
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নতুন বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করা। প্রতিকূল অবস্থা থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব। এই বাজেট গতানুগতিক হলেও কিছু সাহসী পদক্ষেপ রয়েছে।
মঙ্গলবার (৪ জুন) বিকেলে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
বাজেট ঘোষণার পর যেসব সমালোচনা এসেছে, সংবাদ সম্মেলনে সেগুলোর জবাব দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। বিশেষ করে কালোটাকা সাদা করা, পাচার করা টাকা ফেরত আনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈষম্য ইত্যাদি প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তার জবাব দেন তিনি। বলেন, সমালোচনা করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তা যেন গঠনমূলক হয়। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। তবে বেশির ভাগ প্রশ্নের জবাব দেন অন্য উপদেষ্টারা।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘গ্রামের মেঠো রাস্তা কিন্তু আস্তে আস্তে হাইওয়ে হয়। আমরা মেঠো রাস্তা পার হয়ে হাইওয়ের দিকে যাচ্ছি। সরু হাইওয়ে আস্তে আস্তে আরও প্রশস্ত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাজেট আরও ভালো হতো যদি সম্পদ আমরা আরও বেশি পেতাম। কর যদি আরও বেশি আদায় করতে পারতাম। ভ্যাট যদি সঠিকভাবে দিতাম, কর যদি ফাঁকি দেওয়া না হতো, তখন আমাদের বাজেটের জন্য সহায়তা লাগত না। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। আমাদের নিজেদের টাকা দিয়েই পুরো বাজেট করে ফেলতে পারতাম। বাজেটে তো কিছু সহায়তা লাগবেই। খালি চোখে দেখলে তো মনে হয় কিছুই নাই। আপনাদের একটু সহযোগিতা দরকার। সমালোচনা করুন গঠনমূলক।’
এর আগের দিন সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী পরদিন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
এ সময় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম, জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির, বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বক্তব্য রাখেন।
এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘বাজেটে টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অপ্রদর্শিত আয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যারা বৈধভাবে আয় করেন কিন্তু কোনো কারণে সেই আয় প্রদর্শন করা হয়নি, তাদের জন্য এই সুযোগ। ফ্ল্যাটে-জমিতে বেশি কর দিয়ে যে কেউ এ সুযোগ নিতে পারেন। এই বিধান আগেই বহাল ছিল। আমরা তা অব্যাহত রেখেছি। এখন বিষয়টি নিয়ে যখন কথা উঠেছে, তা বাতিল করা যায় কি না, আমরা ভেবে দেখব। আগামী বাজেট ছোট করা হয়েছে।’ এই বাজেট বাস্তবায়ন করা কঠিন নয় বলে মনে করেন অর্থ উপদেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনে টাকা সাদা করা নিয়ে ব্যাখ্যা দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, আগের সরকার ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দিয়ে গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তা বাতিল করেছে। তবে ফ্ল্যাটে নির্ধারিত কর দিয়ে টাকা সাদা করার বিধান আগে থেকে ছিল। নতুন বাজেটে বিদ্যমান বিধান বহাল রাখা হলেও কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। যেহেতু এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তারপরও সরকার চাইলে বাতিল করা যাবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেট একটি চলমান প্রক্রিয়া। চট করে বিপ্লবী বাজেট দেওয়া যায় না। অনেকেই সমালোচনা করে বলেছেন, বাজেট গতানুগতিক। কিছুটা গতানুগতিক বটে। তবে কিছু সাহসী পদক্ষেপও আছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এতদিন তো আপনারা প্রবৃদ্ধির গল্প শুনেছেন। প্রবৃদ্ধি হয়েছে অনেক বেশি। কিন্তু সেটার সুবিধা সবাই পাননি। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা মানুষের জীবনমানের যাতে উন্নয়ন হয়, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে চালিয়ে যেতে পারেন, সেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাজেট সাজিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে সংস্কারগুলো আমরা হাতে নিয়েছি সেটা চলমান। আমরা যতটুকু পারি করব। যে পদচিহ্ন রেখে যাব (ফুটপ্রিন্ট) আশা করছি, পরে যারা আসবেন তারা সেটা বাস্তবায়ন করবেন।’
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা কিছুই করিনি- এ অভিযোগ ঠিক নয়। ভালো-মন্দ দুই দিকই রয়েছে। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। সবার সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বাজেট দিয়েছি, যা বিশ্বের অন্য দেশের কাছে যেন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেছেন আমরা আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। বাজেট একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তবে একেবারেই যে নতুন কিছু (ইনোভেশন) নেই, তা ঠিক নয়। কিছু পদক্ষেপও আছে।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে বাজেট করিনি। আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন: মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাত, জ্বালানি খাত, রাজস্ব আদায়। এসব কিছুর মধ্যেই বাজেট করতে হয়েছে। তারপরও প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার বাড়েনি।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে কোনো পদক্ষেপে নেওয়া হয়নি কেন- এ প্রশ্নের জবাবে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা। সেটা করে ফেলেছি। বর্তমানে বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে। এটা আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। আমি মনে করি, এটি বড় অর্জন। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি একটু বেশি আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব দেশের বাজার পড়েছে। আশা করছি, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি আরও সহনীয় পর্যায় নেমে আসবে।’
মধ্যবিত্তের জন্য এই বাজেটে কিছু নেই কেন- এ প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে কর কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর সুফল সবাই পেয়েছেন। যখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়, লক্ষ্য থাকে সবাই যেন উপকৃত হন। আলুর দাম কমলে মধ্যবিত্তরাও এর সুফল পান। কাজেই মধ্যবিত্তরা কিছুই পাননি- এ কথা ঠিক নয়।’
পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনতে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পাচারের টাকা ফেরত আনা সহজ নয়। কোন দেশে কত টাকা পাচার হয়েছে, তা খুঁজে বের করে প্রমাণ করা কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি। সময় লাগবে।’
আপনার মতে বাজেটের খারাপ দিক কোনটি- একজন সাংবাদিক অর্থ উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘খারাপ দিক বলব না। তবে আরেকটু ভালো হতো যদি বেশি অর্থ (সম্পদ) পেতাম। পাচারের টাকা হাতে পেলে বাজেটে সাপোর্ট হিসেবে কাজে লাগানো যেত।’ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। সেই অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।’
পরিকল্পনা উপদেষ্টা যা বললেন: প্রস্তাবিত বাজেটকে বাস্তবমুখী ও মিতব্যয়িতার বাজেট বলে অভিহিত করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেছেন, ‘এই বাজেট বাস্তবসম্মত। আশা করছি, এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধের দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, নতুন বাজেট গতানুগতিক। এতে কোনো চমক নেই।’ সমালোচকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা
উপদেষ্টা বলেন, ‘বুঝতে হবে বাজেট একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি শূন্য থেকে শুরু হয় না। একটা জায়গায় থাকে। তা থেকে পরিবর্তন করতে হয়।’ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তারা বড় এডিপি করেছে। তাতে বেশির ভাগ প্রকল্প রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অনেক প্রকল্প নেওয়া হলেও সেগুলোতে অর্থায়ন নিশ্চিত করা হয়নি। তারা জঞ্জাল রেখে গেছে। আমরা তা পরিষ্কার করছি।’
তিনি বলেন, ‘২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে খুবই কম। মাত্র ২০ থেকে ৩০টি। বাকি সব চলমান প্রকল্প। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা শুধু আগের সরকারের নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি।’ তিনি বলেন, চলমান অনেক বড় প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু মাঝপথে এসে ওই সব প্রকল্প বন্ধ করা যায় না। কারণ এরই মধ্যে ওই সব প্রকল্পে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে তা চলমান রাখতে হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু মেগা প্রকল্পে বাস্তবায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে। ওই সব প্রকল্প অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটকে জনবান্ধব বাজেট বলে মনে করেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির। তিনি বলেন, এই বাজেটে অপচয় ও অসংগতি কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
নতুন বাজেট জাতীয় সক্ষমতা বাড়াবে বলে মত দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। এই বাজেটে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নতুন বাজেটে কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে মত দেন অর্থসচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদার।