই তিনি বলেছেন, এই সংস্কারের জন্য সবার সহযোগিতা দরকার।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয় তাহলে মানুষের অগ্রাধিকার বদলে যাবে। তাতে অনেক নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। যারা এই অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে সবার কথা হলো জনগণ যেন অভ্যুত্থানের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকে, অভ্যুত্থানের শক্তি যেন ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী দিনের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে পারি সেটাই হলো একান্ত কাম্য।’
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অংশ নেওয়া দলগুলো হলো- জাতীয় নাগরিক কমিটি, এলডিপি, এবি পার্টি, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, ডেমোক্রেটিক লেফট ইউনিটি, লেবার পার্টি, জাসদ, গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, গণফোরাম, আমজনতার দল, লেফট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বৈঠকে অংশ নেন স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দীন আহমেদ। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, কেন্দ্রীয় নেতা এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ, সাইফুল আলম খান মিলন, অ্যাডভোকেট মশিউল আলম। এ ছাড়াও বৈঠকে অংশ নেন এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুছ আহমেদ, জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক এহসানুল হুদা, মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাগপার সিনিয়র সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধানসহ ১১জন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্ব গণতন্ত্র মঞ্চের ৬ জন, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ ৩ জন, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ, মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের প্রমুখ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই বৈঠকে অংশ নেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মূয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।