কোভিড-১৯ মহামারিকে সেই সব দেশ ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে, যেসব দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, বিশেষায়িত তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো পর্যন্ত সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত রয়েছে; স্বাস্থ্যসেবার সবগুলো ধাপে রয়েছে প্রয়োজনীয় জনবল ও সাজসরঞ্জাম এবং কর্তৃপক্ষ সব স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে সমান গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থাপনা করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস ৭৩তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ কেবল একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা নয়, এটি এই সত্যকে দেখিয়েছে যে, ঘাত-প্রতিঘাতসহনীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া কিংবা স্বাস্থ্যের সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং পরিবেশগত নির্ধারকদের আমলে না নিয়ে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।’
সীমান্ত পেরিয়ে দেশে দেশে মানুষের স্বাস্থ্যকে তাৎক্ষণিক বিপন্ন করতে পারে- এমন পরিস্থিতিতে যেসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করতে সক্ষম সেগুলোই স্বাস্থ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা। নতুনভাবে জন্ম নেওয়া সংক্রামক রোগ থেকে শুরু করে ওষুধ প্রতিরোধী (অ্যান্টি মাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স) অণুজীব পর্যন্ত অনেক বিষয়ই স্বাস্থ্য নিরাপত্তাজনিত জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ও ক্রয় করতে সক্ষম, ধারাবাহিকভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী জনবল ও স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রীর জোগান দেওয়ার সক্ষমতাকে একটা দেশের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা অর্জন বলা যায়। সামগ্রীগুলোর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধবহির্ভূত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরঞ্জাম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী বিরূপ বা জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি শনাক্ত করা, যাচাই করা, রিপোর্ট করা, সাড়া দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে একটি দেশের সক্ষমতাকেও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা অর্জন বলে। মোটা দাগে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা হলো জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধ, শনাক্ত ও সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা।
বিশ্বের দেশগুলো ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্রমবর্ধমানভাবে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে এবং পরস্পর নির্ভরশীলভাবে বিকশিত হচ্ছে। মানুষ, পণ্য ও তাদের সম্পর্কিত পরিষেবাগুলো সহজেই এক অঞ্চল এবং এক দেশ থেকে বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন দেশে চলাচল করছে। এই বৈশিষ্ট্যটি জাতীয় ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তাব্যবস্থাকে জটিল করে তুলেছে। এটি একদিকে যেমন বাধা, অপরদিকে নতুন সুযোগও বটে। এতে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট জনস্বাস্থ্য দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমনটি দেখা গেছে কোভিড-১৯ মহামারিতে।
সাম্প্রতিক অন্যান্য ঘটনাতেও দেখা গেছে যে, বড় আকারের এবং গুরুতর জনস্বাস্থ্য জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বর্তমান প্রস্তুতি কত অপর্যাপ্ত। দক্ষিণ আমেরিকায় জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কিংবা পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাবের মতো বড় ঘটনা এবং কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের নির্মমভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, জনস্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রস্তুতি দরকার বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তার সব স্তরে। এ ধরনের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করতে পারে এবং সমাজের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
স্বাস্থ্য নিরাপত্তাব্যবস্থাকে উন্নত করা শুধু খরচের বিষয় নয়, বরং এটা একটা বিনিয়োগ। বিভিন্ন গবেষণার ফল থেকে বোঝা যায় যে, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা প্রস্তুতির জন্য যে খরচ হবে, এ বিষয়ে উদাসীন থেকে কোনো প্রস্তুতি না নিলে তার জন্য ক্ষতির অর্থমূল্য অনেক গুণ বেশি। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা প্রস্তুতির জন্য খরচের তুলনায় আসন্ন সত্যিকারের জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাৎক্ষণিক যে খরচ হতে পারে তা বহু গুণে বেশি। যদি স্বাস্থ্যনিরাপত্তা তথা স্বাস্থ্য খাতে বাজটে বরাদ্দ না বাড়ানো হয়, তবে জনস্বাস্থ্যের বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথে একটি অবিরাম বাধা হিসেবেই থেকে যাবে।
জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা জোরদার করার নানা চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এর সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। আমাদের মতো নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলো বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সম্পদ জোগাতে হিমশিম খেয়েছে। এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে আমাদের মতো দেশগুলোতে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন ও বিশেষায়িত মানবসম্পদ দ্রুত বৃদ্ধি করতে বাইরের সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এ ধরনের দক্ষ ও বিশেষায়িত জনবল স্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় নির্ধারক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে যাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে, তারা স্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থার সময় দ্রুত স্বাস্থ্যচাহিদার বিশাল ঢেউ সামাল দিতে বিরাট বাধার মুখোমুখি হয়েছে। যেমনটি দেখা গেছে কোভিড-১৯ মহামারির সময়।
এ সময় আরও একটি সমস্যা আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোকে পোহাতে হয়েছে। আয়-নির্বিশেষে সব দেশকে মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যচাহিদার বিশাল ঢেউ সামলাতে তীব্র বাজার প্রতিযোগিতার কারণে প্রয়োজনীয় মেডিকেল-সামগ্রী ও ওষুধ জোগাড় করতে নিদারুণ সংকটে পড়তে হয়েছে। নিকট অতীতের এ সংকট দেশগুলোকে তাদের এসব সামগ্রী উৎপাদনের সক্ষমতা কতটুকু এবং কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে তা চিহ্নিত করার তাগিদ দিচ্ছে। এটা দরকার এ কারণে, এ রকম তীব্র ও ব্যাপক জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় তার জন্য কতটুকু প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে তা জানা। এ ধরনের পরিস্থিতি অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার বিদ্যমান ব্যবস্থাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
এ ক্ষেত্রে কার্যকর সমন্বিত শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যনিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে অবদান রাখতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের বিরূপ ঘটনা ও হুমকিকে আরও ভালোভাবে প্রতিরোধ, শনাক্ত ও মোকাবিলা করতে পারে। এর ফলে বিশ্ব আরও স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ হয়ে উঠবে।
কয়েকটি গবেষণা এটা বিশেষভাবে দেখিয়েছে যে, একদিকে নির্ভরযোগ্য টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করার চেষ্টা; অপরদিকে জাতীয় ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়ন করার চেষ্টা- এ দুই চেষ্টার মধ্যে সমক্ষেত্র রয়েছে। ঘাত-প্রতিঘাতসহনীয় ও সাড়াদানে সক্ষম স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে যার উত্তর দরকার- (ক) কোন কোন ক্ষেত্রে সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে; (খ) স্বাস্থ্যব্যবস্থা, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ও অন্যান্য সেক্টরের সংযোগস্থলগুলো কোথায়; (গ) এসব সংযোগস্থলে বাধাগুলো কীভাবে অতিক্রম করা যায় এবং (ঘ) জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য বহু খাত ও বিষয়ভিত্তিক যেসব সুযোগ রয়েছে তা কীভাবে কাজে লাগানো যায়।
স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে- (ক) সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে এবং কীভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও ভালো স্বাস্থ্যনিরাপত্তায় অবদান রাখা যায় সে বিষয়ে ঐকমত্যে আসা; (খ) জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সেক্টরের কোন কোন অংশ ভূমিকা নেবে তা চিহ্নিত করা; (গ) একটি দেশ স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেক্টরে বহুপক্ষীয় ও বিষয়ভিত্তিকভাবে জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনায় কীভাবে অগ্রাধিকার নির্ণয় করবে, কর্মকাণ্ডগুলো পরিবীক্ষণ করবে এবং বাজেট বরাদ্দ করবে তা ঠিক করা; (ঘ) আন্তর্জাতিক অংশীদার ও উন্নয়ন সহযোগীরা খরচের কোন কোন ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করবে, কত ভালোভাবে সেটা করা যাবে এবং আর্থিক জোগান কীভাবে টেকসই থাকবে সে বিষয়ে সহাযোগিতা করা এবং (ঙ) বড় কী কী বাধা আসতে পারে তা চিহ্নিত করা।
এটি এককভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। মানবস্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে প্রাণীর স্বাস্থ্য, কৃষির স্বাস্থ্য, খাদ্যের নিরাপত্তা, পরিবেশের স্বাস্থ্য। এটাকে ‘এক স্বাস্থ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ‘এক স্বাস্থ্য সেক্রেটারিয়েট’-এর অংশীদার। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ‘এক স্বাস্থ্য’ দৃষ্টিভঙ্গিতে আন্তমন্ত্রণালয় সমম্বয়ের জন্য ‘এক স্বাস্থ্য সেক্রেটারিয়েট’ গঠিত হয়। অদূর ভবিষ্যতে এর সঙ্গে যুক্ত হবে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে মহামারির মতো জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজে নামতে হয়। ভবিষ্যৎ জরুরি জনস্বান্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিষয়টি আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
লেখক: জনস্বাস্থ্যবিদ ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)