রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক। ছবি: পিআইডি
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী বাঙালিদের ওপর যে গণহত্যা চালায়, তার জন্য দেশটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া দেশভাগের সময় পাকিস্তানের কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের পাওনা রয়েছে, তাও দিতে হবে। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়। সেই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বৈদেশিক অনুদান হিসেবে আসা ২০০ মিলিয়ন ডলারও ফেরত চেয়েছে বাংলাদেশ, যা সে সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা ছিল।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ঢাকায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে এ বিষয়গুলো উত্থাপন করা হয়েছে। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ ১৫ বছর পর বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক (এফওসি) অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিন এবং পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সে দেশের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ। বৈঠকে বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলোর দ্রুত সমাধান করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নেওয়ার লক্ষ্যে সব বিষয়ে আলোচনা হয়। দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ এ বৈঠক হয়েছিল ২০১০ সালে।
সংবাদ সম্মেলনে জসিম উদ্দিন জানান, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পাকিস্তানকে জানানো হয়েছে, এসব অমীমাংসিত বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তি হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ১৪টি জেলায় আটকে পড়া ৩ লাখ ২৪ হাজার পাকিস্তানি নাগরিককে ফেরত নেওয়ার বিষয়টিও তোলা হয় বৈঠকে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের মধ্যে ১ লাখ ২৬ হাজার ইতোমধ্যে দেশটিতে ফেরত গেছে এবং যারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে থাকতে চায় তাদেরও সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া, ন্যায্য হিস্যা পরিশোধ এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে আগামীতে আরও আলোচনা চালিয়ে যেতে চায় পাকিস্তান।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও লাভের দিকটি বিবেচনা করেই আগামীতে এগিয়ে যাবে। এ জন্য দুই দেশের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখাই আমাদের লক্ষ্য। অতীতের মতো আলোচনার পথ যাতে আর বন্ধ হয়ে না যায়, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, আলোচনায় সামরিক সহযোগিতা নিয়েও কথা হয়েছে। এ ধরনের সহযোগিতা নতুন নয়। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তারা পাকিস্তান সফরে যান এবং যৌথ সামরিক মহড়াও হয়। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, বিশেষ করে সরাসরি বিমান চলাচলের বিষয়টিও আলোচনায় ওঠে। শিগগিরই দুই দেশের মধ্যে ‘ফ্লাই জিন্নাহ’ এয়ারলাইনসের পরিচালনা শুরু হবে এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের আরেকটি এয়ারলাইনসও বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট অপারেট করতে চায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ইতোমধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রসচিব আরও বলেন, এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে ব্যবসা ও বাণিজ্যের ওপর। বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি, মৎস্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা করা হয়। দুই দেশের মধ্যে লেখক, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষাবিদসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদলের যাতায়াত বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আঞ্চলিক সংস্থা সার্ককে উজ্জীবিত করতে এবং ইসলামি দেশগুলোর সংগঠন ওআইসিতে উভয় দেশের সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিষয়েও বৈঠকে একমত হয় দুই দেশ। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে পাকিস্তানের সহায়তা কামনা করা হয়। তিনি বলেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দুই দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়।
এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রসচিব জানান, বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন বাংলাদেশ সফরের বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। তিনি আগামী ২৭ ও ২৮ এপ্রিল ঢাকা সফর করবেন। এ সময় দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে বালাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং পাকিস্তানের পক্ষ্যে নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
রবিউল হক/এমএ/