বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে পিছিয়ে পড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন এবং হোয়াইট হাউসে আসার প্রথম মাসগুলোতেই যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাপী এক মহাসংকটে ফেলে দিয়েছে। এমনকি এটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুও চিহ্নিত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কর্তৃত্ববাদী পরিবর্তন অনুমানযোগ্য নয়। এর জন্য অনেকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে দোষারোপ করছেন। কারণ তারা আমেরিকার জনগণ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন।
অনেক বিশ্লেষক দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের মূল কারণ হিসেবে জাতি, গর্ভপাত অথবা তথাকথিত ‘জাগ্রত মতাদর্শ’-এর মতো সাংস্কৃতিক কারণগুলোকে নির্দেশ করেছেন। অন্যরা যুক্তি দেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তার নাগরিকদের অংশগ্রহণ হারিয়ে ফেলছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক নীতি কেবল ধনীদের স্বার্থে কাজ করছে।
যদিও এসবের পেছনে সত্য ঘটনা রয়েছে। তবুও এগুলো মূলত বিশ্বাসযোগ্য পথের চাইতে ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের লক্ষণগুলো প্রকাশ করে। আমেরিকান গণতন্ত্র কেন তার নাগরিক কণ্ঠস্বর হারাচ্ছে? রাজনীতিবিদরা কেন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গ করেন? কেন অর্থনৈতিক নীতি ধনীদের স্বার্থে কাজ করে এবং অন্যদের নয়? যদি আমরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি, তাহলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা সুসংগত রোডম্যাপ তৈরি করতে পারব না।
গণতন্ত্রের পতনের পেছনে দুটি শক্তি কাজ করেছে। প্রথমটি হলো তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিপ্লব; যা ১৯৭০-এর দশকে অর্থনীতিকে নতুন রূপ দিতে শুরু করে। দ্বিতীয়টি হলো ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের প্রশাসন কর্তৃক প্রবর্তিত মুক্তবাজার নীতির এজেন্ডা। ২০২০ সাল পর্যন্ত রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক প্রশাসন উভয়ই এ এজেন্ডাকে সমর্থন করেছিল; যা ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’-এর ব্যানারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল।
এই দুটি শক্তির সমন্বয়ে সম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা খুব কম সংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি প্রথমবার নয়। যদিও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের পূর্ববর্তী পর্যায়গুলোতে যথেষ্ট সুবিধা ছিল। শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের গতিশীলতা আনতে সক্ষম করেছিল যা, গত চার দশক থেকে ভিন্ন ছিল। এ সময়ে, প্রযুক্তি এবং নীতি বিশেষ করে অল্প শিক্ষিত কর্মী যারা মার্কিন শ্রমশক্তির ৬২ শতাংশে তাদের চাকরির জন্য বিপজ্জনক ছিল।
যেহেতু অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি গণতন্ত্রের পতনকে ব্যাখ্যা করে। তাই এ প্রবণতাকে রোধ করতে জননীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম কয়েক মাসেই বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও অনির্বাচিত ব্যক্তি যিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পাশে আনন্দে মেতে থাকেন, যা দৃষ্টিকটু।
সবাই জানেন, মার্কিন অর্থনীতি বিশাল ব্যক্তিগত সম্পদ তৈরি করেছে। কিন্তু এটি কীভাবে তৈরি হয়েছে? আমার ২০২৩ সালের বই, ‘দ্য মার্কেট পাওয়ার অব টেকনোলজি: আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য সেকেন্ড গিল্ডেড এজ’-এ আমি দেখাই কীভাবে উদ্ভাবন ও নতুন প্রযুক্তি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম উৎস। বাজারের ক্ষমতা কীভাবে বৃদ্ধি করে। একটি ফার্মের পণ্য উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি দাম নেওয়ার ক্ষমতা, ফলে একচেটিয়া মুনাফা হয়, তা দেখিয়েছি।
আমার বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতিতে উদ্ভাবকদের প্রথমদিকে বাজার ক্ষমতা প্রদান করা অর্থনীতির অন্যতম স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় জয়ী উদ্ভাবকরা তাদের প্রাথমিক সাফল্যকে আটকে রাখতে এবং তাদের বাজার ক্ষমতা তৈরি করতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করতে পারেন।
একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিশ্বাস নীতি থেকে অব্যাহতি দেওয়া বাজার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ অব্যাহতি অবিশ্বাস এবং বিশেষ সুবিধা আইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব রোধ করতে পারবে। প্রযুক্তি হলো বেশির ভাগ একচেটিয়া ক্ষমতার উৎস। একচেটিয়া মুনাফা অর্জন হলো বেশির ভাগ ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সিলিকন ভ্যালির ‘ব্যাঘাত’ সম্পর্কে ক্রমাগত আলোচনার বিপরীতে প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা বাজারের ক্ষমতাকে দূর করে না। গবেষণায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়- প্রযুক্তিগত একচেটিয়া বাজার বিভাজনকে রক্ষা করবে এবং এটি খুব কমই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। প্রতিযোগিতার পরিবর্তে প্রযুক্তিভিত্তিক সংস্থাগুলো প্রায়শই যৌথ প্রকল্পগুলো অনুসরণ করে। ছোট সংস্থাগুলোকে গবেষণা ও উন্নয়নে সহযোগিতা করে, যা সফল হলে অধিগ্রহণ করা হয়।
