
প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ঈদ কাটাতে আজ সোমবার (২৪ মার্চ) থেকে বাড়ি ফিরবেন কর্মজীবী মানুষ। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তারা ছুটে যাবেন বাস, ট্রেন, লঞ্চ বা বিমানে। প্রতিবারের মতো এবারও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে দেশের পরিবহন খাত। ঈদুল ফিতরের আগে বাস ও রেলের টিকিটের কালোবাজারিতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। সড়কপথে নানা পয়েন্টে যানজট আর রেলযাত্রায় ভয়াবহ শিডিউল বিপর্যয়ের শঙ্কাও আছে। লঞ্চযাত্রায় যাত্রী কমতে থাকলেও সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন যাত্রীরা। আর শৌখিন মানুষের ঈদযাত্রায় বাধ সেধেছে বিমানের টিকিটের উচ্চমূল্য। তারপর সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি, ছিনতাই আর ডাকাতির শঙ্কা তো থাকছেই।
মহাসড়কে যানজটের ১৫৯ সম্ভাব্য স্পট চিহ্নিত
এবারের ঈদুল ফিতরে পাঁচটি মহাসড়কের ১৫৯টি স্পটে যানজট মাঝারি থেকে তীব্রতর হতে পারে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হক। যানজটের আশঙ্কায় এসব স্পটে বাড়তি নজর রাখতে পুলিশ ‘বিশেষ দৃষ্টি’ রাখবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের আছে ৪৯টি স্পট। ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে আছে ৫৪টি স্পট। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে আছে ছয়টি স্পট। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে আছে ৪২টি স্পট এবং ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কে আছে আটটি গুরুত্বপূর্ণ স্পট। এ ছাড়া জাতীয় মহাসড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ করিডরগুলোর সড়ক ঈদের সাতদিন আগেই মেরামত বা সংস্কার করতে বলা হয়েছে। এসব সড়কের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বাইপাস, নবীনগর-চন্দ্রা, ঢাকা-জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, ঢাকা-জয়দেবপুর, ভোগড়া-চন্দ্রা-এলেঙ্গা, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-বগুড়া-রংপুর, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-গোপালগঞ্জ-খুলনা, ভাঙ্গা-বরিশাল। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা সড়কগুলো সংস্কার করতে বলা হয়েছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানজটপ্রবণ কাঞ্চন ব্রিজ থেকে ভুলতা পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে সার্ভিস লেন নির্মাণের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। খুলে দেওয়া হয়েছে এলেঙ্গা-রংপুর ফোর লেন সড়ক। পদ্মাসেতুতে গাড়ির গতিসীমা বাড়িয়ে ৮০ কিলোমিটার করা হয়েছে।
এবার ঢাকা থেকে বিআরটিসির ৭৭৫টি বাস নানা রুটে যাবে। আর ঢাকার বাইরে চলাচল করবে ৪৭০টি বাস। গত ২০ মার্চ থেকে বিআরটিসির বাসের আগাম টিকিট বিক্রিও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে, এসব বাসের টিকিট নিতে যাত্রীদের আগ্রহ কম। কয়েকটি পোশাক কারখানা থেকে বিআরটিসির বাস রিজার্ভ করা হচ্ছে।
এদিকে বাসযাত্রীরা বিপাকে পড়েছেন টিকিট নিয়ে। কাঙ্ক্ষিত বাসের টিকিট পেতে বাড়তি ৫০০-৬০০ টাকা গুনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে থাকলেও খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে রাজধানীসহ সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ আন্তজেলা বাস টার্মিনালগুলোর সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাড়তি নজর রাখবে হাইওয়ে পুলিশ। প্রবাসীদের বাড়ি ফিরতে হলে পুলিশের সহযোগিতা নিতে বলা হয়েছে।
ঈদযাত্রায় ভোগান্তি শিডিউল বিপর্যয়
