
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মধ্যপ্রাচ্যের চলমান পরিস্থিতিতে শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েল-হামাস সংঘর্ষে ব্রাজিল মানবিক বিরতির আহ্বান জানালেও তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় নিরাপত্তা পরিষদ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের শক্তিশালী দুই সদস্য দেশ চীন ও ফ্রান্সসহ ১২টি সদস্য দেশ মানবিক বিরতির প্রস্তাবকে সমর্থন করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ভেটো দেয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড বলেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরায়েল সফরের মানেই হলো, নিরাপত্তা পরিষদকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিতেই চলতে হবে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ও ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা বলেন, ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যে সংকট নিয়ে ২০১৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ কোনো প্রস্তাব পাস করতে পারেনি। তা ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও নিরাপত্তা পরিষদ নীরব। চলমান দুটি বিপজ্জনক সংঘাতে চরম মানবিক বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
শুরুতেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাজের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্থায়ী পাঁচ সদস্যের ভেটো। বিশেষ করে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় মস্কো ঘন ঘন ভেটো (মোট ১৫২ বার) দেয়। কারণ, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিল এবং তার প্রভাবেই পরিষদের অনেক কাজ ব্যাহত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ৮৮ বার ভেটো দিয়েছে। বর্তমান সংকটের আগে তার শেষ ভেটো ছিল ২০২০ সালে। আমেরিকা বেশির ভাগ সময়ই ইসরায়েল এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে ভেটো দিয়েছে। চীন তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়ে বেশি সতর্ক, তারপরও ১৯ বার দিয়েছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বড় শক্তির প্রভাব নতুন কিছু নয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই সব বোঝা যায়। যখন বড় শক্তির দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে, তখন নিরাপত্তা পরিষদ নীরব থাকে। বিশ্ব সংকট ও দ্বন্দ্ব নিরসনে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো ভূমিকা পালন করে না। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা পরিষদ সবচেয়ে বেশি সহযোগিতামূলক কাজ করেছে। কারণ, তখন শক্তিশালী দেশগুলোর প্রতিযোগিতা কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলছে। জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। জাতিসংঘ প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, যদি নিরাপত্তা পরিষদ স্থায়ী সদস্যদের ঐকমত্যের অভাবে বিশ্বশান্তি হুমকির সম্মুখীন হয় এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তাহলে সাধারণ পরিষদ শান্তি ভঙ্গ বা আগ্রাসনের পরিপেক্ষিতে অতিদ্রুত বিষয়টি বিবেচনা করতে সদস্যদের কাছে সমষ্টিগত পদক্ষেপের জন্য সুপারিশ করে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
এক সম্মেলনে ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সামনেই নিরাপত্তা পরিষদ হতাশা প্রকাশ করে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংকট উত্তোরণে হতাশা প্রকাশ করায় নিরাপত্তা পরিষদ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি মাউরো ভিয়েরা বলেন, জাতিসংঘের সুনামের অনেকটাই নির্ভর করে চলমান সংকট মোকাবিলার পদ্ধতির ওপর। তিনি বাধামূলক কৌশল সম্পর্কে অভিযোগ করেন, যা নিরাপত্তা পরিষদকে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যাহত করছে। তিনি আরও বলেন, এই পরিষদকে অবশ্যই সামনের বাধাগুলো মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং সংঘাতের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা দোষী সাব্যস্ত হব। অবশ্যই এই চলমান সংকট নিরসনে আমাদের বহু পথ খুঁজে বের করতে হবে।
এমনকি রাশিয়ার ইউক্রেন অবরোধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা মধ্যপ্রাচ্যে অবরোধে নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকা নিয়ে অনেক কটু কথা হচ্ছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব পালনে এমন অবহেলা দেখে দুঃখ প্রকাশ করেন। ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল-মালকি নিরাপত্তা পরিষদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার সমালোচনা করেন এবং তা অমার্জনীয় বলে অভিহিত করেন। ইসরায়েলের পক্ষে সহানুভূতি দেখানোর জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের প্রতিও তিনি গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
জাতিসংঘের সনদ সব সময় সার্বভৌম সমতার কথা বলে। এই সংস্থার সব সদস্য একই অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কথা ওঠে, তখন বোঝা যায়; কোনো একক সদস্য রাষ্ট্রের ক্ষমতা বাকি সব রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। ভেটো প্রদান করলে বিশ্বে কখনো শান্তি ও নিরাপত্তা আসবে না। বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সবাইকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কূটনীতিক; যিনি বর্তমানে জাতিসংঘে লেবাননের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল