
মহানগরী বলতে বেশ একটি বড় এলাকা বা অঞ্চলকে বোঝায়। আমরা যাকে পুরান ঢাকা বলে জানি, তার বিস্তৃতি বুড়িগঙ্গার উত্তর পাড় থেকে পুরোনো রেললাইন সড়ক পর্যন্ত। অর্থাৎ এর উত্তর প্রান্তে অবস্থিত নগর ভবন বা ঢাকা সিটি করপোরেশন ভবন। পৃথিবীর যেকোনো মহানগরীর তুলনায় এই ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি, এমনকি মুম্বাই কিংবা হংকংয়েও এত বেশি ঘনত্ব চোখে পড়ে না। ঢাকার উচ্চ জনঘনত্ব গড়ে উঠেছে নিচু উচ্চতার ঘরবাড়িতে। প্রধানত পুরোনো দুই-তিন-চারতলা দালান অথবা বস্তির একতলা সেমিপাকা বাড়ি, কাঁচা ঘর বা ঝুপড়ি হচ্ছে পুরান ঢাকার আবাসিক ধরন।
ব্যবসা-বাণিজ্যও পরিচালিত হচ্ছে একই ধরনের ভবনাদি বা দালানে। সম্প্রতি পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বহুতল দালান তৈরি হচ্ছে। ঢাকা মূলত গড়ে উঠেছে ষোলো থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সাড়ে ৩০০ বছরে। একেবারে গোড়ার দিকের কিছু ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভবন বা মসজিদ বা দুর্গ এখনো টিকে আছে। ঢাকার বেশির ভাগ বাড়িঘর বিগত এক শ থেকে দেড় শ বছরের মধ্যে নির্মিত। পুরান ঢাকার প্রায় গোটা এলাকাই গড়ে উঠেছে প্রাক-শিল্প বা প্রাক-মোটরযান যুগের শহর হিসেবে। এতে সড়কবিন্যাস অত্যন্ত অগোছালো, এলোমেলো।
অধিকাংশ রাস্তাই আঁকাবাঁকা এবং সরু, এমনকি খুবই সরু। প্রশস্ত সড়ক বলতে ছিল শুধু উত্তর-দক্ষিণ জনসন রোড, নবাবপুর রোড এবং পূর্ব-পশ্চিশে ইসলামপুর-পাটুয়াটুলী রোড ও মদনমোহন বসাক রোড। এসব সড়কের প্রশস্ততা বড়জোর ২০-৪০ ফুট। অন্যান্য রাস্তা আসলে গলি, এগুলোর প্রস্থ ২০ ফুটের নিচে। অনেক গলি আছে, যার প্রস্থ ৪-৬ ফুট। ১৯৫০-এর আগে পর্যন্ত এ ধরনের সড়কব্যবস্থা নিয়েই শহর চলত। কেননা তখন শহরের লোকসংখ্যা ছিল অনেক কম; বর্তমানের ডিসিসি এলাকার ৭৫ লাখের জায়গায় মাত্র ৩ লাখ, পুরান ঢাকার বর্তমান ২০ লাখের জায়গায় বড়জোর ২ লাখ। যানবাহনের সংখ্যাও ছিল খুব কম। অধিকাংশ মানুষ ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা, হেঁটে বা সাইকেলে চলাফেরা করত।
১৯৪৭ থেকে ২০০৩ সাল- এই দীর্ঘ সময়ে পুরান ঢাকার নতুন সড়ক তৈরি হয়েছে একেবারে হাতে গোনা কয়েকটি, যেমন- ধোলাইখাল সড়ক (পূর্ব-পশ্চিম প্রলম্বিত), নর্থ-সাউথ রোড (উত্তর-দক্ষিণ প্রলম্বিত), নারিন্দা, যাত্রাবাড়ী সড়ক এবং পুরোনো রেললাইন সড়ক। এখন বুড়িগঙ্গার ওপর দুটি সেতু তৈরি হয়েছে, এই সেতু দুটি দিয়ে হাজার হাজার গাড়ি প্রতিদিন নদী পার হচ্ছে এবং এগুলো পুরান ঢাকার ভেতর দিয়েই যাতায়াত করে। পুরান ঢাকায় অনেক পাইকারি বাজার অবস্থিত। এ ছাড়া কাঁচাবাজার, খুচরা ব্যবসার বাজার, কোর্ট-কাচারি, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজও রয়েছে। যেহেতু পুরান ঢাকা পাইকারি ব্যবসা-বাণিজ্যেরও কেন্দ্র, সে কারণে এখানে দূরপাল্লা এবং মাঝারি ও নিকটবর্তী নানান সাইজের ট্রাক আসা-যাওয়া করে, বিভিন্ন স্থানে পার্কিংও করে।
পুরান ঢাকার অধিকাংশ রাস্তাই এত সরু যে, ফুটপাত বা সাইডওয়াক রাখার কোনো সুযোগই থাকে না। সাধারণত একটি বড় শহরের মোট ভূমির ১৫-২৫ ভাগ বরাদ্দ করতে হয় রাস্তার জন্য। সে জায়গায় ঢাকা মহানগরীতে রাস্তার পরিমাণ বড়জোর ৮ ভাগ, পুরান ঢাকায় এই অনুপাত আরও কম, সম্ভবত ৫-এর বেশি নয়। অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব অস্বাভাবিক রকম বেশি। ফলে সব সময়েই পুরান ঢাকায় যানজট লেগে থাকে। অধিকাংশ সড়ক এতই সরু যে, সেগুলো দিয়ে মোটরযান চলাচল করতে পারে না, অথবা বড়জোর একদিকে চলতে পারে। রিকশার সংখ্যাও এত বেশি যে, ‘পিক আওয়ারে’ পিঁপড়ার মতো পিল পিল করে একটার পেছনে একটা এগোতে পারে। শুধু যে রাস্তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কম তাই নয়, অধিকাংশ রাস্তার সারফেসের অবস্থাও ভালো নয়, ফলে যান চলাচলে অসুবিধা হয়। গতিও শ্লথ হয়ে যায়। ছোটখাটো দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
ঢাকার সড়কব্যবস্থা কিংবা যানজট পরিস্থিতির উন্নতি করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। উপরন্তু জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে, পুরান ঢাকার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, অথবা নতুন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে। ঢাকার কোনো সড়ক প্রশস্ত করা বা ভূমি অধিগ্রহণ করে নতুন সড়ক নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব। ব্যাপক স্কেলের ‘আরবান রিনিউয়াল’ বা ‘নগর নবায়ন’ ছাড়া পুরান ঢাকার যানজট হ্রাস করা কঠিন। দীর্ঘ মেয়াদে সদরঘাট থেকে উত্তরের টঙ্গী, গাজীপুর বা আরও দূরবর্তী কোনো স্থানের সঙ্গে (অত্যন্ত ব্যয়বহুল) পাতাল রেল বা উড়াল সড়ক (ওভারহেড এক্সপ্রেসওয়ে) যোগাযোগ হয়তো সমস্যা কিছুটা লাঘব করতে পারবে। বিকল্প হিসেবে পুরান ঢাকা থেকে বেশ কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড বাইরে স্থানান্তর করতে হবে, মানুষও সরাতে হবে। শুধু বিকল্প নয়, অন্য উপায়ের পাশাপাশি এ কাজটি করতে হবে।
ঢাকার যানজটের সঙ্গে বাতাসদূষণের সম্পর্ক নতুন ঢাকার চেয়ে সম্ভবত কিছুটা কম সংকটাপন্ন এ কারণে যে, পুরান ঢাকায় মোটরযানের ব্যবহার বা চলাচল তুলনামূলকভাবে কম। তবে ডিজেল ব্যবহারকারী ট্রাক পুরান ঢাকায় যথেষ্ট চলাচল করে, মিনি ট্রাকের ব্যবহারও যথেষ্ট রয়েছে। এসব যানবাহন থেকে ধোঁয়া নির্গমনের মাধ্যমে বাতাসদূষণ হচ্ছে। দুই স্ট্রোকের বেবিট্যাক্সিও বাতাসদূষণের জন্য দায়ী ছিল।
সম্প্রতি এ ধরনের যান নিষিদ্ধ করায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। যানবাহনের হর্নের কারণে যে শব্দদূষণ, তারও প্রকোপ নতুন ঢাকার তুলনায় পুরান ঢাকায় কম। উদাহরণস্বরূপ একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মগবাজার, ফার্মগেট কিংবা মৌচাকে যখন শব্দদূষণ মাত্রা ১০৩-১০৪ ডেসিবেল, সদরঘাটে তখন ৮৭। বলা বাহুল্য, এই মাত্রাও গ্রহণযোগ্য মাত্রার অনেক ওপরে। ঢাকায় চলাচলকারী ট্রাক, মিনিট্রাক ইত্যাদিও অধিকাংশ বেশ পুরোনো এবং সত্যিকার অর্থে ফিটনেসহীন। বায়ুদূষণ হ্রাস করতে হলে ফিটনেসহীন বা ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পেট্রল বা গ্যাসোলিনের মানও নিশ্চিত করতে হবে। তবে কাজটি মোটেও সহজ নয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে, যানজট নিরসনে মোটরযানের ব্যবহার সীমিত রাখার দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। (বই সূত্র: ঢাকা এখন ও আগামীতে)
লেখক: নগরবিদ এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়