ঈদযাত্রা শুরু হতে না হতেই রেলে শিডিউল বিপর্যয় শুরু হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ লোকোমোটিভ আর রেক নিয়ে চলাচল করা ট্রেনগুলো দেশের নানা রেলরুটে লাইনচ্যুত হচ্ছে। এতে খোদ রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনেই শিডিউলে গড়বড় হচ্ছে। ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এবারের ঈদযাত্রায় মহাসংকটের নাম শিডিউল বিপর্যয়। তবে রেলওয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে। কোথাও কোনো ট্রেন লাইনচ্যুত হলে দ্রুত যেন উদ্ধার ট্রেন ঘটনাস্থলে যেতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ঈদযাত্রার সময় ট্রেনগুলোকে কোনো কোনো স্টেশনে একটু বেশি সময় দাঁড়াতে হয়। তাতে ট্রেনযাত্রায় সময় বাড়ে।’
ঈদে অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর জন্য ৪৪টি (পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ থেকে ২৮টি মিটারগেজ ও সৈয়দপুর ওয়ার্কশপ থেকে ৩৬টি ব্রডগেজ) যাত্রীবাহী কোচ সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর জন্য ১৯টি (মিটারগেজ ১৪টি ও ব্রডগেজ থেকে পাঁচটি) লোকোমোটিভ যাত্রীবাহী ট্রেন ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ঈদুল ফিতরে ঘরমুখো যাত্রার টিকিট কিনতে যাত্রীদের রেলসেবা অ্যাপ ও কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে বলেছিল রেলওয়ে। তবে যেসব যাত্রী রেলসেবা অ্যাপে টিকিট কাটতে পারেননি তাদের অনেকে টিকিট কালোবাজারিদের বিভিন্ন ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে যোগাযোগ করছেন। বহু মূল্যে টিকিট কিনলেও তারা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না তাদের টিকিট আসল নাকি নকল।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করা সব আন্তনগর ট্রেনের ডে-অফ (সাপ্তাহিক ছুটি) বাতিল করা হয়েছে। ২৭ মার্চ থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এসব ট্রেনের কোনো ডে-অফ থাকবে না।
আজ সোমবার থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত ঢাকাগামী একতা, দ্রুতযান, পঞ্চগড়, নীলসাগর, কুড়িগ্রাম, লালমনি, রংপুর, চিলাহাটি ও বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রাবিরতি থাকবে না। অন্যদিকে সুন্দরবন, মধুমতি, বেনাপোল, জাহানাবাদ, রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ও নকশীকাঁথা কমিউটার ট্রেন ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের শহরতলি প্ল্যাটফর্ম থেকে যাত্রা শুরু করবে।
যাত্রী কমলেও প্রস্তুত লঞ্চমালিকরা
সময়ের সঙ্গে লঞ্চযাত্রীদের সংখ্যা কমে গেলেও ঈদযাত্রার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন লঞ্চমালিকরা। তারা জানান, ঢাকা-বরিশাল রুটে ১৮টি লঞ্চের সবগুলো এখন চলাচল করবে। ঢাকা থেকে বরিশালগামী লঞ্চের ডেকের ভাড়া ৩০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং ডাবল কেবিনের ভাড়া ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু ঈদের সময় ডেকের ভাড়া ৪০০, সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার ২০০ ও ডাবল কেবিনের ভাড়া ২ হাজার ৪০০ টাকা। তবে যাত্রীদের আগ্রহ ধরে রাখতে ভাড়া না বাড়ানোর কথা বলছেন লঞ্চমালিক সমিতির নেতারা। বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, ‘ঈদযাত্রা সুন্দর ও বাধামুক্ত করতে আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করতে পারবে না। ঈদে যাত্রীদের সেবায় তদারকি আরও বাড়ানো হবে’। তিনি বলেন, ‘ঈদযাত্রায় নৌপথে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং ধারণক্ষমতার বাইরে যাত্রী বহনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়ীদের শুধু জরিমানাই নয়, লঞ্চের রুট পারমিট বাতিল করা হবে।’