প্রায় প্রতিটি সিলিকন ভ্যালি তাদের সূচনালগ্ন থেকেই তাদের নতুন ধারণাকে কিছুটা উন্নত করার পরিকল্পনা করে। তার পর একটি শীর্ষস্থানীয় সংস্থা কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। এ সত্যটি প্রতিফলিত করে যে, মূল্যের যোগসাজশ অবৈধ হলেও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা অবৈধ নয়। উন্মুক্ত এআই-এর কথাই বলা যায়। এটির সফটওয়্যার নেতৃত্বদানকারী মাইক্রোসফটের প্রতিযোগী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রতিযোগিতা করার পরিবর্তে, ওপেনএআই মাইক্রোসফট থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে। অনেক বড় সংস্থার অংশীদার হয়ে উঠেছে। সব তরুণ এআই সংস্থাগুলোতে একই কাজ করছে।
আমাদের গণতন্ত্র অথবা মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতি থাকতে পারে। কিন্তু দুটোই আমাদের থাকতে পারে না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দুটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য অর্জন করা প্রয়োজন। প্রথমত, ব্যক্তিগত ক্ষমতা দমন করা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অভিজাততন্ত্রে পরিণত করেছে। দ্বিতীয়ত, উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো আরও সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া নিশ্চিত করা, যাতে কোনো গোষ্ঠী পিছিয়ে না পড়ে।
বাজারের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য কাম্য নয়। নীতিগত সংস্কার এটিকে বিপরীত করতে পারে। অবিশ্বাসের নীতি এবং প্রয়োগ বড় সংস্থাগুলোকে ছোট সংস্থাগুলো অধিগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারে। অবিশ্বাস এবং করের সংমিশ্রণ বাজারের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
নীতিনির্ধারকদের ইউনিয়ন গঠনের ওপর আইনি বিধিনিষেধ দূর করা উচিত। পাশাপাশি দুর্নীতি রোধে ইউনিয়নগুলোর আর্থিক হিসাব এবং শাসনব্যবস্থার কঠোর পাবলিক অডিট বাধ্যতামূলক করা উচিত। যেহেতু ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের সংস্থাকে শক্তিশালী করে এবং বাজারে ক্ষমতার ভারসাম্য উন্নত করতে সহায়তা করে। তাই তারা কাউকে পেছনে না রেখে দ্বিতীয় নীতিগত লক্ষ্যকেও এগিয়ে নিয়ে যায়।
এটি আমাদের গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধারের দ্বিতীয় উপাদানে নিয়ে আসে: প্রযুক্তি এবং প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো আরও সমান ভাগাভাগি। এর অর্থ হলো আমেরিকার উদ্ভাবন এবং প্রবৃদ্ধির জন্য নতুন নীতিগত পদ্ধতির প্রয়োজন। প্রচলিত মুক্তবাজার পদ্ধতি এ ধরনের কাজকে উৎসাহিত করছে। নীতিনির্ধারকদের নিশ্চিত করা উচিত, বিজয়ীরা তাদের কিছু লাভ ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে ভাগ করে নেবে।
সহজে ব্যবহারযোগ্য ও রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-ভিত্তিক পণ্য এবং পরিষেবা উদ্ভাবনের প্রচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভর্তুকি চালু করা উচিত। এতে আরও উন্নত প্রযুক্তিগত কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যার জন্য উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হবে না। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা-উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে কম শিক্ষিত কর্মীদের ভালো চাকরির সম্ভাবনা বাড়াবে। এর জন্য ট্রেড স্কুল, কমিউনিটি কলেজ এবং শিক্ষানবিশ কর্মসূচিতে আরও বিনিয়োগ দরকার।
শ্রম ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান এবং প্রত্যাশিত প্রযুক্তির জটিলতার কারণে সহযোগিতা আরও গঠনমূলক হতে হবে। কর-অর্থায়নকৃত জীবিকা পুনরুদ্ধার-নীতি কার্যকর হলে সংস্থাগুলো তাদের প্রযুক্তি এবং শ্রমশক্তি সমন্বয় করার জন্য আরও বেশি স্বাধীনতা পাবে। এ অর্থনৈতিক নমনীয়তা শেষ পর্যন্ত নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিক উভয়কেই উপকৃত করবে।
ট্রাম্পের নির্লজ্জ আইন বহির্ভূতকাজ আমেরিকানদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলে দিচ্ছে। কারণ অভিজাততন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রে তার নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করছে। আমরা যদি একটি ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক সমাজ চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই ব্যক্তিগত ক্ষমতা এবং একচেটিয়া মুনাফা মোকাবিলা করতে হবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে এমন একটি জোটকে ক্ষমতায় আনতে অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠছে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ক্ষমতায় আনা শ্রমিকদের জীবন উন্নত করতে চায় না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্র। প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত
অনুবাদ: সানজিদ সকাল