ঢাকা ২৮ কার্তিক ১৪৩১, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে মশার প্রজনন বাড়ছে

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৪, ০১:২২ পিএম
জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে মশার প্রজনন বাড়ছে
ড. মাহবুবার রহমান। ছবি : সংগৃহীত

জলবায়ুর পরিবর্তন শুধু মশা নয়, অনেক প্রাণিকুলের ওপর প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সব প্রাণিকুল তথা মশার প্রজননও অনেক বেড়ে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে মশার প্রজননের ঘনত্ব বেড়ে যায়। প্রজনন যত বেশি হবে, মশার উপদ্রব তত বাড়বে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক যুক্তি। এই যুক্তি কেউ কোনো দিন প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বড় বড় দেশ, শিল্পপ্রধান দেশগুলোই বেশি দায়ী। আমাদের দেশ শিল্পপ্রধান না। বিভিন্ন উন্নত দেশ তাদের শিল্প প্রসারের জন্য বিভিন্ন কাজ করছে। আর তাদের শিল্পের জন্য জলবায়ুকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে। তাই উন্নত দেশগুলো মশার প্রজননকে সাহায্য করছে, আর এতে উন্নয়নশীল দেশগুলো আক্রান্ত হচ্ছে। 

মশা প্রজননের বিস্তার ঠেকানোর একটাই পথ হচ্ছে প্রজননের ক্ষেত্রটা ধ্বংস করতে হবে। তাপমাত্রা উপযোগী হলে তো মশা বাড়বেই। কিন্তু উপযুক্ত তাপমাত্রায় হলেও তাদের প্রজননক্ষেত্র যদি অনুপযুক্ত করা যায়, তাহলে তো আর প্রজনন হবে না। মশার প্রজননক্ষেত্র জলাবদ্ধ জায়গা। আমরা যদি কোথাও পানি জমতে না দিই, পানির প্রবাহ যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও যেহেতু বিস্তারের ক্ষেত্র অনুকূল থাকবে না, তাই তাদের বিস্তার হবে না। পানি জমে থাকতে পারে বিভিন্ন কারণে। এখন কোথাও একটা ছোট পাত্র পড়ে আছে, সেখানে পানি জমা আছে, সেটাও রাখা যাবে না। ফুলের টবে যে পানি জমে থাকে, সেখানেও পানি জমতে দেওয়া যাবে না। আমাদের যে নালা-নর্দমা আছে, সেখানে যেন পানি আটকে না থাকে বা জলাবদ্ধ হয়ে না থাকে, তার জন্য নালা-নর্দমায় পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। 

আর মশা নিধনের যে ব্যাপারটা, নিধন করে আমরা কখনোই মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। নিধন করার যে ব্যবস্থাপনা আছে, শুধু পেস্টিসাইড অ্যাপ্লাই করে কিছু করা যাবে না। আর যেভাবে সিটি করপোরেশন বা আমাদের কর্মীরা ফগার মেশিন দিয়ে ফগিং করেন, এ ফগিং কিছু অ্যাডাল্ট উড়ন্ত মশাকে কন্ট্রোল করার জন্য। কিন্তু মশার রিপ্রোডাকশন মূলত হয় লার্ভার জন্য। আর লার্ভা থাকে পানিতে। পানিতে লার্ভার ভলিউম অনেক বেশি। পানিতে যদি মশা নিধন করার কোনো ওষুধ ছিটানো হয়, তাহলে তো ওষুধ পানির মধ্যে মিশে যাবে। বিশাল ভলিউমের মশার লার্ভা মারার ঘনত্বটা ওষুধে থাকবে না। 

কীটতত্ত্ববিদ ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় 

জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৫ পিএম
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে
মুখতার বাবায়েভ

জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে বিশ্বের আরও জলবায়ু অর্থায়ন প্রয়োজন। আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কপ২৯ শুরু হয়েছে। এই সম্মেলনে জলবায়ুর নতুনভাবে অর্থায়নের লক্ষ্যে আজারবাইজানের কপ প্রেসিডেন্সির অগ্রাধিকার অনেক বেশি। 

উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের কার্বন নির্গমন মোকাবিলা করতে এবং জলবায়ু হুমকির বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে সহায়তা প্রয়োজন। ২০০৯ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে পূরণ করা। এটি ছিল অনেক আগের লক্ষ্যমাত্রা এবং জলবায়ু সংকটের প্রান্তে থাকা দেশগুলোর জন্য যা প্রয়োজন তার থেকে অনেক কম। 

এবারের জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনার আহ্বায়ক হিসেবে আমরা একটি সুষ্ঠু ও মানসম্মত অর্থায়নের ওপর জোর দিয়েছি। এই সম্মেলনে ১৯৮টি দেশ অংশগ্রহণ করছে। প্রতিটি দেশকেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে ভেটো প্রদানকারীদের সঙ্গে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই নিষ্পত্তি হবে না। কিছু দেশ একক অঙ্কের ট্রিলিয়নের জন্য তর্ক করে, কেউ বলে ডাবল ডিজিটের ট্রিলিয়ন এবং অন্যরা শত শত বিলিয়নের জন্য তর্ক করে। জনগণের অর্থ দিয়ে জলবায়ু কতটা মোকাবিলা করা যাবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। জলবায়ু মোকাবিলায় বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশই আর্থিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। এমন একপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, আজ দেরি করা মানেই আগামীকাল বড় বিলের নিশ্চয়তা দিতে পারে।

 চরম মানবিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধ করতে বেশি দেরি না করে আগে নির্গমন হ্রাস অত্যন্ত জরুরি। হারিকেন ও খরার মতো জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো মোকাবিলায় দেশগুলোকে শক্তিশালী করে এমন কার্যকর ব্যবস্থাগুলোতে বিনিয়োগ না করলে পবর্তীতে ব্যাপক ক্ষতি হবে। জলবায়ু প্রভাবের কারণে প্রান্তিক দেশগুলোতে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে, সেই দেশগুলোর পুনর্গঠনে তার চেয়ে বহুগুণ খরচ হবে। প্রতিকারের জন্য প্রতিরোধই শ্রেয়, কিন্তু 
আমাদের এই গ্রহ দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছে। 
এই গ্রহের পতন বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। 

শুধু এ ধরনের তহবিল প্রয়োজনীয় নয়, আরও বেশি দরকার। এ ধরনের তহবিল আগেও করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কোভিড-১৯-এর সময় বিশ্ব যখন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো মাত্র ৪৮ মাসের মধ্যে ৮ ট্রিলিয়ন তহবিলের ব্যবস্থা করেছিল। সেই সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তা পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও একইভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা 
করতে হবে। 

তবে এর দায় সম্পূর্ণভাবে সরকারি তহবিলের ওপর পড়তে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য বেসরকারি অর্থায়ন চালু করা দীর্ঘদিনের দাবি। বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, জনগণ প্রতি ১ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৫ বা ৭ ডলার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ ডলার করে অর্থ জোগাড় করা যেতে পারে। কিন্তু জলবায়ু মোকাবিলায় তার বিপরীতটি ঘটে চলছে। ২০২২ সালে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু সহায়তার জন্য ৯৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। অথচ বেসরকারি খাত থেকে মাত্র ২১.৯ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। 

জলবায়ু মোকাবিলায় কত খরচ হতে পারে তার সঠিক ধারণা বা প্রমাণ এখনো নেই। শুধু অনুদান বা রেয়াতি অর্থায়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিচ্ছন্ন শক্তির রূপান্তরে অর্থায়নের জন্য বিশ্বে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষয়ক্ষতি ও মোকাবিলার কথা বলা হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, বেসরকারি খাত ছাড়া জলবায়ু সুষ্ঠু কোনো সমাধান নেই। 

আন্তর্জাতিক শক্তি সংগঠনের মতে, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ বিশ্বব্যাপী পরিচ্ছন্ন শক্তি ব্যয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ পায়। পার্থক্য শুধু বেসরকারি খাতে। উন্নত দেশগুলোতে সবুজানয়ন প্রকল্পের ৮০ শতাংশের বেশি অর্থায়ন করে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে তার সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১৪ শতাংশ। বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন উন্নত দেশগুলো প্রায় ৬০ শতাংশ কার্বন নির্গমন করে। যদিও উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো এখনো বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের ৮০ শতাংশের বেশি দূষিত করে। জলবায়ু মোকাবিলায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ব্যতীত দেশগুলোর শক্তির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে কার্বন নির্গমনের অনুপাত পরিবর্তিত হবে এবং আয়তনে আরও বৃদ্ধি পাবে।

পুনর্বীকরণযোগ্য মুনাফা উৎপন্ন করে এমন দেশগুলোতে ব্যক্তিগত অর্থায়ন প্রলুব্ধ করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো প্রায়ই মূলধনের খরচকে অসহনীয় করে তোলে। যদিও আফ্রিকা বিশ্বের স্বল্প-উন্নত মহাদেশ, যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মহাদেশ ইউরোপের চেয়ে বেশি খরচ হয়। তাহলে কেন একজন বিনিয়োগকারী আফিকা মহাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে বিনিয়োগ করবেন? বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে যথার্থ করে তোলার জন্য আমাদের তীক্ষ্ণ হাতিয়ার দরকার, যেমন- অর্থ প্রদান না করা, চুক্তি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে গ্যারান্টি বা মুদ্রার অস্থিরতার মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি। 

এই উপায়ে বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহী করতে আমাদের অবশ্যই আরও বেশি জনসাধারণের অর্থকে লক্ষ্য করতে হবে। এটি শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বের পরিবর্তনে অর্থায়নের জন্য নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতি ও ক্ষয়পূরণের জন্য জনগণের তহবিল খালি করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা কীভাবে ক্ষয়ক্ষতি এবং ক্ষতি পূরণে অর্থায়ন করি, সেই সঙ্গে জলবায়ু সংকটকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থাপত্যের সংস্কার সম্পর্কে কপ২৯-এ মানসম্মত আলোচনা হতে বাধ্য। তবে নিশ্চিত যে, জলবায়ু মোকাবিলায় বিশ্বের আরও তহবিল প্রয়োজন এবং দ্রুতই তা প্রয়োজন। ইতিহাস বলে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমরা দরকারি তহবিল সংগ্রহ করি, এটা এখন অনেকটাই রাজনৈতিক ইচ্ছার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
 
লেখক: সভাপতি, জাতিসংঘের কপ২৯ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও বাদ পড়ার সংস্কৃতির অবসান হোক

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১১ পিএম
সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও বাদ পড়ার সংস্কৃতির অবসান হোক
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

কয়েক বছর আগে আমার এক ছাত্র বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে সরকারি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে আমার বাসায় আসে। ওই সময়ে তার আনন্দের সীমা ছিল না। ওই মুহূর্তটি ছিল তার জীবনের সর্বোচ্চ আনন্দের। একজন ছাত্রের পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার আনন্দ যে কত বেশি, সেটি প্রতিবছর ফলাফল প্রকাশ হলে নিজের ছাত্রদের দেখলেই বুঝতে পারি। অনেক শিক্ষার্থীই বিসিএস পরীক্ষায় পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়াকেই চূড়ান্ত ফল হিসেবে ধরে নেয়। এমনকি তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবাই সেটিই মনে করেন। 

আমার ওই ছাত্রের বেলাতেও তেমনটিই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় কয়েক মাস পরে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ হওয়ার পর আমাকে ফোন করে জানায় যে, প্রজ্ঞাপনে তার রোল নেই। আমি ওই ছাত্রের আনন্দের মুহূর্তটি পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর যেভাবে অনুভব করতে পেরেছিলাম আবার দুঃখের মুহূর্তটিও সেভাবেই অনুভব করলাম প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর। প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ যাওয়ার মূল কারণ কী- তা আজও আমরা কেউ জানতে পারিনি। হয়তো বিষয়টি রাজনৈতিক হতে পারে। আমি ওই ছাত্রকে খুব ভালোভাবে জানি যে, সে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না।

 তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, তার পরিবারের কেউ কি তাহলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল? সেটা হলেও কি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী তার মেধা প্রমাণ করার পর প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ দেওয়া যায়? বিষয়টির যুক্তিতর্ক অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু আমি সেই যুক্তিতর্কে যেতে চাই না। 

একজন মেধাবী ছাত্র দীর্ঘদিন থেকে স্বপ্ন আঁকে, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে সে দেশের সেবা করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন যদি সফলতার চূড়ান্ত শিখরে যাওয়া সত্ত্বেও পূরণ না হয়, তাহলে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে! 

গত কয়েক দিন থেকে শুনতে পাচ্ছি বিগত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে যাদের নাম পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে এবং যারা চাকরিতে যোগদান করেছেন, তাদের পুনরায় ভেরিফিকেশন করা হবে। বিষয়টি আমার কাছে আশঙ্কাজনক মনে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার যুক্তি হচ্ছে, কেউ যদি চাকরিবিধি ভঙ্গ করে তাহলে তার শাস্তি অবশ্যই হওয়া উচিত। 

বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি আচরণ বিধিমালা রয়েছে ১৯৭৯ সালের। এটির নাম সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯। এটি ২০০২ সালে এবং ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এই আচরণ বিধিমালায় মোট ৩৪টি নির্দেশনা আছে। দেশে বা বিদেশে কারও কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে তার নির্দেশনা রয়েছে। শুধু নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। 

নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায়। সেখানে অসদাচরণের সংজ্ঞাও দেওয়া আছে। যেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো  হয়েছে- অসঙ্গত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলাহানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। উল্লিখিত বিধানাবলি অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি অনিবার্য হওয়া উচিত। 

কিন্তু মেধা প্রমাণ করার পরও যদি রাজনৈতিক কারণে কোনো শিক্ষার্থী চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ে সেটির চেয়ে ভয়াবহ কিংবা দুঃখজনক ওই শিক্ষার্থীর জন্য আর কিছু হতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল থাকবে- এমনটি স্বাভাবিক। কিন্তু বিগত সময়ে শুধু রাজনৈতিক কারণে যাদের নাম প্রজ্ঞাপনে তোলা হয়নি, সে বিষয়ে সবারই আপত্তি থাকার কথা। কিংবা ভবিষ্যতেও যদি এমন প্রক্রিয়া চলমান থাকে তবে সেটির প্রভাবও নেতিবাচক হিসেবে ধরা যায়।

আমাদের সমাজে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা বিগত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধীদের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের মৌন সমর্থক। হয়তো এ বিষয়টি নতুন করে প্রমাণ করার সুযোগ তারা পাবে না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় আন্দোলনে অংশ নিয়েছে কিন্তু পিএসসির কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও যদি প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ যায়, তাহলে তার সেই দুঃখ কীভাবে মিটবে?

