গোল্ডেন ভিসার সুবিধা নিয়ে দুবাইয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। তাদের নামে দোকান, ফ্ল্যাট, বাড়িসহ ৯৭২টি সম্পত্তি কেনার তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে ২০২৩ সালে ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্টের নির্দেশে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এ জন্য ওই বছর ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় তিন সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান কমিটি। একই বছর ১৬ এপ্রিল ৪৫৯ জনের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আলাদা চিঠি দেয় দুদকের মানি লন্ডারিং শাখা। দুই দপ্তর থেকে তথ্য পেয়ে দুবাইয়ে অর্থ পাচারকারী ৭০ জনকে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছে দুদক। ফলে, তাদের কর নথি চেয়ে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়েছেন দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানকারী দলের প্রধান ও দুদকের উপপরিচালক রাম প্রসাদ মণ্ডলের পাঠানো চিঠিতে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের ই-টিআইএন, আয়কর রিটার্নসহ সংশ্লিষ্ট সব তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছে। তালিকায় শুধু নাম ব্যবহার করা হলেও তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি প্রকাশ করা হয়নি। তবে তালিকায় ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে চিহ্নিত ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। তাদের নামে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার করা টাকায় দুবাইয়ে সম্পত্তি কেনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিহ্নিত ৭০ বাংলাদেশি হলেন- সাইফুজ্জামান চৌধুরী, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, এম এ হাশেম, সৈয়দ এ কে আনোয়ারুজ্জামান ওরফে সৈয়দ কামরুজ্জামান, আহসানুল করীম, আনজুমান আরা শহীদ, হেফজুল বারী মোহাম্মদ ইকবাল, মোহাম্মদ ইমদাদুল হক ভরসা, হুমায়রা সেলিম, জুরান চন্দ্র ভৌমিক, মো. রাব্বী খান, মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ অলিউর রহমান, এস এ খান ইখতেখারুজ্জামান, সৈয়দ ফাহিম আহমেদ, সৈয়দ হাসনাইন, সৈয়দ মাহমুদুল হক, সৈয়দ রুহুল হক, গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া, হাজী মোস্তফা ভূঁইয়া, মনজ কান্তি পাল, মো. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, মো. মাহবুবুল হক সরকার, মো. সেলিম রেজা, মোহাম্মদ ইলিয়াস বজলুর রহমান, এস ইউ আহমেদ, শেহতাজ মুন্সী খান, এ কে এম ফজলুর রহমান, আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ, গুলজার আলম চৌধুরী, হাসান আশিক তাইমুর ইসলাম, হাসান রেজা মহিদুল ইসলাম, খালেদ মাহমুদ, এম সাজ্জাদ আলম, মোহাম্মদ ইয়াসিন আলী, মোস্তফা আমির ফয়সাল, রিফাত আলী ভূঁইয়া, সালিমুল হক ঈসা ওরফে হাকিম মোহাম্মদ ঈসা, সৈয়দ সালমান মাসুদ, সৈয়দ সাইমুল হক, আবদুল হাই সরকার, আহমেদ সামীর পাশা, ফাহমিদা শবনম চৈতি, মো. আবুল কালাম, ফাতেমা বেগম কামাল, মোহাম্মদ আল রুমান খান, মায়নুল হক সিদ্দিকী, মুনিয়া আওয়ান, সাদিক হোসেন মো. শাকিল, আবদুল্লাহ মামুন মারুফ, মোহাম্মদ আরমান হোসেন, মোহাম্মদ শওকত হোসেন সিদ্দিকী, মোস্তফা জামাল নাসের, আহমেদ ইমরান চৌধুরী, বিল্লাল হোসেন, মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন চৌধুরী, নাতাশা নূর মুমু, সৈয়দ মিজান মোহাম্মদ আবু হানিফ সিদ্দিকী, সায়েদা দুররাক সিনদা জারা, আহমেদ ইফজাল চৌধুরী, ফারহানা মোনেম, ফারজানা আনজুম খান, কে এইচ মশিউর রহমান, এম এ সালাম, মো. আলী হোসেন মোহাম্মদ ইমরান, মোহাম্মদ রোহেন কবীর, মনজিলা মোর্শেদ, মোহাম্মদ সানাউল্যাহ চৌধুরী, মোহাম্মদ সরফুল ইসলাম, সৈয়দ রফিকুল আলম ও আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন খবরের কাগজকে জানান, ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট যেকোনো নথি তলব করতে পারেন। বিদ্যমান আইন অনুসরণ করে দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে দুদকের সব অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি’ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ‘সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুবাইয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪৫৯ বাংলাদেশির কেনা সম্পত্তির কাগজে-কলমে মূল্য ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার (৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি)।
সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে উপসাগরীয় দেশগুলোতে পাচার করা অর্থ দিয়ে আবাসন সম্পদ কেনার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তথ্য গোপন করে ৪৫৯ বাংলাদেশি দুবাইয়ে দোকান, ফ্ল্যাট, বাড়িসহ ৯৭২টি সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ জন্য তারা ব্যয় করেছেন অন্তত ৩১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ সম্পদের মধ্যে রয়েছে দুবাইয়ের অভিজাত এলাকা মেরিনায় ৬৪টি ও পাম জুমেইরাহতে ১৯টি। সেখানে অন্তত ১০০টি ভিলা ও কমপক্ষে পাঁচটি ভবনের মালিকরা বাংলাদেশি। এর মধ্যে চার-পাঁচজন বাংলাদেশি প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির মালিক। তবে, প্রতিবেদনে সম্পত্তি মালিকদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।