
অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ এবং পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাবে দেশে ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে। তবে সে অনুযায়ী নেই সচেতনতামূলক কার্যক্রম। চলতি বছরেই একাধিক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে দেশের বিভিন্ন এলাকা। কম মাত্রার একাধিক ভূমিকম্পের পর আসতে পারে বড় মাত্রার ভূমিকম্প- এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এখনই উদ্যোগ না নিলে আগামীতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে পারে রাজধানী ঢাকা। এমন বাস্তবতায় আজ ১২ জুন দেশে পালন করা হচ্ছে জাতীয় ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের সাবেক ডিন এবং ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি অনেকভাবে করা যায়। চারটা পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রিপেয়ারডনেস, মিটিগেশন, রেসপন্স এবং রিকভারি। রেসপন্স আর রিকভারি হলো ভূমিকম্পের পরে। বাকি দুটি ভূমিকম্পের আগে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন প্রিপেয়ারডনেস এবং মিটিগেশনের পর্যায়ে আছি। মিটিগেশন করা যায় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করে। আমাদের দেশে যে লেভেলে ভূমিকম্প হতে পারে, যদি আমরা ভবন নির্মাণে কোড মেনে চলি তাহলে ক্ষতি অনেক কম হবে। প্রিপেয়ারডনেস হলো প্রস্তুতি। আমাদের রেসপন্ডিং (উদ্ধারকারী) সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের জনগণকে সচেতন করতে হবে। স্কুল লেভেলে ভূমিকম্প সচেতনতামূলক অনেক কার্যক্রম করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে তা করা হয় না। বিদেশের সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব করা হয়।’
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১১ এপ্রিল এবং ২৮ মে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এগুলোর মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ১, ৫ দশমিক ১, ৪ এবং ৫ দশমিক ২। এর বাইরে জানুয়ারিতে আরও তিনটি ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার তথ্য রয়েছে। ২০২৪ এবং ২০২৩ সালেও একই মাত্রার (হালকা থেকে মাঝারি ধরনের) একাধিক ভূমিকম্প দেশে অনুভূত হয়। এতে ক্ষয়ক্ষতি না হলেও অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ভবন থেকে লাফ দিয়ে আহত হন। অনেক পুরোনো ভবনে ফাটল দেখা দেয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প হওয়া স্বাভাবিক। পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার, ভারত ও নেপালও বড় মাত্রার ভূমিম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। তাই অনেক বেশি সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ রাজধানী ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। অধিকাংশ ভবন গড়ে উঠেছে ভবন কোড না মেনে। ফলে ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানি বেশি হবে। ভবন ভূমিকম্প সহনশীল না হওয়ায় ঝুঁকি বেশি, অন্যথায় ঝুঁকি কম থাকত। জাপান, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ভূমিকম্পের মাত্রা অনেক বেশি। কিন্তু তাদের অবকাঠামো অনেক শক্তিশালী। এ জন্য তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয় অনেক কম।
ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর বিষয়ে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘একটা প্রজ্ঞাপন দিয়েই আমাদের স্কুলে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেওয়া যায়। জনগণকে সচেতন করার জন্য লিফলেট, গণমাধ্যমে এসব নিয়ে ডকুমেন্টরি করা দরকার। সমন্বিতভাবে এসব করতে হবে। অন্যথায় কোনো আউটপুট আসবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল নয়। এ জন্য ঝুঁকিটা বেশি। বিল্ডিং যদি ভালো ভিত্তির ওপর করতে পারি তাহলে ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। এ জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। বিল্ডিং কোড মানতে হবে।’
১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছাকাছি মানিকগঞ্জে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই মাত্রার ভূমিকম্প হলে দুর্বল বিল্ডিংগুলো ভেঙে পড়বে। নতুন বিল্ডিংগুলো ভেঙে না পড়লেও ব্যাপক ড্যামেজ (ক্ষতি) হবে।
প্রসঙ্গত, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ভয়ংকর ভূমিকম্প হয়েছিল, যা ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এটির কেন্দ্র ছিল আসামে এবং রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১। তাই ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস হিসেবে এই দিনটিকে ঠিক করা হয়।