
সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করে ঐক্যের ভিত্তিতে ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ছয় কমিশন থেকে প্রাপ্ত ১৬৬ সুপারিশ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ।
সোমবার (১০ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনায় গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য জানান।
কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফররাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক ও ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমি মনে করি প্রধান সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব। নির্বাচন ও সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কাজেই ঐকমত্য কমিশনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন আয়োজনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন করার কথা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনের সময়সূচি তৈরির চেষ্টা চলছে বলে সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে। আশা করছি, নির্বাচন নিয়ে খুব শিগগির আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আসবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে নির্বাচন কমিশন ও সরকার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করা।’
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ শেষ করতে চায়। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি কালকেই সংস্কারের সব বিষয়ে একমত হয়, তাহলে পরশু দিনের মধ্যে কমিশনের কাজ শেষ হয়ে যাবে, বিষয়টি এমন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজন অনুভূত হয়ে আসছে। অনেক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আমরা সেই সুযোগ পেয়েছি। এটাকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাঠামো মনে করছি। ফলে আগামীকাল নির্বাচনের বিবেচনার চেয়ে বড় বিবেচনা হচ্ছে বাংলাদেশ কোন পথে অগ্রসর হবে সেটি ঠিক করা। সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব এটি। জাতীয় সনদ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্দেশ করবে।’
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সেগুলোকে সন্নিবেশিত করা। সবার অঙ্গীকার নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক দলগুলো যে যেখানেই থাকুক, ক্ষমতায় থাকুক অথবা বাইরে থাকুক, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে এগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। সংস্কার প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গণভোট দেওয়া যেতে পারে। কিংবা এর আলোকে সংবিধান ও অন্যান্য আইনের যেসব পরিবর্তন তার খসড়া তৈরি করে চুক্তি করতে পারে।’
কতটি দলের ঐক্য হলে তাকে জাতীয় ঐকমত্য হিসেবে ধরা হবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘সংখ্যা বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা অবশ্যই অধিকাংশ দলের মতকে প্রাধান্য দেব। তবে প্রতিটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে ৩৪টি দলই একমত হলে কাজটা ভালো ও সহজ হবে। সংখ্যা বিবেচনা যেমন আছে, তেমন প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এবং শক্তির প্রভাব সমাজে আছে। আমরা যদি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে পারি, সেটাই আমাদের গ্রহণযোগ্য হবে।’
অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করার সুযোগ আছে কি না- এমন প্রশ্নে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করা যায়। এটা বাংলাদেশে হয়েছে। ফলে এটা নিয়ে একমত হতে পারে, আবার দ্বিমতও হতে পারে।’
গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই সঙ্গে সম্ভব জানিয়ে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘যারা প্রথমে গণপরিষদের দায়িত্ব পালন করবেন, পরবর্তী সময়ে তারা জাতীয় সংসদে কাজ করবেন। আবার পাশাপাশিও করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হলে এটা সম্ভব।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘এই মুহূর্তে যেকোনো অবস্থাতেই আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আলোচনা অগ্রসর হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের পাশাপাশি নাগরিকদের মতামত জানার জন্য শিগগিরই সুপারিশগুলো ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। তবে রাজনৈতিক দলের বাইরে কারও সঙ্গে আলোচনা করবে না জাতীয় কমিশন।’
সংস্কার কমিশনগুলো থেকে এ পর্যন্ত ১৬৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ ২৭টি, বিচার বিভাগসংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি, জনপ্রশাসনসংক্রান্ত সুপারিশ ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনসংক্রান্ত সুপারিশ ২০টি। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত মতামত সাপেক্ষে দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা হবে। তবে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়নি।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিশন ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়।
এসব সুপারিশ বিবেচনা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ছয় মাসের জন্য একটি কমিশন গঠন করেছে সরকার। গত ১২ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি এবং ড. আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করে সাত সদস্যের এই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।