নীরব ঘাতক স্বভাবের যে রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক, সেই ডায়াবেটিস রোগের অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে যথাসচেতন করে তুলতেই আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে ফ্রেডারিক ব্যান্টিং (১৮৯১-১৯৪১) এবং চার্লস বেস্ট (১৮৯৯-১৯৭৮) কর্তৃক ইনসুলিন আবিষ্কার এক যুগান্তকারী অগ্রগতি। এ জন্য ব্যান্টিং চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯২৩ সালে। ১৪ নভেম্বর ফ্রেডারিক ব্যান্টিংয়ের জন্মদিবসকেই তার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনার্থে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
বিশ শতকের শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধিনিচয়ের নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটিবসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি নির্মূলে সক্ষম হলেও মানুষের সুন্দর, সাবলীল জীবনযাপনের পথে নীরবে তার সর্বকর্মক্ষমতা হরণকারী অসংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিসচেতনতাসহ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা যথা মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আসছে না বলে প্রতীয়মান হয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ২০০৬ সালে জাতিসংঘকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির আহ্বানে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে এবং যৌক্তিকতার প্রচার-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২০০৭ সালেই জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের ব্লু সার্কেল লোগোটিও নির্বাচিত হয়। নীল বৃত্ত জীবন ও স্বাস্থ্যের ধনাত্মক প্রতীক, নীলাকাশ সব জাতিনিচয়কে সংঘবদ্ধ করেছে এবং এ কারণে জাতিসংঘের পতাকার রংও নীল। নীল বৃত্ত বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ ও জয়ে ঐকবদ্ধ প্রয়াসের প্রতীক।
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মহামারি আকারে ধেয়ে আসা অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২০-২৫-তে ডায়াবেটিস রোগের বিস্তার রোধে উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো ১৪ নভেম্বর সাড়ম্বরে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উদযাপনে ২০২৪ প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘সুস্বাস্থ্যই হোক আমাদের অঙ্গীকার’।
পরিবেশের প্রভাব থেকে ডায়াবেটিসের বিস্তার প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় উঠে এসেছে। ২০২৪-এর ১৪ নভেম্বর এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের আহ্বান awareness activities aim to keep diabetes firmly in the public spotlight and promote the importance of coordinated and concerted action to tackle the impact of the condition. ‘ডায়াবেটিস রোখো’- এই গুঞ্জন, এই প্রয়াস সর্বত্র।
ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ভাষায়- 3D (Diet, Discipline and Drug) অর্থাৎ খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়মশৃঙ্খলাই ডায়াবেটিক রোগীর জীবনকাঠি।
ডায়াবেটিক রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্যনিয়ন্ত্রণ ও নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ও আত্মসচেতনতা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদেরও শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলে এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করে তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ২০০০ সালে ভিত্তি বছরে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১৭ কোটি (বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৩ ভাগ) ছিল, তাদের আশঙ্কা ২০৩০ সালে সে সংখ্যা দ্বিগুণে বেশি হয়ে যাবে। প্রাদুর্ভাব ও বিস্তারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে টাইপ-২ অর্থাৎ ইনসুলিন-নিরপেক্ষ রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি (১৮০ শতাংশ), এরপর আফ্রিকা মহাদেশে (১৬০ শতাংশ), দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (১৫৫ শতাংশ) ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতায় রয়েছে। বিশ্বে এই রোগের গড় বিস্তার যেখানে ১১৪ শতাংশ, আমাদের দেশে সেই বিস্তারের হার ১৪৯ শতাংশ, যা খুবই আশঙ্কাজনক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা মতে নগরায়ণ, ‘ওয়েস্টার্ন ফুড’ আর সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় এই রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, এই শতকের মাঝামাঝি পৌঁছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারি রূপে উদ্ভাসিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিস তথ্য নিকাশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এই ঘাতকব্যাধি বছরে ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন করে সে দেশের জাতীয় অর্থনীতির।
গ্রিক ক্রিয়াপদ ডায়াবাইনেইন থেকে ডায়াবেটিস শব্দের উৎপত্তি। মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিক চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) ১০২৫ সালে সমাপ্ত তার ১৭ খণ্ডের চিকিৎসা বিশ্বকোষ ‘ক্যানন অব মেডিসিন’-এ সর্বপ্রথম ‘বহুমূত্র, অধিক ক্ষুধা এবং যৌনশক্তির ক্রমনাশক’ ডায়াবেটিস রোগের স্বভাবচরিত্র বর্ণনা করেন। ডায়াবেটিস গ্যাংগ্রিনের কথাও লিখেছেন তিনি। ইবনে সিনা লিউপিন বা নয়নতারা ফুল, ট্রিগোনেলা আর জেডোয়ারির বিজ সমন্বয়ে তৈরি ভেষজ ওষুধ দ্বারা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের উপায়ও নির্দেশ করেছিলেন, যা আধুনিক চিকিৎসা গবেষণায়ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটেছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ।
যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীর চর্চা করেন না, গাড়িতে চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তাভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে গেলে এ রোগ বাড়তে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকারের: (ক) ইনসুলিননির্ভর এবং (খ) ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিননির্ভর রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীর খাদ্যনিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়।
ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায়, শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়মশৃঙ্খলাই ডায়াবেটিক রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিক রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য
[email protected]