জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে বুধবার (১৬ জুলাই) সকাল থেকে দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলিতে গোটা গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এনসিপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। সংঘর্ষের ঘটনায় যুবলীগ সদস্যসহ চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সাংবাদিক, পুলিশসহ প্রায় ১০০ জন। গুলিবিদ্ধ সুমন বিশ্বাস (২০) নামে এক যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। হামলায় যমুনা টিভির স্টাফ রিপোর্টার মোজাম্মেল হোসেন মুন্না, স্টার নিউজের ফয়সাল আহমেদ ও ডিবিসি নিউজের সাংবাদিক সুব্রত সাহা আহত হন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। দুপুরে স্থানীয় প্রশাসন গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করে। পরে রাত ৮টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। বর্তমানে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
নিহতরা হলেন জেলা শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে যুবলীগ সদস্য দীপ্ত সাহা (২৫), শহরের থানাপাড়ার কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (২৪), সদর উপজেলার আড়পাড়া এলাকার আজাদ তালুকদারের ছেলে ইমন তালুকদার (১৮) ও টুঙ্গিপাড়ার ইদ্রিস মোল্যা। এরা সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন বলে গোপালগঞ্জ আড়াই শ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. শেখ মো. নাবিল জানিয়েছেন।
এদিকে এনসিপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ ছাড়া বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, এনসিপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনা মানবাধিকারের ‘লজ্জাজনক লঙ্ঘন’। এ জঘন্য হামলায় জড়িত কেউই শাস্তির বাইরে থাকবে না। অন্যদিকে, গতকাল রাতে খুলনায় সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন।
গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে গত মঙ্গলবার থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গতকাল গোপালগঞ্জে এনসিপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ‘জুলাই পদযাত্রা’ শুরুর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার উলপুর-দুর্গাপুর সড়কের খাটিয়াগড় চরপাড়ায় পুলিশের গাড়িতে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন।
আহতরা হলেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (আইসি) আহমেদ বিশ্বাস, কনস্টেবল কাওছার ও মিনহাজ। আহতদের গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সদর উপজেলার কংশুরে ইউএনওর গাড়িতে হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় তার গাড়ির চালক আহত হন। ইউএনও এম রাকিবুল হাসান বলেন, ‘এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়িতে হামলার অপ্রীতিকর ঘটনা জানার পর ওই এলাকা পরিদর্শনে যাই। সেখান থেকে ফেরার পথে কংশুরে পৌঁছালে একদল লোক আমাদের গাড়িতে হামলা চালায়। এতে গাড়ির চালক মোহাম্মদ হামিম আহত হন।’
বেলা দেড়টার দিকে একদল লোক (এনসিপির ভাষায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা) মিছিল করে এসে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক এলাকায় এনসিপির সমাবেশ মঞ্চে হামলা করেন। তারা সাউন্ড সিস্টেম, মাইক ও চেয়ার ভাঙচুরের পাশাপাশি স্থানীয় এনসিপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালান। এ সময় মঞ্চের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে দ্রুত আদালত চত্বরে ঢুকে পড়েন। একই সময় মঞ্চে ও মঞ্চের সামনে থাকা এনসিপির নেতা-কর্মীরাও দৌড়ে সরে যান। একপর্যায়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় এনসিপির নেতা-কর্মীরা এক হয়ে পুলিশসহ ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যান।
পরে বেলা ২টা ৫ মিনিটে সমাবেশস্থলে পৌঁছান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। এরপর সমাবেশ শুরু হয়।
বেলা পৌনে ৩টার দিকে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে এনসিপির নেতারা পুলিশি নিরাপত্তায় টেকেরহাট হয়ে মাদারীপুর যাওয়ার পথে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে হামলার শিকার হন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মুহুর্মুহু রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছোড়েন। মুহূর্তের মধ্যে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ওই এলাকা। সংঘর্ষ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ জেলা কারাগারে হামলা করে। তারা কারাগারের প্রধান ফটক ভাঙার চেষ্টা করেন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রতিহত করেন। এ সময় এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে এনসিপির নেতা-কর্মীদের একত্রিত করে সেনা পাহারায় বাগেরহাটের প্রবেশদ্বার মোল্লারহাট সেতু পার করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।
এদিকে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেছেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য জেলাজুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বুধবার রাত ৮টা থেকে পরের দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’
[এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন খবরের কাগজের ফরিদপুর, মাদারীপুর, বাগেরহাট ও রাজবাড়ীর প্রতিনিধিরা]