ঢাকা ৩০ কার্তিক ১৪৩১, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

সোচ্চার হতে হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৪, ০১:২১ পিএম
সোচ্চার হতে হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে
ড. মাহবুবা নাসরীন। ছবি : সংগৃহীত

কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো সেভাবে দায়ী নয়। এখন আমাদের সোচ্চার হতে হবে উন্নত দেশগুলো যেন কার্বন নিঃসরণ কমায়। পাশাপাশি আমরা নিজেরা অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ-শিল্পায়ন করছি। এতে সবুজের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলছি। ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত উত্তোলন করছি। এগুলো আমরা নিজেরা রোধ করতে পারি এবং দূষণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি। 

শিল্পোন্নত দেশগুলো যেন দূষণের পরিমাণ কমিয়ে আনে, কার্বন নিঃসরণ করলেও সেটি যেন জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ভূমিকা না রাখে, সে জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশের যেন ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ফোরামে কথা বলতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশকেও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক মোকাবিলায় পলিসি গ্রহণ করতে হবে।

উপ-উপাচার্য, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ

সুস্বাস্থ্যই হোক সবার অঙ্গীকার

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩০ এএম
সুস্বাস্থ্যই হোক সবার অঙ্গীকার
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

নীরব ঘাতক স্বভাবের যে রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক, সেই ডায়াবেটিস রোগের অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে যথাসচেতন করে তুলতেই আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে ফ্রেডারিক ব্যান্টিং (১৮৯১-১৯৪১) এবং চার্লস বেস্ট (১৮৯৯-১৯৭৮) কর্তৃক ইনসুলিন আবিষ্কার এক যুগান্তকারী অগ্রগতি। এ জন্য ব্যান্টিং চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯২৩ সালে। ১৪ নভেম্বর ফ্রেডারিক ব্যান্টিংয়ের জন্মদিবসকেই তার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনার্থে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে গৃহীত হয়েছে। 

বিশ শতকের শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধিনিচয়ের নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটিবসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি নির্মূলে সক্ষম হলেও মানুষের সুন্দর, সাবলীল জীবনযাপনের পথে নীরবে তার সর্বকর্মক্ষমতা হরণকারী অসংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিসচেতনতাসহ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা যথা মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আসছে না বলে প্রতীয়মান হয়। 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ২০০৬ সালে জাতিসংঘকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির আহ্বানে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে এবং যৌক্তিকতার প্রচার-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২০০৭ সালেই জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের ব্লু সার্কেল লোগোটিও নির্বাচিত হয়। নীল বৃত্ত জীবন ও স্বাস্থ্যের ধনাত্মক প্রতীক, নীলাকাশ সব জাতিনিচয়কে সংঘবদ্ধ করেছে এবং এ কারণে জাতিসংঘের পতাকার রংও নীল। নীল বৃত্ত বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ ও জয়ে ঐকবদ্ধ প্রয়াসের প্রতীক। 

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মহামারি আকারে ধেয়ে আসা অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২০-২৫-তে ডায়াবেটিস রোগের বিস্তার রোধে উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো ১৪ নভেম্বর সাড়ম্বরে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উদযাপনে ২০২৪ প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘সুস্বাস্থ্যই হোক আমাদের অঙ্গীকার’।

পরিবেশের প্রভাব থেকে ডায়াবেটিসের বিস্তার প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় উঠে এসেছে। ২০২৪-এর ১৪ নভেম্বর এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের আহ্বান awareness activities aim to keep diabetes firmly in the public spotlight and promote the importance of coordinated and concerted action to tackle the impact of the condition. ‘ডায়াবেটিস রোখো’- এই গুঞ্জন, এই প্রয়াস সর্বত্র। 

ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ভাষায়- 3D (Diet, Discipline and Drug) অর্থাৎ খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়মশৃঙ্খলাই ডায়াবেটিক রোগীর জীবনকাঠি। 

ডায়াবেটিক রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্যনিয়ন্ত্রণ ও নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ও আত্মসচেতনতা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদেরও শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলে এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করে তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ২০০০ সালে ভিত্তি বছরে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১৭ কোটি (বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৩ ভাগ) ছিল, তাদের আশঙ্কা ২০৩০ সালে সে সংখ্যা দ্বিগুণে বেশি হয়ে যাবে। প্রাদুর্ভাব ও বিস্তারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে টাইপ-২ অর্থাৎ ইনসুলিন-নিরপেক্ষ রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি (১৮০ শতাংশ), এরপর আফ্রিকা মহাদেশে (১৬০ শতাংশ), দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (১৫৫ শতাংশ) ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতায় রয়েছে। বিশ্বে এই রোগের গড় বিস্তার যেখানে ১১৪ শতাংশ, আমাদের দেশে সেই বিস্তারের হার ১৪৯ শতাংশ, যা খুবই আশঙ্কাজনক। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা মতে নগরায়ণ, ‘ওয়েস্টার্ন ফুড’ আর সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় এই রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, এই শতকের মাঝামাঝি পৌঁছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারি রূপে উদ্ভাসিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিস তথ্য নিকাশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এই ঘাতকব্যাধি বছরে ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন করে সে দেশের জাতীয় অর্থনীতির। 

গ্রিক ক্রিয়াপদ ডায়াবাইনেইন থেকে ডায়াবেটিস শব্দের উৎপত্তি। মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিক চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) ১০২৫ সালে সমাপ্ত তার ১৭ খণ্ডের চিকিৎসা বিশ্বকোষ ‘ক্যানন অব মেডিসিন’-এ সর্বপ্রথম ‘বহুমূত্র, অধিক ক্ষুধা এবং যৌনশক্তির ক্রমনাশক’ ডায়াবেটিস রোগের স্বভাবচরিত্র বর্ণনা করেন। ডায়াবেটিস গ্যাংগ্রিনের কথাও লিখেছেন তিনি। ইবনে সিনা লিউপিন বা নয়নতারা ফুল, ট্রিগোনেলা আর জেডোয়ারির বিজ সমন্বয়ে তৈরি ভেষজ ওষুধ দ্বারা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের উপায়ও নির্দেশ করেছিলেন, যা আধুনিক চিকিৎসা গবেষণায়ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। 

রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটেছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ।

 যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীর চর্চা করেন না, গাড়িতে চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তাভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে গেলে এ রোগ বাড়তে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকারের: (ক) ইনসুলিননির্ভর এবং (খ) ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিননির্ভর রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীর খাদ্যনিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়। 

ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায়, শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়মশৃঙ্খলাই ডায়াবেটিক রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিক রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন। 

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য
[email protected]

প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার পরিধি বাড়াতে হবে

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ এএম
প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার পরিধি বাড়াতে হবে
আলম শাইন

জলবায়ু অথবা পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু শব্দ সাধারণ মানুষের বুঝতে সমস্যা হয়। এর অর্থ এই নয় যে, শব্দগুলো অনেক কঠিন ভাষায় রচিত। শব্দগুলো বহুল প্রচলিত হলেও এর অর্থ সর্বসাধারণের মাথায় ঢোকে না। আবার সামান্য একটু বুঝিয়ে দিলেই বিষয়টা মনে রাখতে পারেন অনেকেই। তেমনি কিছু শব্দ আছে, যেমন: জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ওজোনস্তর ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ইত্যাদি। ইতোপূর্বে শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলেও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি তেমন একটা। তাই আজকের আলোচ্য বিষয় বেছে নেওয়া হয়েছে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ নিয়ে। আলোচনার আগে আমাদের জেনে নিতে হবে উপরিউক্ত শব্দগুলোর অর্থ। যেমন: ‘মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাময় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বোঝায়।’ সহজ বাংলায় পরিবেশ অথবা জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলে ওই এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’, সংক্ষেপে ‘ইসিএ’। যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে শব্দগুলো ব্যাপক পরিচিত। অন্যদের কাছেও যে অপরিচিত শব্দ তা কিন্তু নয়। শুধু বোঝার ব্যাপারটাই এখানে কাজ করে; অন্য কিছু নয়। জ্ঞানী সেজে কাউকে জ্ঞান বিতরণের উদ্দেশ্যে এ লেখার অবতারণা নয়; শুধু সচেতন করিয়ে দেওয়া। তাতে একে অপরকে সহজে বোঝাতে সক্ষম হবেন এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে সাধারণ মানুষ উদ্বুদ্ধ হবেন।

আমাদের দেশে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিরূপণ করা হয়েছে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে। সেই আইনে প্রথম দেশের আটটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি এলাকা সংযোজন করা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই জলাভূমি। এলাকাগুলো যথাক্রমে সুন্দরবন, কক্সবাজার, টেকনাফ উপদ্বীপ (পেনিনসুলা), সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড়, ঢাকাবেষ্টিত বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদী, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধিত ধারা ৫-এর বিভিন্ন উপধারায় বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে। ব্যাখ্যা দেওয়া আছে- কেন এই ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যার যৎসামান্য তথ্য নিম্নে তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমরা।

প্রথমে সুন্দরবনের কথাই আসা যাক। এই বন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি আমাদের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। এ ধরনের শ্বাপদসংকুল বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। যেমন দুর্গম, তেমনি জীববৈচিত্র্যে ঠাসা এ বন। এই বনটি বিভিন্ন কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন বিধায় এর চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে যে কেউ ইচ্ছে করলেই অবাধে মৎস্য আহরণ, গাছগাছালি কর্তন করতে পারে না। তাতে করে মৎস্য সম্পদ ও বৃক্ষরাজি রক্ষার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের সার্কেল সুরক্ষিত হচ্ছে।

সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড় মিঠা পানির জলাশয়। এতদঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, জলজ উদ্ভিদ, পরিযায়ী পাখি স্থানীয় লোকদের অত্যাচারের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এই হাওর-বাঁওড়গুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে অত্র অঞ্চলে কেউ মর্জি মোতাবেক সম্পদ বিনষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে না।

কক্সবাজার-টেকনাফের উপদ্বীপে বন্যপ্রাণীর প্রজননক্ষেত্র এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের নিরাপদ চারণভূমি বিধায় এ দুটি অঞ্চলকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাতে করে সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে।
সেন্ট মার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপের গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্যের আধিক্যের কারণে এ দুটি দ্বীপকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়ছে। এখানে দুর্লভ অলিভ রিডলি টার্টলের (জলপাইরঙা কাছিম) প্রজননস্থল। এ ছাড়া সোনাদিয়া দ্বীপে বিপন্ন প্রজাতির পাখি চামচঠুঁটো বাটানের আবাসস্থল। অপরদিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে দুর্লভ জীববৈচিত্র্য ছাড়াও পরিবেশগত কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশেষ করে এ দ্বীপ পর্যটক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। যেমন- পলিথিন, কোমল পানীয়ের কৌটাসহ নানান আবর্জনা ফেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অপরদিকে পর্যটকদের রাত্রিযাপন কিংবা আয়েশের জন্য বেশ কিছু হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। এতে করে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে সেন্ট মার্টিন ভাঙনের কবলে পড়ে, বিষয়টি গোচরীভূত হতেই সরকার রাত্রিযাপনে নিষেধাজ্ঞাসহ দ্বীপটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী এবং গুলশান-বারিধারা লেক অসনীয় মাত্রায় দূষণের কবলে পড়ে। কলকারখানার নির্গত অপরিশোধিত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, পলিথিন ও গৃহস্থালীর আবর্জনায় জলাশয়ের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জল বিবর্ণ হয়ে এসেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও মাছ মারা যাচ্ছে; স্থান বদল করছে। এসব প্রতিবেশগত কারণে জলাশয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, ফলে সরকার সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এ এলাকাগুলোকে।

দেশে এ ধরনের আরও কিছু সংকটাপন্ন এলাকা রয়েছে। তার মধ্যে ‘চলনবিল’ অন্যতম। আমরা আশাবাদী বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সেটিও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হবে একদিন। শুধু চলনবিলই নয়, দেশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জলাশয় কিংবা বন-বনানী রয়েছে, সেসব এরিয়াকে অতি সত্বর ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে বলে নেওয়া আবশ্যক, সরকার বিভিন্ন সংকটাপন্ন এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়; আমাদের ঘাড়েও বর্তায়, যা সবারই মনে রাখতে হবে। কারণ দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সবারই। আমাদের বেঁচে থাকতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করতে হবে। বলে নেওয়া ভালো, আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গে এই সার্কেলটি বিশেষভাবে যুক্ত।

 সুতরাং আমরা জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করি উদ্দাম গতিতে। আমরা জানি, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে একটি মাধ্যম প্রয়োজন। আর সেই উৎকৃষ্ট মাধ্যমটি হচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাই আমরা ইচ্ছে করলে সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সবুজ বাঁচিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে পারি। পাশাপাশি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। নিজের উদ্যোগে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়ে দেশকে সবুজ সমাহারে ভরে তুলি। এ বিষয়ে কাজ করতে যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা, ‘আসুন ফেসবুকে সময় না কাটিয়ে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ তথা সবুজবিশ্ব গড়ে তুলি নিজ দায়িত্বে।’ তবেই তো এ সবুজ গ্রহটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে পারবে, সেই সঙ্গে আমরাও বেঁচে থাকার যথাযথ উপাদান পেয়ে যাব। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে একটি সুন্দর নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

লেখক: কথাসাহিত্যিক
পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
[email protected]

জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৫ পিএম
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে
মুখতার বাবায়েভ

জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে বিশ্বের আরও জলবায়ু অর্থায়ন প্রয়োজন। আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কপ২৯ শুরু হয়েছে। এই সম্মেলনে জলবায়ুর নতুনভাবে অর্থায়নের লক্ষ্যে আজারবাইজানের কপ প্রেসিডেন্সির অগ্রাধিকার অনেক বেশি। 

উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের কার্বন নির্গমন মোকাবিলা করতে এবং জলবায়ু হুমকির বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে সহায়তা প্রয়োজন। ২০০৯ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে পূরণ করা। এটি ছিল অনেক আগের লক্ষ্যমাত্রা এবং জলবায়ু সংকটের প্রান্তে থাকা দেশগুলোর জন্য যা প্রয়োজন তার থেকে অনেক কম। 

এবারের জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনার আহ্বায়ক হিসেবে আমরা একটি সুষ্ঠু ও মানসম্মত অর্থায়নের ওপর জোর দিয়েছি। এই সম্মেলনে ১৯৮টি দেশ অংশগ্রহণ করছে। প্রতিটি দেশকেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে ভেটো প্রদানকারীদের সঙ্গে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই নিষ্পত্তি হবে না। কিছু দেশ একক অঙ্কের ট্রিলিয়নের জন্য তর্ক করে, কেউ বলে ডাবল ডিজিটের ট্রিলিয়ন এবং অন্যরা শত শত বিলিয়নের জন্য তর্ক করে। জনগণের অর্থ দিয়ে জলবায়ু কতটা মোকাবিলা করা যাবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। জলবায়ু মোকাবিলায় বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশই আর্থিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। এমন একপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, আজ দেরি করা মানেই আগামীকাল বড় বিলের নিশ্চয়তা দিতে পারে।

 চরম মানবিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধ করতে বেশি দেরি না করে আগে নির্গমন হ্রাস অত্যন্ত জরুরি। হারিকেন ও খরার মতো জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো মোকাবিলায় দেশগুলোকে শক্তিশালী করে এমন কার্যকর ব্যবস্থাগুলোতে বিনিয়োগ না করলে পবর্তীতে ব্যাপক ক্ষতি হবে। জলবায়ু প্রভাবের কারণে প্রান্তিক দেশগুলোতে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে, সেই দেশগুলোর পুনর্গঠনে তার চেয়ে বহুগুণ খরচ হবে। প্রতিকারের জন্য প্রতিরোধই শ্রেয়, কিন্তু 
আমাদের এই গ্রহ দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছে। 
এই গ্রহের পতন বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। 

শুধু এ ধরনের তহবিল প্রয়োজনীয় নয়, আরও বেশি দরকার। এ ধরনের তহবিল আগেও করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কোভিড-১৯-এর সময় বিশ্ব যখন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো মাত্র ৪৮ মাসের মধ্যে ৮ ট্রিলিয়ন তহবিলের ব্যবস্থা করেছিল। সেই সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তা পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও একইভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা 
করতে হবে। 

তবে এর দায় সম্পূর্ণভাবে সরকারি তহবিলের ওপর পড়তে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য বেসরকারি অর্থায়ন চালু করা দীর্ঘদিনের দাবি। বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, জনগণ প্রতি ১ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৫ বা ৭ ডলার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ ডলার করে অর্থ জোগাড় করা যেতে পারে। কিন্তু জলবায়ু মোকাবিলায় তার বিপরীতটি ঘটে চলছে। ২০২২ সালে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু সহায়তার জন্য ৯৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। অথচ বেসরকারি খাত থেকে মাত্র ২১.৯ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। 

জলবায়ু মোকাবিলায় কত খরচ হতে পারে তার সঠিক ধারণা বা প্রমাণ এখনো নেই। শুধু অনুদান বা রেয়াতি অর্থায়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিচ্ছন্ন শক্তির রূপান্তরে অর্থায়নের জন্য বিশ্বে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষয়ক্ষতি ও মোকাবিলার কথা বলা হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, বেসরকারি খাত ছাড়া জলবায়ু সুষ্ঠু কোনো সমাধান নেই। 

আন্তর্জাতিক শক্তি সংগঠনের মতে, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ বিশ্বব্যাপী পরিচ্ছন্ন শক্তি ব্যয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ পায়। পার্থক্য শুধু বেসরকারি খাতে। উন্নত দেশগুলোতে সবুজানয়ন প্রকল্পের ৮০ শতাংশের বেশি অর্থায়ন করে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে তার সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১৪ শতাংশ। বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন উন্নত দেশগুলো প্রায় ৬০ শতাংশ কার্বন নির্গমন করে। যদিও উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো এখনো বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের ৮০ শতাংশের বেশি দূষিত করে। জলবায়ু মোকাবিলায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ব্যতীত দেশগুলোর শক্তির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে কার্বন নির্গমনের অনুপাত পরিবর্তিত হবে এবং আয়তনে আরও বৃদ্ধি পাবে।

পুনর্বীকরণযোগ্য মুনাফা উৎপন্ন করে এমন দেশগুলোতে ব্যক্তিগত অর্থায়ন প্রলুব্ধ করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো প্রায়ই মূলধনের খরচকে অসহনীয় করে তোলে। যদিও আফ্রিকা বিশ্বের স্বল্প-উন্নত মহাদেশ, যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মহাদেশ ইউরোপের চেয়ে বেশি খরচ হয়। তাহলে কেন একজন বিনিয়োগকারী আফিকা মহাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে বিনিয়োগ করবেন? বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে যথার্থ করে তোলার জন্য আমাদের তীক্ষ্ণ হাতিয়ার দরকার, যেমন- অর্থ প্রদান না করা, চুক্তি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে গ্যারান্টি বা মুদ্রার অস্থিরতার মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি। 

এই উপায়ে বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহী করতে আমাদের অবশ্যই আরও বেশি জনসাধারণের অর্থকে লক্ষ্য করতে হবে। এটি শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বের পরিবর্তনে অর্থায়নের জন্য নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতি ও ক্ষয়পূরণের জন্য জনগণের তহবিল খালি করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা কীভাবে ক্ষয়ক্ষতি এবং ক্ষতি পূরণে অর্থায়ন করি, সেই সঙ্গে জলবায়ু সংকটকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থাপত্যের সংস্কার সম্পর্কে কপ২৯-এ মানসম্মত আলোচনা হতে বাধ্য। তবে নিশ্চিত যে, জলবায়ু মোকাবিলায় বিশ্বের আরও তহবিল প্রয়োজন এবং দ্রুতই তা প্রয়োজন। ইতিহাস বলে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমরা দরকারি তহবিল সংগ্রহ করি, এটা এখন অনেকটাই রাজনৈতিক ইচ্ছার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
 
লেখক: সভাপতি, জাতিসংঘের কপ২৯ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও বাদ পড়ার সংস্কৃতির অবসান হোক

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১১ পিএম
সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও বাদ পড়ার সংস্কৃতির অবসান হোক
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

কয়েক বছর আগে আমার এক ছাত্র বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে সরকারি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে আমার বাসায় আসে। ওই সময়ে তার আনন্দের সীমা ছিল না। ওই মুহূর্তটি ছিল তার জীবনের সর্বোচ্চ আনন্দের। একজন ছাত্রের পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার আনন্দ যে কত বেশি, সেটি প্রতিবছর ফলাফল প্রকাশ হলে নিজের ছাত্রদের দেখলেই বুঝতে পারি। অনেক শিক্ষার্থীই বিসিএস পরীক্ষায় পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়াকেই চূড়ান্ত ফল হিসেবে ধরে নেয়। এমনকি তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবাই সেটিই মনে করেন। 

আমার ওই ছাত্রের বেলাতেও তেমনটিই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় কয়েক মাস পরে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ হওয়ার পর আমাকে ফোন করে জানায় যে, প্রজ্ঞাপনে তার রোল নেই। আমি ওই ছাত্রের আনন্দের মুহূর্তটি পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর যেভাবে অনুভব করতে পেরেছিলাম আবার দুঃখের মুহূর্তটিও সেভাবেই অনুভব করলাম প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর। প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ যাওয়ার মূল কারণ কী- তা আজও আমরা কেউ জানতে পারিনি। হয়তো বিষয়টি রাজনৈতিক হতে পারে। আমি ওই ছাত্রকে খুব ভালোভাবে জানি যে, সে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না।

 তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, তার পরিবারের কেউ কি তাহলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল? সেটা হলেও কি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী তার মেধা প্রমাণ করার পর প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ দেওয়া যায়? বিষয়টির যুক্তিতর্ক অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু আমি সেই যুক্তিতর্কে যেতে চাই না। 

একজন মেধাবী ছাত্র দীর্ঘদিন থেকে স্বপ্ন আঁকে, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে সে দেশের সেবা করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন যদি সফলতার চূড়ান্ত শিখরে যাওয়া সত্ত্বেও পূরণ না হয়, তাহলে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে! 

গত কয়েক দিন থেকে শুনতে পাচ্ছি বিগত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে যাদের নাম পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে এবং যারা চাকরিতে যোগদান করেছেন, তাদের পুনরায় ভেরিফিকেশন করা হবে। বিষয়টি আমার কাছে আশঙ্কাজনক মনে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার যুক্তি হচ্ছে, কেউ যদি চাকরিবিধি ভঙ্গ করে তাহলে তার শাস্তি অবশ্যই হওয়া উচিত। 

বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি আচরণ বিধিমালা রয়েছে ১৯৭৯ সালের। এটির নাম সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯। এটি ২০০২ সালে এবং ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এই আচরণ বিধিমালায় মোট ৩৪টি নির্দেশনা আছে। দেশে বা বিদেশে কারও কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে তার নির্দেশনা রয়েছে। শুধু নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। 

নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায়। সেখানে অসদাচরণের সংজ্ঞাও দেওয়া আছে। যেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো  হয়েছে- অসঙ্গত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলাহানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। উল্লিখিত বিধানাবলি অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি অনিবার্য হওয়া উচিত। 

কিন্তু মেধা প্রমাণ করার পরও যদি রাজনৈতিক কারণে কোনো শিক্ষার্থী চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ে সেটির চেয়ে ভয়াবহ কিংবা দুঃখজনক ওই শিক্ষার্থীর জন্য আর কিছু হতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল থাকবে- এমনটি স্বাভাবিক। কিন্তু বিগত সময়ে শুধু রাজনৈতিক কারণে যাদের নাম প্রজ্ঞাপনে তোলা হয়নি, সে বিষয়ে সবারই আপত্তি থাকার কথা। কিংবা ভবিষ্যতেও যদি এমন প্রক্রিয়া চলমান থাকে তবে সেটির প্রভাবও নেতিবাচক হিসেবে ধরা যায়।

আমাদের সমাজে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা বিগত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধীদের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের মৌন সমর্থক। হয়তো এ বিষয়টি নতুন করে প্রমাণ করার সুযোগ তারা পাবে না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় আন্দোলনে অংশ নিয়েছে কিন্তু পিএসসির কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও যদি প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ যায়, তাহলে তার সেই দুঃখ কীভাবে মিটবে?

কয়েকদিন আগে আমার একজন ছাত্র আমার অফিসে এসে তার এমন অসহাত্বের আশঙ্কা নিয়ে আলাপ করছিল। এমনকি সে চাকরির জন্য চেষ্টা না করে কীভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো যায়, সেই রাস্তাও খুঁজছে। সে মনে করে, একটি চাকরির পরীক্ষায় যে পরিশ্রম করতে হয়, তার পর যদি চূড়ান্তভাবে কোনো কারণে প্রজ্ঞাপন থেকে নাম বাদ যায় তাহলে তখন যে ধরনের হতাশা তাকে আঁকড়ে ধরবে সেখান থেকে সহজে বের হওয়া সম্ভব হবে না।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে দেশের মেধাবী তরুণরা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আবার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেও তরুণদের অংশগ্রহণ রয়েছে। অন্যদিকে দেশের অসংখ্য মেধাবী তরুণ বেকার রয়েছে। এর আগে আমরা তরুণদের নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি, সেমিনার এবং আলোচনায় অনেক প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছি। এখন তরুণদের হাতেই রাষ্ট্রের চালিকা-চাবি।

 দেশের মেধাবীরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ বিষয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ, হিসাব-নিকাশ, আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত দেশের যে সংস্কার কাঠামো আমরা পেতে যাচ্ছি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের কাছে কর্মসংস্থান এবং তৎসংশ্লিষ্ট নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গটি অত্যন্ত আলোচিত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কর্মসংস্থান সংকটে বেকারত্বের হার বেড়েছে। 

অতিমাত্রায় হতাশ হয়েছে উচ্চশিক্ষিতরা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণদের অনেকের জীবন বিষাদময় হয়ে উঠেছে। ফলে এই সরকারের পক্ষ থেকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কী এবং কেমন থাকছে, সেটি খুঁজে বেড়াচ্ছে তরুণরা। বেকারদের অনেকে পরিশ্রম করে একটি চাকরির জন্য পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরও যদি তার পরিবারের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড কিংবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততার কারণে প্রজ্ঞাপন থেকে নাম বাদ যায়, তাতে শঙ্কা প্রকাশ করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।

 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

বাংলাদেশের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কী হবে

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৯ পিএম
বাংলাদেশের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কী হবে
মুন্সি ফয়েজ আহমদ

যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি নতুন নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আগেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পুনরায় তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি অন্যদের থেকে অপেক্ষাকৃত একটু আলাদা। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ব্যতিক্রম কিছু করে ফেলতে পারেন বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

 অনেকেই এ বিষয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সম্পৃক্ততা কিছুটা কমিয়ে আনতে পারেন। গতবার যখন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন ন্যাটোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমিয়ে এনেছিলেন। ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ বহুভাবে কমানো হয়েছিল। ন্যাটো সদস্যদেশগুলো আবারও সেই অবস্থায় চলে যেতে পারে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ হয়নি। যেসব যুদ্ধ চলমান ছিল সেখান থেকে সরে আসার জন্য, অর্থাৎ যুদ্ধ থামানোর 
জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এবারও সে রকম হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বাংলাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য যেকোনো দেশ, সবাই জাতীয় স্বার্থেই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে থাকে। জাতীয় স্বার্থ বলতে প্রত্যেকেই নিজ দেশের স্বার্থকে গুরুত্বসহকারে দেখে। তবে ব্যক্তিবিশেষে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকতে পারে। সেই পার্থক্যগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সূক্ষ্ম বা মোটা দাগের হয়ে থাকে। পররাষ্ট্র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু নীতিমালা আছে। তারা সেই নীতিমালাগুলোই মোটামুটিভাবে অনুসরণ করে থাকে। ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান- উভয় দলই দেশের ভেতরে, অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট হোক বা রিপাবলিকান হোক, সম্পর্কগুলো বেশি পরিবর্তন হয় না। 

আমরা পেছন থেকে দেখে সামনের দিকে কী হবে সেই চিন্তা করি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথার মধ্যেও এটি ছিল যে, যুদ্ধ তিনি পছন্দ করেন না। সে জন্য মনে করা হচ্ছে, যেখানে যেখানে যুদ্ধ আছে বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সেটার ওপরে বড় ধরনের প্রভাব আসতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভালো সম্পর্ক আছে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক হয়, সেভাবে চেষ্টা করতে পারেন এবং সেটা হওয়া সম্ভব। আরেকটা বিষয় অনেকে মনে করার চেষ্টা করেন, যেমন- এবারের নির্বাচনে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা অনেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। তারা আশা করেছেন যে, তিনি হয়তোবা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি রক্ষার জন্য চেষ্টা করবেন। 

যেখানে তার বেশি কিছু করার আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ ইসরায়েলের স্বার্থ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে- এই বিষয়ে অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন। সেখানেও বড় রকমের কোনো পার্থক্য হবে না। তবে পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিস্তারণে উনি গুটিয়ে থাকা প্রকৃতির মানুষ। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখানো অথবা বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারগুলো কমে যাবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের যেভাবে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে, সেই চেষ্টাটা একটু কমে আসতে পারে। তবে পররাষ্ট্রনীতির ধরন পাল্টাবে না।

 বিশেষ করে আমাদের অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে। অনেক বেশি প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কটুকু বজায় রাখার জন্য আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক সুবিধাসহ অন্য যেসব সুবিধা আমরা পেয়ে আসছিলাম, সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। অর্থনৈতিক যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো কী করে কাটিয়ে ওঠা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে ডেমোক্র্যাটের মতো রিপাবলিকানরা এত বেশি ব্যস্ত থাকে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীনের সঙ্গে  সম্পর্ক কেমন হবে। আগামী দিনেও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলবৎ থাকবে বলে মনে হয়। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। সামরিক শক্তির দিক থেকেও দেশটি সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কাজেই চীন সবদিক থেকেই বৈশ্বিকভাবে তার প্রভাব বাড়িয়ে চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার আগের শাসনামলে চীনের বিরুদ্ধে প্রথম শুল্কারোপ করেন। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেই শুল্ক বজায় রাখেন। এসব কিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনকে এক রকম কোণঠাসা করে রাখা।  

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন। এর ওপর নির্ভর করবে চীনের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমবে নাকি বাড়বে। বলা বাহুল্য, এর প্রতিক্রিয়া পৃথিবীজুড়েই ছড়িয়ে পড়বে। এটি মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ আছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন বিদ্যমান পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবেন না। বরং বিদ্যমান নীতি গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে তিনি দেখাতে চেষ্টা করবেন যে, পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি কিছু করছেন। চীনের বিরুদ্ধে নানা রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে সম্ভবত তিনি তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করবেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে চীনের বিরুদ্ধে সহজে প্রভাবিত করা যায়। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে। একই সঙ্গে ইউক্রেনের প্রতি চাপ বৃদ্ধি হতে পারে। তবে ট্রাম্প বরাবরই বলছেন যে, তিনি যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগবে। 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা যায়, তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে। সেটা বাংলাদেশিদের জন্য ইতিবাচক হবে কি না, সেটাই বিবেচ্য। যেমন- অভিবাসীদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সংকুচিত হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে যে রকম চিন্তাভাবনা লক্ষ করা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন সেখানে সম্পূর্ণ নীতি অনুসরণ করতে নাও পারে। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে অতি উৎসাহের মাত্রাটা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে মনে হয়।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত