গত বছরের ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি দায়ী - এমন অভিযোগ উঠেছে একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে, যেটি বিবিসি আই (BBC Eye) ও বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি বিভাগ যাচাই করেছে।
এই অডিওটি গত মার্চে অনলাইনে ফাঁস হয়। তাতে হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি তার নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের’ অনুমতি দিয়েছেন এবং বলেন- ‘তাদের যেখানে পাবে, সেখানেই গুলি করবে।’
বাংলাদেশের সরকারি কৌঁসুলিরা এই রেকর্ডিংটিকে হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।
জাতিসংঘের তদন্তকারীদের মতে, এই সহিংসতায় প্রায় এক হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন।
তবে ভারত পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ও তার দল এই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
আওয়ামী লীগের এক মুখপাত্র দাবি করেছেন, অডিওটিতে কোনো ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ বা ‘বাড়তি বল প্রয়োগের’ প্রমাণ নেই।
অজ্ঞাত এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে হাসিনার কথোপকথনের ফাঁস হওয়া এই অডিও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ যে, তিনিই সরাসরি সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর অনুমোদন দিয়েছেন।
এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সন্তানদের জন্য সরকারি চাকরির কোটা বাতিলের দাবিতে। পরে এটি একটি গণআন্দোলনে রূপ নেয়। যার ফলে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। এটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা।
সবচেয়ে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটে ৫ আগস্ট - যেদিন হাসিনা হেলিকপ্টারে পালিয়ে যান, আর বিক্ষোভকারীরা ঢাকায় তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়েন।
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের তদন্তে ঢাকার এক বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে গণহত্যার আগে অজানা অনেক তথ্য পাওয়া গেছে - এবং নিহতের সংখ্যা ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।
১৮ জুলাই এই ফোন কলের সময় শেখ হাসিনা গণভবনে অবস্থান করছিলেন বলে একটি সূত্র বিবিসিকে জানায়।
এই সময়টিতে আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পুলিশের গুলিতে নিহত বিক্ষোভকারীদের ভিডিও ঘিরে তৈরি জনরোষের জবাব দিচ্ছিলেন। ফোন কলের পরদিনই সামরিক মানের অস্ত্র ঢাকায় মোতায়েন ও ব্যবহার করা হয় - এমনটি পুলিশের নথিপত্র থেকে বিবিসি নিশ্চিত করেছে।
এই অডিও রেকর্ডটি জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) কর্তৃক রেকর্ড করা ফোনকলগুলোর একটি, যারা সরকারিভাবে যোগাযোগ পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে।
অডিওটি কে ফাঁস করেছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। আন্দোলনের পর থেকে শেখ হাসিনার অনেক ফোনকলের ক্লিপ অনলাইনে ছড়িয়েছে, তবে অনেকগুলো যাচাই হয়নি।
১৮ জুলাইয়ের কলটি বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) শেখ হাসিনার পরিচিত কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত করেছে।
বিবিসি স্বাধীনভাবে এই অডিওর সত্যতা যাচাই করেছে ব্রিটিশ অডিও ফরেনসিক প্রতিষ্ঠান ইয়ারশটের (Earshot) মাধ্যমে। তারা নিশ্চিত করেছে অডিওটি এডিট বা বিকৃত করা হয়নি। তাছাড়া এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ‘অত্যন্ত কম’।
ইয়ারশট জানায়, কলটি সম্ভবত কোনো কক্ষে স্পিকারে বাজিয়ে রেকর্ড করা হয়, কারণ অডিওতে ফোনের ফ্রিকোয়েন্সি এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে শব্দ রয়েছে। অডিওটিতে ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি শনাক্ত করা গেছে, যা প্রমাণ করে রেকর্ডিংটি আসল এবং বিকৃত করা হয়নি।
তারা শেখ হাসিনার কথা বলার ছন্দ, স্বর এবং নিঃশ্বাসের শব্দ বিশ্লেষণ করে বলেছে, অডিওটিতে কৃত্রিমতা বা কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টোবি ক্যাডম্যান, যিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পরামর্শ দিচ্ছেন, তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এই রেকর্ডিংগুলো তার ভূমিকা প্রমাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো পরিষ্কার, সঠিকভাবে যাচাই করা হয়েছে এবং অন্যান্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত।’
আওয়ামী লীগের এক মুখপাত্র বলেন, ‘বিবিসি যে রেকর্ডিংয়ের কথা বলছে, তা আসল কি না তা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।’
শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক সরকার ও পুলিশের বহু কর্মকর্তাকে বিক্ষোভ দমনে দায়ী করা হয়েছে। মোট ২০৩ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৩ জন কারাগারে রয়েছেন।
বিবিসি আই ৩৬ দিনের বিক্ষোভে পুলিশের হামলা-সংক্রান্ত শত শত ভিডিও, ছবি ও নথি বিশ্লেষণ করেছে। তদন্তে দেখা যায়, ৫ আগস্ট ঢাকার ব্যস্ত এলাকা যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ৫২ জন নিহত হন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ পুলিশি সহিংসতা। সে সময় প্রাথমিক প্রতিবেদনে মৃতের সংখ্যা ৩০ বলা হয়েছিল।
বিবিসির অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড শুরু এবং শেষ হয়। ভিডিও, সিসিটিভি ও ড্রোন ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেনাবাহিনী যে স্থান বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে আলাদা রেখেছিল, সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরপরই পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে পুলিশ দৌড়ে পালাতে থাকা বিক্ষোভকারীদের গুলি করে। পরে পুলিশ সদস্যরাই নিকটবর্তী সেনা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ওইদিন রাতে বিক্ষোভকারীরা যাত্রাবাড়ী থানায় আগুন দিলে ছয় পুলিশ সদস্য নিহত হন।
বাংলাদেশ পুলিশের এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, ‘গত বছরের জুলাই ও আগস্টের সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিছু দুঃখজনক ঘটনায় তৎকালীন পুলিশের কিছু সদস্য অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত চালাচ্ছে।’
গত মাসে শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যার নির্দেশ, সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে সহিংসতা, উসকানি, ষড়যন্ত্র ও গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত এখনো হাসিনার প্রত্যর্পণে রাজি হয়নি। হাসিনা দেশে ফিরে বিচারে অংশ নেবেন না বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ দাবি করে, দলীয় নেতারা এই সহিংসতার জন্য দায়ী নন।
দলের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘দলের কোনো শীর্ষ নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন এই অভিযোগ আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তগুলো ছিল অনুপাতিক, সদ্বিচারে গৃহীত এবং প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যেই নেওয়া।’
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কর্মকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে - তবে আওয়ামী লীগ এই তদন্তের ফলাফলও প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিবিসি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কাছে মন্তব্যের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল, তবে কোনো উত্তর পায়নি।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। এই সরকার এখন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগকে এই নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। - সূত্র: বিবিসি
অমিয়/