কয়েকদিন আগে আমার একজন ছাত্র আমার অফিসে এসে তার এমন অসহাত্বের আশঙ্কা নিয়ে আলাপ করছিল। এমনকি সে চাকরির জন্য চেষ্টা না করে কীভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো যায়, সেই রাস্তাও খুঁজছে। সে মনে করে, একটি চাকরির পরীক্ষায় যে পরিশ্রম করতে হয়, তার পর যদি চূড়ান্তভাবে কোনো কারণে প্রজ্ঞাপন থেকে নাম বাদ যায় তাহলে তখন যে ধরনের হতাশা তাকে আঁকড়ে ধরবে সেখান থেকে সহজে বের হওয়া সম্ভব হবে না।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে দেশের মেধাবী তরুণরা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আবার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেও তরুণদের অংশগ্রহণ রয়েছে। অন্যদিকে দেশের অসংখ্য মেধাবী তরুণ বেকার রয়েছে। এর আগে আমরা তরুণদের নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি, সেমিনার এবং আলোচনায় অনেক প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছি। এখন তরুণদের হাতেই রাষ্ট্রের চালিকা-চাবি।

 দেশের মেধাবীরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ বিষয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ, হিসাব-নিকাশ, আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত দেশের যে সংস্কার কাঠামো আমরা পেতে যাচ্ছি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের কাছে কর্মসংস্থান এবং তৎসংশ্লিষ্ট নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গটি অত্যন্ত আলোচিত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কর্মসংস্থান সংকটে বেকারত্বের হার বেড়েছে। 

অতিমাত্রায় হতাশ হয়েছে উচ্চশিক্ষিতরা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণদের অনেকের জীবন বিষাদময় হয়ে উঠেছে। ফলে এই সরকারের পক্ষ থেকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কী এবং কেমন থাকছে, সেটি খুঁজে বেড়াচ্ছে তরুণরা। বেকারদের অনেকে পরিশ্রম করে একটি চাকরির জন্য পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরও যদি তার পরিবারের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড কিংবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততার কারণে প্রজ্ঞাপন থেকে নাম বাদ যায়, তাতে শঙ্কা প্রকাশ করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।

 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

বাংলাদেশের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কী হবে

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৯ পিএম
বাংলাদেশের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কী হবে
মুন্সি ফয়েজ আহমদ

যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি নতুন নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আগেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পুনরায় তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি অন্যদের থেকে অপেক্ষাকৃত একটু আলাদা। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ব্যতিক্রম কিছু করে ফেলতে পারেন বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

 অনেকেই এ বিষয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সম্পৃক্ততা কিছুটা কমিয়ে আনতে পারেন। গতবার যখন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন ন্যাটোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমিয়ে এনেছিলেন। ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ বহুভাবে কমানো হয়েছিল। ন্যাটো সদস্যদেশগুলো আবারও সেই অবস্থায় চলে যেতে পারে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ হয়নি। যেসব যুদ্ধ চলমান ছিল সেখান থেকে সরে আসার জন্য, অর্থাৎ যুদ্ধ থামানোর 
জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এবারও সে রকম হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বাংলাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য যেকোনো দেশ, সবাই জাতীয় স্বার্থেই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে থাকে। জাতীয় স্বার্থ বলতে প্রত্যেকেই নিজ দেশের স্বার্থকে গুরুত্বসহকারে দেখে। তবে ব্যক্তিবিশেষে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকতে পারে। সেই পার্থক্যগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সূক্ষ্ম বা মোটা দাগের হয়ে থাকে। পররাষ্ট্র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু নীতিমালা আছে। তারা সেই নীতিমালাগুলোই মোটামুটিভাবে অনুসরণ করে থাকে। ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান- উভয় দলই দেশের ভেতরে, অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট হোক বা রিপাবলিকান হোক, সম্পর্কগুলো বেশি পরিবর্তন হয় না। 

আমরা পেছন থেকে দেখে সামনের দিকে কী হবে সেই চিন্তা করি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথার মধ্যেও এটি ছিল যে, যুদ্ধ তিনি পছন্দ করেন না। সে জন্য মনে করা হচ্ছে, যেখানে যেখানে যুদ্ধ আছে বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সেটার ওপরে বড় ধরনের প্রভাব আসতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভালো সম্পর্ক আছে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক হয়, সেভাবে চেষ্টা করতে পারেন এবং সেটা হওয়া সম্ভব। আরেকটা বিষয় অনেকে মনে করার চেষ্টা করেন, যেমন- এবারের নির্বাচনে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা অনেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। তারা আশা করেছেন যে, তিনি হয়তোবা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি রক্ষার জন্য চেষ্টা করবেন। 

যেখানে তার বেশি কিছু করার আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ ইসরায়েলের স্বার্থ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে- এই বিষয়ে অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন। সেখানেও বড় রকমের কোনো পার্থক্য হবে না। তবে পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিস্তারণে উনি গুটিয়ে থাকা প্রকৃতির মানুষ। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখানো অথবা বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারগুলো কমে যাবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের যেভাবে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে, সেই চেষ্টাটা একটু কমে আসতে পারে। তবে পররাষ্ট্রনীতির ধরন পাল্টাবে না।

 বিশেষ করে আমাদের অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে। অনেক বেশি প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কটুকু বজায় রাখার জন্য আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক সুবিধাসহ অন্য যেসব সুবিধা আমরা পেয়ে আসছিলাম, সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। অর্থনৈতিক যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো কী করে কাটিয়ে ওঠা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে ডেমোক্র্যাটের মতো রিপাবলিকানরা এত বেশি ব্যস্ত থাকে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীনের সঙ্গে  সম্পর্ক কেমন হবে। আগামী দিনেও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলবৎ থাকবে বলে মনে হয়। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। সামরিক শক্তির দিক থেকেও দেশটি সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কাজেই চীন সবদিক থেকেই বৈশ্বিকভাবে তার প্রভাব বাড়িয়ে চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার আগের শাসনামলে চীনের বিরুদ্ধে প্রথম শুল্কারোপ করেন। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেই শুল্ক বজায় রাখেন। এসব কিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনকে এক রকম কোণঠাসা করে রাখা।  

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন। এর ওপর নির্ভর করবে চীনের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমবে নাকি বাড়বে। বলা বাহুল্য, এর প্রতিক্রিয়া পৃথিবীজুড়েই ছড়িয়ে পড়বে। এটি মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ আছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন বিদ্যমান পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবেন না। বরং বিদ্যমান নীতি গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে তিনি দেখাতে চেষ্টা করবেন যে, পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি কিছু করছেন। চীনের বিরুদ্ধে নানা রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে সম্ভবত তিনি তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করবেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে চীনের বিরুদ্ধে সহজে প্রভাবিত করা যায়। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে। একই সঙ্গে ইউক্রেনের প্রতি চাপ বৃদ্ধি হতে পারে। তবে ট্রাম্প বরাবরই বলছেন যে, তিনি যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগবে। 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা যায়, তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে। সেটা বাংলাদেশিদের জন্য ইতিবাচক হবে কি না, সেটাই বিবেচ্য। যেমন- অভিবাসীদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সংকুচিত হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে যে রকম চিন্তাভাবনা লক্ষ করা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন সেখানে সম্পূর্ণ নীতি অনুসরণ করতে নাও পারে। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে অতি উৎসাহের মাত্রাটা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে মনে হয়।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বরাজনীতিতে নতুন চমক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বরাজনীতিতে নতুন চমক
রায়হান আহমেদ তপাদার

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জয়ের জন্য ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোটের দরকার হলেও তার অন্তত ২৭৯টি ভোট নিশ্চিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের পক্ষে ২২৩টি ভোট। সুতরাং সিনেটের নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকানদের হাতে যাচ্ছে এবারের নির্বাচনে। মার্কিন আইনসভার উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ- পূর্বাভাস বলছে উভয় ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে রিপাবলিকান পার্টি। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকা আমাদের একটি অভূতপূর্ব এবং শক্তিশালী ম্যান্ডেট দিয়েছে।’ বিজয়ের পর ভাষণকালে ইলন মাস্ককে তিনি ‘স্টার’ বলে অভিহিত করেছেন।

 ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে বেশ নজর থাকবে। একটা হলো ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে থামানো যায় এবং রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক কী দাঁড়ায়। ট্রাম্প নির্বাচনকালে অনেকবার বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে এ অবস্থা কোনোভাবে ঘটত না। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের ওপর তার বিশেষ নজর থাকবে। কারণ, ইউরোপের কনজারভেটিভ পার্টিগুলো বিভিন্ন জায়গায় জিতে যাচ্ছে। তা ছাড়া অনেক দেশ যুদ্ধের ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা করছে। সুতরাং ইউক্রেনের ব্যাপারে একটা নজর থাকবেই। দ্বিতীয় নজর থাকবে ফিলিস্তিনে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে কোনো নতুনত্ব আনা যায় কি না, তা নিয়েও ট্রাম্প গুরুত্ব দেবেন। তবে এই মুহূর্তে বলা মুশকিল, সেখানে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসবে কি না। কোনো দল যদি ইসরায়েলের ব্যাপারে নতুনত্ব আনতে পারে তাহলে তা হতে পারে রিপাবলিকান পার্টি। তবে দলের মধ্যে এখনো কিছু অস্থিতিশীলতা রয়ে গেছে। তাই পরিবর্তন আনা খুব কঠিন।

বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবার অনেকের আগ্রহ থাকবে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ব্যাপারে ট্রাম্পের আমেরিকা কী সিদ্ধান্ত নেয়। মনে হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীনের ব্যাপারেও তার নজর থাকবে। চীন, রাশিয়া ও ভারত মিলে ইতোমধ্যে একটি কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। সেই জায়গায় ট্রাম্পের বাড়তি একটা চেষ্টা থাকবে যেন ভারতকে আরও কাছে টানতে পারেন। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে বলা যায়, ইতোমধ্যে রিপাবলিকান পার্টি নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে, যদিও তারা বড় রকমের কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না। বরং এখানে নির্বাচিত সরকার যাতে তাড়াতাড়ি হয়, সেটা দেখার ব্যাপারে আরও বাড়তি কথাবার্তা বলতে পারে। যেহেতু ভারত তথা মোদির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হওয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে, তার একটা প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও থাকবে। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের এই সম্পর্ক বাংলাদেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। সে জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। 

সম্প্রতি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি টুইট করেছেন। এ ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অব্যাহত মনোযোগ দেখা গেছে। যেমন- শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় ট্রাম্পের সভায় প্রিয়া সাহার মন্তব্য ঘিরে সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা উঠেছিল। তখন বলা হয়েছিল, এটা বিএনপি-জামায়াত লবি করছে। সুতরাং ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন হাসিনা সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছিলেন, এবারও তিনি একই কথা বলেছেন। এবার বলার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক কারণ থাকতেও পারে, যদিও তিনি নিয়মিতভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে নজর রাখেন। এটা বলা যায়, এ ব্যাপারে তিনি এখনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা যাতে ঝামেলায় না পড়ে, সেদিকে আমেরিকা আরও বড় আকারে সব সময় একটা চাপ রাখবেই। সেটা যে সরকারই থাকুক না কেন। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নানা সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- অর্থনৈতিক, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিক ইত্যাদি।

সুতরাং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখবে, সেটিও ভারতের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত। তবে আমাদের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে এখনো বলা কঠিন। মনে হচ্ছে, খুব একটা পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে আমেরিকা একই ধরনের কথা বলে থাকে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থেকে গণহত্যা বলা হয়েছিল এবং বার্মা অ্যাক্ট নামে একটি বিলও পাস করা হয়েছিল। আবার তারা রোহিঙ্গা অ্যাক্টও নিয়ে এসেছে। তবে ট্রাম্পের আমলে পরিস্থিতি কী হবে, তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ভাটা পড়তে পারে, আবার উল্টোও হতে পারে। কিন্তু এটা অনেকটা নির্ভর করে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী দাঁড়াচ্ছে তার ওপর।

 বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অভিবাসন-প্রক্রিয়া। সেখানে মূল সমস্যা আসে  দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। এসব অঞ্চল থেকে অবৈধভাবে লোক মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করে। যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী ছাড়া কোনোভাবে চলতে পারার কথা নয়। কারণ তার নতুন লোকবল দরকার পড়বে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটি আইনি পদ্ধতিতে করতে চায়। সমস্যা হলো, লাতিন আমেরিকা থেকে যেভাবে লোকজন আসে, তাতে সেখানে হিস্পানিক সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি অনেক জায়গায় যত লোক ইংরেজি বলে, তার চেয়ে বেশি লোক স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। এর মূল কারণ হলো, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা লোকসংখ্যা। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অভিবাসনের হার এত কম যে, এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। সেটা তেমন গুরুত্ব বহন করে না। মূলত তার সমস্যা হিস্পানিক জনসংখ্যা নিয়ে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র শক্ত একটা অবস্থান নেবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৈধ অভিবাসন নিয়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেবে বলে ধারণা করা যায়। কারণ এ হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তারা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার কৌশলের বাইরে যেতে পারবে বলে মনে হয় না।

এ অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন, তাহলে বাংলাদেশ কোয়াডে যুক্ত থাকল কি থাকল না, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি নজর থাকবে না। সুতরাং বাংলাদেশকে অবস্থান ঠিক রাখতে হলে নিজেদেরই চিন্তাভাবনা করতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর রাশিয়ার মতো চীনের তরফ থেকেও আনুষ্ঠানিক কোনো অভিনন্দনবার্তা পাঠানোর খবর পাওয়া যায়নি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং জানিয়েছেন, মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত এবং ট্রাম্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করার পর চীনও নিয়ম অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো পালন করবে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবারও নির্বাচিত হওয়ায় চীনের সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

 নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্পকে নিয়ে চীনা নাগরিকদের মধ্যে বাড়তি একটা আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছিল। অনেকেই তাকে পছন্দ করেন এবং প্রায়শই ‘কমরেড ট্রাম্প’ নামে ডেকে থাকেন। তবে চীনের যেসব ব্যবসায়ী যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করেন, তাদের মধ্যে বেশ উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। এর কারণ নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গিয়ে বিদেশি পণ্যের ওপর কর বাড়াবেন। ওদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের নেতারা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেও এখনো সে ধরনের কোনো বার্তা দিতে দেখা যায়নি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। পুতিন আদৌ আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানাবেন কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছেন রুশ কর্মকর্তারা। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারের সময় ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তবে বাস্তবে তার কথার প্রতিফলন কতটুকু দেখা যাবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।

আগামী ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে সিনেটে আনুষ্ঠানিকভাবে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা করা হবে। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস। ভোট গণনা শেষে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম ঘোষণা করবেন। ২০২০ সালে সিনেটের সেই ভোট গণনার সময়েই উত্তেজিত জনতা ক্যাপিটল হিলে হামলা করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে ভোট গণনা পাঠ করছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। এরপর ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। একই সময় জো বাইডেন হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাবেন। ওই শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ‘রূপান্তরকালীন সময়’। ওই সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বাছাই করেন এবং পরিকল্পনা তৈরি করবেন। 

২০২৪ সালের নির্বাচন তার ভাগ্যের চাকাকে এমনভাবে ঘোরাচ্ছে, যা হয় তার ভঙ্গুর বন্ধনকে সহজেই ছিন্ন করতে পারে অথবা সংগ্রাম ও অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে চালিত করতে পারে। অনেকের মতে, সামনের দিনগুলো একটি নতুন বন্দোবস্তের সূচনা ঘটাতে পারে, যেখানে প্রতিটি অঞ্চলের শক্তিকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হবে। অন্যদের কাছে এটি তাদের প্রিয় সবার জন্য ধ্বংসের পরিখা, রক্ত দিয়ে অর্জিত এবং প্রাচীন ও পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে কথিত শপথ দ্বারা আবদ্ধ একটি ইউনিয়নের সমাপ্তি। সেখানে শান্তি বা যুদ্ধ যা-ই বিরাজ করুক না কেন, আসন্ন যুগ এমন সব হিসাব-নিকাশের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা নিশ্চিতভাবে যেকোনো বিজয়ীর তরবারি যেমনটা করে তেমনভাবে এ ভূখণ্ডকে রূপান্তর করবে। যা-ই হোক, এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, পরবর্তী চার বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশ ও যুদ্ধ আক্রান্ত বিশ্ব পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেন।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সাহসী পদক্ষেপ জরুরি

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ এএম
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সাহসী পদক্ষেপ জরুরি
বান কি-মুন

জলবায়ুসংকটের কারণে কৃষি খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং সেটা মোকাবিলা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে জলবায়ু মোকাবিলায় আমার নেতৃত্বের ভূমিকা অনেক বড় ছিল। কপ-২৯ সম্মেলনে আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করি। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অনুদান ও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। জলবায়ুসহনশীল ফসল, টেকসই চাষাবাদ অনুশীলন, উন্নত পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনার কৌশল বিকাশের জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়তা শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও স্থিতিশীল ও নিরাপদ বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থায় অবদান রাখবে।...

এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯) হতে যাচ্ছে আজারবাইজানের বাকুতে। বিশ্ব নেতারা এবারের সম্মেলনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় নতুন করে অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছেন। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ুসংকটের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হবে। আবহাওয়ার বৈরী প্রভাব এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করা যায়- সেটাই এবারের আলোচ্য বিষয় হবে। আমরা উত্তর আফ্রিকা, মেক্সিকো, ভারত 
এবং সৌদি আরবজুড়ে মারাত্মক তাপপ্রবাহ 
উপলব্ধি করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়েও অনেক খরা পড়েছে, যা ইতিহাসে রেকর্ড। ব্রাজিলের জলাভূমিতে ভয়ানক দাবানল দেখেছি। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ভঙ্গকারী হারিকেন ঝড় হয়েছে। জলবায়ু কোনো সীমানা জানে না এবং কাউকে রেহাই দেয় না। 

এবারের সম্মেলন জলবায়ুসংকটের প্রথম সারিতে থাকা দুর্বল দেশগুলোকে রক্ষায় বিশ্ব নেতাদের কাছে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশেষ করে আফ্রিকায় জলবায়ু প্রভাবের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার খরচ অনেক বেশি। আফ্রিকান দেশগুলো জলবায়ুর চরম প্রভাবের কারণে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ হারাচ্ছে। কোনো কোনো দেশ তাদের জাতীয় বাজেটের ৯ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ করেছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে। 
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা অনুমান করছে, দক্ষিণ আফ্রিকার সাহারায় জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি যেসব সম্প্রদায় রয়েছে তাদের রক্ষা করতে আগামী দশকে বার্ষিক ৩০-৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে। জলবায়ুসংকট মোকাবিলা না করে আমরা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে পারব না। জলবায়ু সংকটের সমাধান না করলে সমৃদ্ধ ও স্থিতিস্থাপক বিশ্ব সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারব না।

জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় আর্থিক ব্যয়ের মাত্রা দিন দিন অনেক বাড়ছে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অনুসারে ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রায় ৮৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা করা হয়েছিল। তবুও বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন অনুপাতিকহারে দিন দিন কমে যাচ্ছে। জলবায়ু অর্থায়নের প্রায় ৯০ শতাংশ জলবায়ুসংকটের প্রভাবগুলো মেটানোর জন্য খরচ হয়। সংকট কাটিয়ে দেশগুলোর স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে বহির্বিশ্বের সহযোগিতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বিশ্বের সামনে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যারা ইতোমধ্যেই ঋণের বোঝা বহন করে পঙ্গু হয়েছে। আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে জলবায়ুর বৈরিতা প্রশমন এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার আর্থিক সহযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানাই। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় উভয়ই ক্ষত্রেই পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত হোক। 

আর্থিক ভারসাম্য মানে চ্যালেঞ্জের স্কেল ভেদে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলার জন্য অনুদানভিত্তিক পাবলিক ফাইন্যান্স বাড়ানো। এটি অবশ্যই কপ-২৯-এ আলোচনা করা নতুন যৌথ পরিমাপকৃত লক্ষ্যের (NCQG) মূল উপাদান হতে হবে, যেখানে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বয় তহবিলের অর্থ পৃথক এবং সমান অগ্রাধিকার হিসেবে স্বীকৃত হতে হবে। সমন্বয় তহবিল সম্প্রসারণ ইতোমধ্যে জলবায়ুসংকটে বিধ্বংসী প্রভাবের সম্মুখীন হওয়া দেশগুলোকে রক্ষা করতে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করেছে। 

কপ-২৯ সম্মেলনে সমন্বয় অর্থায়নের ওপর বেশি জোর দিতে অবশ্যই সাহসী ও রূপান্তরমূলক হতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে সমন্বয় অর্থ তহবিলের আলোচনার জন্য আয়ারল্যান্ড এবং কোস্টারিকা থেকে দুজন মন্ত্রীকে প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা এই সম্মেলন চলাকালীন পরামর্শ এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন। এটি নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল (NCQG) আলোচনার মধ্যে সমন্বয় তহবিলের গুরুত্ব দেওয়াটা ইতিবাচক হবে। 

কপ-২৯ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের অবশ্যই পাবলিক অ্যাডাপ্টেশন ফাইন্যান্স বাড়ানোর জন্য উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এটিকে ক্ষয়ক্ষতি থেকে আলাদাভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। এই অঙ্গীকারগুলো অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে করতে হবে। সবচেয়ে দুর্বলদের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া সরল করাসহ আরও ভালো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু এটি করার মাধ্যমে আমরা সমন্বয় তহবিলের ব্যবধানকে সংকুচিত করা এবং অর্থ সংগ্রহে বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি যাওয়ার আশা করতে পারি। 
জলবায়ুসংকটের কারণে কৃষি খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং সেটা মোকাবিলা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে জলবায়ু মোকাবিলায় আমার নেতৃত্বের ভূমিকা অনেক বড় ছিল।

 কপ-২৯ সম্মেলনে আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করি। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অনুদান ও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। জলবায়ুসহনশীল ফসল, টেকসই চাষাবাদ অনুশীলন, উন্নত পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনার কৌশল বিকাশের জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়তা শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও স্থিতিশীল ও নিরাপদ বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থায় অবদান রাখবে।

কপ-২৯ সম্মেলনে জলবায়ু নেতৃত্বের জন্য নতুন যুগের জন্য বড় সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু সম্মেলনে যারা নেতা আছেন আমি তাদের সাহসী প্রতিশ্রুতি উপস্থাপন করার আহ্বান করছি, যা চ্যালেঞ্জের মাত্রাকে প্রতিফলিত করে। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ প্রক্রিয়াগুলোকে সরলীকরণ করা, দুর্বল দেশগুলোর জন্য অর্থায়নের সুবিধা বৃদ্ধি করা ও অর্থ সমন্বয় করা এবং ক্ষয়ক্ষতির সমান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা নিশ্চিত করা।
এখন বিশ্ব নেতাদের বিশ্ব নেতৃত্ব দেখানোর সময়। প্রশ্ন থেকে যায়- আমরা কি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উঠতে পারব?

লেখক: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল