ঢাকা ১১ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
English

দীর্ঘশ্বাস, দুর্ভোগ এবং ডলার

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪, ১০:৪০ এএম
দীর্ঘশ্বাস, দুর্ভোগ এবং ডলার
রাজেকুজ্জামান রতন

ঢাকা বিমানবন্দরে এত মানুষের ভিড়, আহাজারি আর হতাশা অনেক দিন দেখেনি দেশের মানুষ। বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে, পাড়া-পড়শিদের দোয়া নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন মালয়েশিয়া যাবেন বলে। বাবার পেনশনের টাকা, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে, জমি বন্ধক রেখে, মায়ের গহনা কিংবা গরু বিক্রি করে তাদের অনেকেই মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য টাকা জমা দিয়েছিলেন। কেউবা টাকা সংগ্রহ করেছিলেন ব্যাংক থেকে কিংবা লগ্নিকারকদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে। দেশে কিছু করতে পারছিলেন না, মালয়েশিয়ায় গিয়ে ভালো বেতনে চাকরি করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাবেন, ভবিষ্যৎ গড়বেন, এই ছিল স্বপ্ন। কিন্তু যেতে না পেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাদের। একরাশ হতাশা নিয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফিরে গেছেন কয়েক হাজার মানুষ।

মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা ছিল, অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের সে দেশে প্রবেশের শেষ দিন ছিল ৩১ মে, শুক্রবার। শেষ দিনে যাওয়ার সর্বশেষ চেষ্টা করতে তাই শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন হাজারও মালয়েশিয়া যেতে প্রত্যাশী যুবক। কিন্তু তারা সবাই যেতে পারেননি।   

ভিসা ও অনুমোদন জটিলতায় ৩১ হাজার ৩০৪ জন কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি বলে নিশ্চিত করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দায়িত্বশীল সূত্র। নিয়ম অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর আগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হয়। প্রশ্ন হলো, মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিতে পারে কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কি? কারণ, এজেন্সিগুলোর মালিক এবং সিন্ডিকেটের কেন্দ্র বলে ক্ষমতাসীন দলের এমপি, সাবেক সামরিক-বেসামরিক বড় বড় কর্মকর্তার নাম এসেছে।   
 
নিয়ম অনুযায়ী ৭০ হাজার টাকা প্রয়োজন হলেও মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক একজন কর্মী গড়ে খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। শেষ দিকে বিমানের টিকিটের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় খরচের পরিমাণ আরও বেড়েছে। টাকা বেশি লাগে লাগুক, তবু যেতে হবে- এই মানসিকতার কারণে খরচ করতে দ্বিধা করেননি তারা। যারা ছাড়পত্র নিতে পারেননি, শুধু বিমান ভাড়া ছাড়া বাকি টাকা এজেন্সিকে দিয়েছেন। অর্থাৎ ৩১ হাজার ৩০৪ জন যেতে না পারা কর্মী কয়েক লাখ টাকা করে দিয়েছেন। যাওয়া তো অনিশ্চিত, এখন টাকা ফেরত পাবেন কি না, পেলে কত ফেরত পাবেন সেই দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। 

মালয়েশিয়া যেতে টাকা জমা দিয়ে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। শ্রমবাজার চালু থাকার সময় অনেকেই বিদেশে যেতে প্রক্রিয়া শুরু করেন। এর মধ্যে কেউ কেউ হয়তো পাসপোর্ট করে এজেন্সির কাছে জমা দিয়েছেন। কেউবা পাসপোর্ট, মেডিকেল করেছেন। এরা সবাই এজেন্সি বা দালালের মাধ্যমে কিছু কিছু করে টাকা দিয়ে রেখেছেন। এসব টাকার কোনো মানি রসিদও থাকে না। বিদেশ গমনেচ্ছু এমন কর্মীর সঠিক সংখ্যা কত, তার কোনো হিসাব কারও কাছে নেই।

বায়রার যুগ্ম মহাসচিব বলেছেন, সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীর সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো হতে পারে।  

মধ্যপ্রাচ্যের পর মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার। গত দেড় বছর সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে মালয়েশিয়ায়, সাড়ে ৪ লাখের বেশি। শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রবাসে যাওয়া এবং প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু কেন এই সংকট দেখা দিল? 

এবারই প্রথম নয়, গত ১৫ বছরে তিন দফায় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে। প্রতিবারই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে চক্র বা সিন্ডিকেট গঠনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এই  চক্রের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের প্রচুর অভিযোগ উঠেছে বারবার। ২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০১৬ সালের শেষে খোলা হয় বাজারটি। তখন বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি মিলে এক সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০২২ সালে আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। তখন আবারও গড়ে ওঠে সিন্ডিকেট। গত মার্চে মালয়েশিয়া জানায়, দেশটি আপাতত আর শ্রমিক নেবে না। যারা অনুমোদন পেয়েছেন, ভিসা পেয়েছেন, তাদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে হবে। ফলে এটা তো জানা ছিলই, তাহলে এই হাজার হাজার কর্মীর না যেতে পারার দায় কে নেবে? 

এ কথা তো জানা আছে যে, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ  ২০২২ সালে শ্রমবাজার খোলার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছিল। তখন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এজেন্সি নির্ধারণের দায়িত্ব দেয় মালয়েশিয়াকে।

বাংলাদেশের এজেন্সি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড ছিল না। ফলে পুরো সুযোগটি নিয়েছে মালয়েশিয়ার কর্মী নিয়োগের ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) সফটওয়্যার মাইগ্রামের মালিক প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট। এটির মালিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর। তিনি মালয়েশিয়ার নাগরিক, আমিন নূর নামে পরিচিত।

মালয়েশিয়া থেকে আমিন নূর কর্মী পাঠানোর পুরো বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশে তার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন ওরফে স্বপন। তারা দুজন মিলে বাংলাদেশি এজেন্সিদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। প্রথমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর চক্রে ছিল ২৫টি এজেন্সি। এরপর ধাপে ধাপে মোট ১০০ বেসরকারি এজেন্সি অনুমোদন পায়, আর এর সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারি এজেন্সি বোয়েসেল। ফলে কর্মী দুর্ভোগের জন্য কাদের দায় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। 

বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র বারবার উঠে আসছে। পৃথিবীর প্রথম ১০টি কর্মী পাঠানোর দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নবম। সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম ও কম বেতনের কাজগুলোই করে বাংলাদেশি শ্রমিকরা আর বাংলাদেশের শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার খরচ পৃথিবীর সব দেশের চেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ যে কী তা চোখে পড়ে না। কিন্তু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান জোগানদাতা এই প্রবাসী শ্রমিকরা।  
 
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গত ২৯ মে ১৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। যদিও বাস্তব ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। এই তীব্র ডলারসংকট, টাকার দাম কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রিজার্ভসংকটের দুশ্চিন্তা, আর ঋণ নিতে গিয়ে আইএমএফের শর্ত- এসব শঙ্কা জাগানো তথ্যের মধ্যে নতুন আশার খবর হলো, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়েছে।  মে মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট ২২৫ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা প্রায় চার বছরের (৪৬ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ, আর এযাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ২ হাজার ১৩৭ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে আসা ১ হাজার ৯৪১ কোটি ডলারের চেয়ে ১৯৬ কোটি ডলার বা ১০ শতাংশ বেশি। সেবার পুরো অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। এক মাস বাকি থাকতেই আগের অর্থবছরের প্রায় সমান ডলার প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন। গত এপ্রিলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২০৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ১৬৯ কোটি ডলার। পরিবারের সদস্যরা একটু আনন্দ করবে, এ কথা ভেবে নিজের কষ্টে উপার্জিত টাকা ঈদের আগে পাঠিয়ে থাকেন প্রবাসীরা। সে কারণে প্রতিবছর ঈদের আগে প্রবাসী আয় বেড়ে যায়, এবারও তাই বেড়েছে। তবে এর চেয়েও বেশি রেমিট্যান্স আনা সম্ভব যদি হুন্ডি বন্ধ করে ব্যাংকিং চ্যানেলে সব রেমিট্যান্স আনা যায়।  

পরিবারের দায়, নিজের কর্মসংস্থান আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার পূরণের দায়িত্ব যারা পালন করেন, বিমানবন্দরে তাদের কান্নার ছবি দেখে আমাদের কি কোনো দায় অনুভূত হবে না? যারা এই দুর্দশার জন্য দায়ী তারা কি শাস্তির আওতায় আসবে না? নাকি দায়হীন দুর্দশা চলতেই থাকবে আর সরকার শুধু ডলার গুনবে?   

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]

ইরানের পারমাণবিক কৌশল পরিবর্তন

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৮:৩৮ পিএম
ইরানের পারমাণবিক কৌশল পরিবর্তন
সাইয়েদ হোসেইন মুসাভিয়ান

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন- ‘মার্কিন সেনাবাহিনী ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা: ফরদো, নাতানজ এবং ইসফাহানে ব্যাপকভাবে নির্ভুল হামলা চালিয়েছে। আমি বিশ্বকে বলতে পারি যে, এ হামলাগুলো ছিল দর্শনীয় সামরিক সাফল্য। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।

হামলার পর জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ংকর উত্তেজনা বেড়েছে যা ইতোমধ্যেই একদম প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। এ হামলা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি বলে মনে হচ্ছে। ১৩ জুন, ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে একাধিক বিমান ও সাইবার হামলা চালায়। এ হামলায় বেশ কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং উচ্চপর্যায়ের সামরিক কমান্ডারের প্রাণহানি ঘটে। এর জবাবে ইরান ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনাগুলোয় শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়।

১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অনেকদিন থেকে দাবি করে আসছেন যে, ইরান এক বা দুই বছরের মধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে। সত্য ঘটনা- ইরানে আক্রমণ করে নেতানিয়াহুর মূল লক্ষ্য হলো সরকার উৎখাত করা, দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা এবং সিরিয়া, লেবানন ও লিবিয়ার মতো ইরানকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। তার পর ইরানকে ভেঙে ফেলা।

এতে সন্দেহ নেই যে, ইসরায়েল আমেরিকা, ইউরোপ এবং ন্যাটোর সঙ্গে ইরানের ওপর আক্রমণের জন্য আলোচনা করেছিল। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় যুদ্ধ চালিয়েছে। নেতানিয়াহু ১৯৯০ সাল থেকে আমেরিকাকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বরাবরই এ ধরনের ফাঁদ এড়িয়ে গেছেন।

নেতানিয়াহুর চাপে ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাবে গৃহীত ইরানের পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করে দেন। তার দ্বিতীয় মেয়াদের মাত্র কয়েক মাস পরই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সামরিক হামলা চালান। নেতানিয়াহু ট্রাম্পের ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অসাধারণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ শক্তি দিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সাহসী সিদ্ধান্ত ইতিহাস বদলে দেবে’।

সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো- ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি একমত হওয়ার পর এ আক্রমণটি করা হলো। ওমান এবং ইতালিতে প্রথম তিন দফা পারমাণবিক আলোচনার চুক্তিটি বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি হতে পারত। 

ইরানি সূত্র থেকে জানা যায়, ‘মাস্কট এবং রোমে তিন দফা আলোচনার মাধ্যমে উইটকফ এবং আরাঘচির মধ্যে চুক্তির মূল বিষয়গুলো নিয়ে একমত হয়েছিল। চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপ: ইরান সর্বাধিক পারমাণবিক পরিদর্শন এবং স্বচ্ছতা গ্রহণ করবে যার মধ্যে অতিরিক্ত প্রোটোকল এবং সহায়ক ব্যবস্থা কোড ৩.১ বাস্তবায়ন অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটি হলো একটি দেশের পারমাণবিক কর্মসূচি পরিদর্শনের জন্য সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া।

সূত্রটি আরও যোগ করেছে- ‘দ্বিতীয়ত, ইরান তার বিদ্যমান ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়ামের মজুদ রূপান্তর বা রপ্তানি করবে যা ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট। তৃতীয়ত, ইরান তার বর্তমান উচ্চ-স্তরের সমৃদ্ধকরণ ৬০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনবে। বেসামরিক উদ্দেশ্যে যা ৩.৬৭ শতাংশ স্তরে কমিয়ে আনবে। সব প্রযুক্তিগত অস্পষ্টতা সমাধানে ইরান IAEA-এর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে’।

বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক-সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে। উভয় পক্ষের প্রযুক্তিগত পক্ষ এ চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত চুক্তির খসড়া তৈরি করবে বলে একমত হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্পের মধ্যে একটি ফোনালাপের পর আমেরিকা পক্ষ মাস্কটে তাদের প্রযুক্তিগত দল পাঠানো বন্ধ করে দেয়। তাদের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন করে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ বন্ধের দাবি জানায়।

এ চুক্তি হওয়ার পর ট্রাম্পের দুই মাসের সময়সীমা শেষ  হতে না হতেই এমন ঘটনা ঘটে। এটি ছিল ইসরায়েলের ফাঁদ- যা আমেরিকা এবং ট্রাম্পকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে টেনে আনার অন্যরকম কৌশল। 

ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি কাজা কাল্লাস আরাঘচির সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আবার দেখা করতে সম্মত হয়েছেন।
ইরান আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায়, তেহরানের বিরুদ্ধে ১০ দিনের সামরিক অভিযানে ইসরায়েল কেবল ব্যর্থই হয়নি, বরং পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে গেছে। ইসরায়েল যদি সংকটে না থাকত তাহলে আমেরিকা কেন হস্তক্ষেপ করবে? 

মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ ইসরায়েল যার কাছে আসলে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ধারণা করা হয়, তাদের কাছে ৪০০টিরও বেশি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। তারা পারমাণবিক বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াই করার দাবি করতে পারে না। তাছাড়া, গত ২০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন নিশ্চিত করেছে যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। মূল বিষয় হলো, তাৎক্ষণিক এবং গুরুতর কোনো হুমকি ছিল না। ইরানে দুই সপ্তাহে ১০টি বোমা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত সমৃদ্ধ পরমাণু মজুদ আছে, এ দাবিটিও সত্য নয়। 

এমনকি যদি ইরান বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তবে পারমাণবিক যুদ্ধ করার মতো ডেলিভারি সিস্টেম তৈরি করতে তাদের এক থেকে দুই বছর সময় লাগবে। আমেরিকান আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ‘ইসরায়েলের আক্রমণ শুরু হওয়ার আগে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এমন কোনো হুমকি ছিল না’।

এই প্রথম দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ পারমাণবিকহীন দেশের ওপর সামরিক আক্রমণ শুরু করেছে। কুইন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, ‘ইরান ইসরায়েলকে আক্রমণ করেনি, তারাই যুদ্ধ শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে আক্রমণ করেনি, তারা এই মুহূর্তে এ সংঘাত ছড়িয়ে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য প্রণীত পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) কেবল একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আক্রমণ জাতিসংঘ সনদের স্পষ্ট লঙ্ঘন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করে জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং এনপিটির গুরুতর লঙ্ঘন করেছে’। 

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা দল ইরানের ওপর মার্কিন সামরিক হামলার ভয়াবহ প্রভাব সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ট্রাম্পকে নিরুৎসাহিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যাই হোক না কেন, এ ঘটনা হোয়াইট হাউসের ওপর নেতানিয়াহুর প্রভাবের মাত্রা আরও প্রকাশ করেছে। এ যুদ্ধটি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য উসকে দিয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বেচ্ছায় তাকে আমেরিকার সামরিক ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন যাতে এটি দীর্ঘায়িত হয়। কংগ্রেসওম্যান বনি ওয়াটসন কোলম্যান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কারও প্রক্সি সেনাবাহিনী নয় এবং আমাদের সৈন্যরা দর কষাকষির জন্যও নয়’।  

তেহরানের ধারণা হলো- এ দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের আক্রমণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এনপিটির তেমন কোনো মূল্য নেই বরং এটি ক্ষতিকারকও  বটে। উত্তর কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলো যারা চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্রের সামরিক আক্রমণ থেকে মুক্ত রয়েছে। এটা স্বাভাবিক যে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আক্রমণের পর ইরান তার পারমাণবিক কৌশল পুনর্বিবেচনা করবে; যার মধ্যে রয়েছে এনপিটিতে তার সদস্যপদ অব্যাহত রাখা। ইরান অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু এ আক্রমণের নেতিবাচক প্রভাব শুধু ইরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়- এটি যুক্তরাষ্ট্রেরও ক্ষতি করবে। আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করবে। বর্তমান যুদ্ধে কোনো জয় বা পরাজয় নেই। ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই ধ্বংস, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় আঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সব পক্ষই তাদের অর্জনের চেয়ে অনেক বেশি হারাতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না করলে মধ্যপ্রাচ্য একটি বিপর্যয়কর সংঘাতের দিকে যেতে পারে। 

লেখক: ভিজিটিং রিসার্চ সহযোগী, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির সাবেক প্রধান। 
মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত 
অনুবাদ: সানজিদ সকাল

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌরাত্ম্য ও মানববুদ্ধির প্রভাব

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৮:৩২ পিএম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌরাত্ম্য ও মানববুদ্ধির প্রভাব
ড. নূর-ই আলম সিদ্দিকী

রূপকথার গল্প সূত্রে বাঙালির পরিচয় হয়েছে আলাদিনের চেরাগের সঙ্গে। যার শক্তি কোনো কিছু স্পর্শ করলেই তাতে অভাবনীয় পরিবর্তন এবং ইচ্ছেমতো কার্যসিদ্ধি হয়। প্রযুক্তির দুনিয়ায় তেমনি এক জাদুকরী চেরাগের নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। দুয়ের মধ্যে পার্থক্য এতটুকু- এই শক্তি আলাদিনের চেরাগের মতো প্রত্যক্ষ কোনো কিছু নির্মাণ করতে পারে না, তবে গবেষণালব্ধ প্রত্যাশিত তথ্য হাজির করতে পারে নিমিষেই। সাদা চোখে মানুষ এ যন্ত্রের গুরুত্ব বুঝতে না পারলেও এ এক বিস্মকর সৃষ্টি, তা মানতেই হবে। 

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে তথ্যই শক্তি। কিন্তু কেবল তথ্য থাকলে হবে না, এ তথ্য স্বল্পশ্রমে অতি সহজে পাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য যেকোনো যুগ থেকে আধুনিককালে ‘সময়’ তাই বড় মূল্যবান। প্রবহমান জীবনের ক্লান্তি নাশ করে এই ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ মানুষের সময়কে সাশ্রয়ের সীমানায় নিয়ে আসতে পারে নিমিষেই। এতেই শেষ নয়, মানুষের থেকেও তার কাজের গতি অস্বাভাবিক গতিসস্পন্ন এবং নিখুঁত। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সামনের দিনে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানুষের কর্মকৌশল শক্তিকে ছেড়ে যাবে। 

সঙ্গতভাবেই তাই জানতে সাধ হয় ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ আসলে কী জিনিস? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ম্যাকার্থি বলেছেন, ‘কম্পিউটার যখন মানব বুদ্ধিমত্তাকে সিমুলেট বা অনুকরণ করতে সক্ষম হবে, তখন সেই মেশিনকে ইন্টেলিজেন্ট বা বুদ্ধিমান বলা চলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বুদ্ধিমত্তা হলো মানুষের কম্পিউটেশনাল বা গণনামূলক ক্ষমতা, যা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে ও কাজ সম্পাদনে সমর্থ করে তোলে।’ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে মানুষ দৈহিক ও কায়িক শ্রমকে পেছনে রেখে বুদ্ধির বাস্তব প্রয়োগে অতি দ্রুত তার কাজ সম্পন্ন করতে চায়।

 এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিজ্ঞানীরা মেধা প্রয়োগ করে সৃষ্টি করেছেন ব্যাপক শক্তিধর নানা কৃত্রিম বুদ্ধিযুক্ত সফটওয়্যার। যার মধ্যে আছে- ওপেন এআইয়ের ‘চ্যাটজিপিটি’ তথা (Chat Generative Pre-training Transformer), গুগলের ‘জেমিনাই’ এবং মাইক্রোসফটের ‘কো-পাইলট’ ইত্যাদি। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর বিশ্বের প্রথম সারির মার্কিন গবেষণা ল্যাবরেটরি ‘ওপেন এআই’ চ্যাটবট বাজারে আনে। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে বাজারে আসে মাইক্রোসফটের ‘কো-পাইলট’ এবং সবশেষ ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গুগলের ‘বার্ড’ প্রসার লাভ করে। 

কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা ও বিকাশ পৃথিবীর সব স্তরের গবেষক এবং দার্শনিকের মনে শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মহলের প্রশ্ন মানবমস্তিষ্কের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য ও বিভেদ কতখানি তা নিয়ে। একই সঙ্গে সচেতন মানুষের ভাবনার পালে হাওয়া দিয়েছে অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা এর কত ব্যাপক সে বিষয় নিয়ে। সম্প্রতি চ্যাটজিপিটি সম্পর্কে মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছেন, ‘বিশ্বকে বদলিয়ে দেবে চ্যাটজিপিটি।’ তিনি মনে করেন ‘আগের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলো সব বিষয়ে লিখতে ও পড়তে পারত; কিন্তু বিষয়বস্তু বুঝত না, কিন্তু চ্যাটজিপিটি বিষয়বস্তুও বুঝে।’ দুশ্চিন্তার বেগ আরও গতিশীল হয়েছে চাকরির বাজার তথা কর্মক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে। কারণ এটি একদিকে যেমন প্রোগ্রাম কোড লিখতে পারে, তেমনি ক্রেতার সব প্রশ্নের উত্তরও সময়মতো দিতে পারে। 

অন্যদিকে সংবাদ সমীক্ষা থেকে ব্যাকরণ, আইনি নথি ও দলিলদস্তাবেজ তৈরিতেও এর রয়েছে ভয়ানক কার্যক্ষমতা। ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বগ্রাসী শক্তি হাল আমলের সব মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রচণ্ড অস্থির করে তুলেছে। যৌক্তিক কারণেই তাই এ প্রত্যুৎপন্নমতি তথা সব অঘটন-ঘটনপটিয়সী আবিষ্কারটির সৃষ্টি উৎসের রহস্য জানতে মন বেশ খরতর হয়ে ওঠে।  

অগণিত উপাত্ত ধারণক্ষম এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ কৌতূহলপ্রদ। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপে বেসামাল হয়ে ওঠে বিশ্ব। দুই বলয়ের পরাশক্তি মেতে ওঠে একপক্ষ অন্যপক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হিংস্র প্রতিযোগিতায়। শুরু হয় গোপনে তথ্য আদান-প্রদানের কৌশলী খেলা। যুক্তরাষ্ট্র ২৯ জন নাভাহো আদিবাসীকে নিয়োগ দিয়ে, নাভাহো ভাষা ব্যবহার শুরু করে কোড আদান-প্রদানে। ‘যেখানে তিন বাক্যের ইংরেজি কোড ভাঙতে ৩০ মিনিট সময় লাগত, নাভাহো কোড টকাররা সে কোড ভেঙেছেন ২০ সেকেন্ডে।’ আর জার্মানরা তা পড়তে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। 

কিন্তু জার্মানরা পিছিয়ে না থেকে বার্তা আদান-প্রদানের জন্য ‘এনিগমা’ নামের কোডিং যন্ত্র চালু করে। দাদার ওপর দাদাগিরি বলে কথা। ‘এনিগমা’ কোডিং বাইরে আসামাত্র পোল্যান্ডের গণিতবিদরা ‘এনিগমার’ কোড ভেঙে ফেলেন। অবশ্য জার্মানরা এ পদ্ধতিকে অধিক শক্তিশালী করলে মিত্রশক্তি হিটলারের কাছে খেই হারিয়ে ফেলে। ঠিক তখনি ‘যুক্তরাজ্যের বাকিংহামশায়ারের ব্রেচলি পার্কের অতি গোপন তথ্য বিশ্লেষণ কেন্দ্রে কাজ নেন সে সময়ের মেধাবী গণিতজ্ঞ আল্যেন টুরিং। তিনি ‘বম্ব’ নামের একটি কোডি-ব্রেকিং যন্ত্র তৈরি করেন, যা মিত্রপক্ষকে ব্যাপক সুবিধা এনে দেয়। যুদ্ধ শেষে আল্যেন টুরিং উপাত্ত বিশ্লেষণের ওপর জোর দেন। ১৯৫০ সালে ‘কম্পিউটিং মেশিনারি আ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রথম আলোকপাত করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে ‘টুরিং টেস্ট’ নামক একটি পরীক্ষা প্রবর্তন করেন।’ সেই থেকে পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে যন্ত্রকে বুদ্ধিমান করে তোলার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে। আর তাদের এই হার-না মানা চেষ্টার ফল আজকের এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্ময়কর ব্যবহার ও বিচরণ। বর্তমান বিশ্বে এ আবিষ্কারের সব থেকে বেশি আলোচনা হচ্ছে যে দিক নিয়ে তা হলো ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপুল তথ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে।’ দার্শনিকদের মধ্যে এখানেই বিতর্ক শুরু। 

বিষয়টির ওপর ২০২৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমের এক নিবন্ধে খ্যাতিমান দার্শনিক নম চমস্কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানব বুদ্ধিমত্তার চেয়ে অধিক শক্তিশালী নয় বলে অভিমত রাখেন। তিনি বলেন, ‘মানবমস্তিষ্ক স্বল্প তথ্য ব্যবহার করে বিপুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অযুত তথ্যের প্রয়োজন পড়ে না।’ চমস্কি একজন ভাষাবিদ, তাই বিষয়টি সেই প্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু ম্যাকার্থি বুদ্ধিমত্তাকে একান্তভাবে একটি গাণিতিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন। লক্ষ করার বিষয় হলো চমস্কি ও তার সহগবেষকরা ‘রিজন’ বা যুক্তি প্রদানের ক্ষমতা, নীতিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়কে বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্রে খুঁজে পেয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘যন্ত্র পরিসংখ্যান খাটিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়, তবে দায়ভার নেয় না। বলে আমার কাছে থাকা উপাত্তের ভিত্তিতে আমি এ সিদ্ধান্ত দিচ্ছি।’ অতএব, উপাত্তের পরিবর্তন ঘটলে এর সিদ্ধান্ত বদলাবে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষ স্বল্প উপাত্ত থেকে শুধু সিদ্ধান্তই নয়, তার ব্যাখ্যাও তৈরি করে। চিন্তাশীল জীব হিসেবে মানুষ একই সঙ্গে রিজন ও সৃষ্টি দুই-ই সম্পন্ন করতে পারে। 

ষোলো শতকে দার্শনিক রেনে দেকার্ত বলেছিলেন, ‘আমি চিন্তা করি বলেই আমার অস্তিত্ব আছে।’ এই ‘রিজন’ নিয়ে দার্শনিক টমাস হবস ‘লেভিয়াথানে’ মানবক্রিয়ার সংযমের কথা তুলে ধরেন। আবার ডেভিড হিউম ও ট্রিটিসে বিষয়টির সঙ্গে মানব অনুভূতির অনেক খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করেছেন। তবে ব্যাপারটি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন দার্শনিক ইমানুয়েল ক্যান্ট; যিনি রিজনিং বিভাজন করেছেন চারটি শ্রেণিতে- তাত্ত্বিক, নৈতিক, প্রায়েগিক ও নান্দনিক। তিনি প্রবর্তন করেছেন রিজনিংয়ের সর্বজনীন বিধিমালা। 

দার্শনিক বিচারে যন্ত্র তাই বুদ্ধিমত্তা ধারণ করে এ কথা প্রমাণ দেওয়া খুব সহজ নয়। অবশ্য বিতর্ক যাই থাক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি আগামী দিনে প্রভাব রাখবে। তাই একে ভয় না পেয়ে নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে এগোতে হবে। বিষয়টির ওপর পরিবেশবিজ্ঞানী নাভিদ সালেহর মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই- ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি গাণিতিক প্রক্রিয়া, যা বিপুল পরিমাণ উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম। এ প্রযুক্তিকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করব, তার ওপর নির্ভর করছে এর সম্ভাবনা কিংবা ঝুঁকি।’ একটি নিরাবেগ পর্যালোচনা করে তাই বিখ্যাত চিন্তাবিদরা বলেছেন, সর্বজনীন সত্য হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শেকসপিয়র বা রবীন্দ্রনাথকে বড় জোর অনুকরণ করতে পারে কিন্তু তাদের লেখনি সৃষ্টিতে আদৌ সক্ষম নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাই মানুষের হাতে সৃষ্ট দাস। অধিপতি নয় কোনোভাবেই। 
 
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ, বগুড়া

 

লোকসভা নির্বাচন ঘিরে আগাম প্রস্তুতি

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ০৮:২৫ পিএম
লোকসভা নির্বাচন ঘিরে আগাম প্রস্তুতি
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গ এক জাতিস্মরকে আপন করে নিয়েছিল ১৯৭১-এ। প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাস; সোনার কেল্লা। ফেলুদার সেই কীর্তি চলচ্চিত্রে হাজির হয়েছিল ১৯৭৪-এ। সেই জাতিস্মর মুকুলকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা অবিনশ্বর হয়ে আছে অসংখ্য হৃদয়ে।

চলচ্চিত্র হিসেবে সোনার কেল্লার প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তির বছরে সেই পশ্চিমবঙ্গই আর এক স্বঘোষিত জাতিস্মরের খোঁজ পেয়েছিল। সেদিন ছিল ২৬ এপ্রিল, ২০২৪। সেই ‘জাতিস্মর’ নিজের গত জন্মের কথা জানালেন মালদহে। তিনি শিশু নন, তিনি ছবি আঁকেন না। গুজরাটের ভাদনগরে জন্ম নেওয়া সেই ৭৩ বছরের বৃদ্ধ সেদিন এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে আমি আগের জন্মে এই বাংলার মাটিতে জন্মেছিলাম। না হয় পরের জন্মে আমি এই বাংলারই কোনো মায়ের কোলে জন্ম নেব।’

সেই জাতিস্মর, ভূত-ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা আর কেউ নন; তিনি নরেন্দ্র মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তার ভারত-শাসনের ১১ বছর পূর্তি হয়েছে। দেশজুড়ে মোদি শাসনের ‘সাফল্যে’র প্রচার চলছে। গত জন্ম এবং পরজন্মের ঠিকানার জন্য এ জন্মে তার অবদানের সাফল্য খতিয়ে দেখার এটিই সময়। এই খতিয়ে দেখা আর একটি কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যে ১৪ বছর মমতা ব্যানার্জির শাসন চলছে। আর নরেন্দ্র মোদিই সেই ব্যক্তি, যিনি মহাকরণের বহু আকাঙ্ক্ষিত চেয়ারে বসার জন্য উদগ্রীব তৃণমূল নেত্রীকে একটি নিদারুণ পরামর্শ দিয়েছিলেন ২০১১-এর মে-তে; ‘প্রথম রাতেই বেড়াল মেরে দিন।’ পশ্চিমবঙ্গের প্রতি তার ভাবনার সেটিই প্রথম প্রকাশ।

রাজ্যে কমিউনিস্টসহ বামপন্থিদের দুর্বল করতে না পারলে আরএসএস, বিজেপির ফণা তোলার সুযোগ ছিল না। তাই মোদির সেই পরামর্শ ছিল। মমতা ব্যানার্জি এবং তার দলের নেতারা মোদির সেই পরামর্শ অনুসারেই এগিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মদতে আরএসএস-এর শাখা-প্রশাখা বিস্তারই মোদির একমাত্র সাফল্য।

২০১৪-এর এপ্রিল। নরেন্দ্র মোদি তখনো প্রধানমন্ত্রী হননি। সিঙ্গুরে যে কারখানা হওয়ার কথা ছিল, মমতা ব্যানার্জির ‘আন্দোলনে’ ভর করে তা গুজরাটের সানন্দে পৌঁছে গেছে তার আগেই। কলকাতার একটি সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে মোদি জানিয়েছিলেন, ‘এখন, যখন আমি গুজরাটের বাইরে এসে সারা দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করি, আমার সিঙ্গুরের জন্যও একটি ভাবনা আছে।’ সেই ‘ভাবনা’র আশ্বাস পেয়েই চিঠি লিখেছিল সিঙ্গুর শিল্প বিকাশ ও উন্নয়ন কমিটি। দিনটি ছিল ২০১৪-এর ২৮ জুলাই। 

সেই চিঠির পর প্রায় ১১ বছর পার। জবাব তো দূরের কথা। ‘চিঠি মিলা হ্যায় মিত্রো’; এটুকুও জানাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সিঙ্গুরের শিল্প বিকাশ ও উন্নয়ন কমিটির সদস্যরা চিঠিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে পদক্ষেপের আবেদনও জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। তারা রাজ্যকে এড়িয়ে মোদিকে কিছু করতে বলেননি। কেন তারা এমন ভেবেছিলেন? কারণ, ২০১৪-এর ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ দুটো লাড্ডু পাবেন। এখানে বসে দিদি উন্নয়ন করবেন, আর দিল্লি থেকে আমি উন্নয়ন করব বাংলার।’

তার পর কৌশল বদলে গেল। মমতা বনাম মোদি; এ ধারণা মানুষের মধ্যে গড়ে তুলতে না পারলে, মোদি-মমতা ব্যানার্জি আসলে বন্ধু, তা স্পষ্ট হয়ে গেলে বামপন্থিদের প্রতি মানুষের আশা, সমর্থন বাড়বে; এই অঙ্কটি বুঝেই খেলতে নেমেছিলেন প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী। তাই ২০১৬-এর ২৬ মার্চ খড়গপুরের সভায় নরেন্দ্র মোদির মুখে শোনা গেল, ‘‘এমন দুর্নীতির ছবি বাংলায় দেখেছিলেন। প্রথমে সারদা, এখন ‘নারদ’। গোটা তৃণমূলের নেতৃত্ব ক্যামেরার সামনে এমনভাবে টাকা নিচ্ছেন যেন হপ্তা তুলছেন। আচ্ছা বলুন, ওরা যে টাকা নিচ্ছেন, সেটা কার টাকা। আপনাদেরই টাকা তো লুট হয়ে গেছে।’’

মোদি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের টাকা লুট নিয়ে। খুব স্বাভাবিক। সারদা, নারদ স্টিং অপারেশন, রেগা-আবাস যোজনার টাকা লুট, রেশনের চাল চুরি, কয়লা-গরু-বালি পাচার: তৃণমূল নেতা, সাংসদ, ‘জনৈক অভিষেক’সহ কারও বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত শেষই করতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো। তাহলে সেই গত জন্মের মা, পরের জন্মের জননীর জন্য কী করলেন ‘যুগপুরুষ’ নরেন্দ্র মোদি?

তৃণমূল-বিজেপির এ বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই পশ্চিমবঙ্গে নরেন্দ্র মোদির শাসনের ‘সাফল্য’কে বিচার করতে হবে। না হলে পুরো লাভ-লোকসানের তালিকা ‘জল জীবন মিশন’-এর রিপোর্টের মতো হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৫৬ শতাংশ পরিবারে পাইপলাইনের মাধ্যমে জল পৌঁছে গেছে। এ রিপোর্ট রাজ্য সরকারেরও। কিন্তু বাস্তবে কেন্দ্র-রাজ্য রিপোর্টে বিস্তর ‘জল’। হিসাবে এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে দুই ধরনের সমস্যা। কোথাও পাইপ বসিয়েছে ঠিকাদার। কিন্তু জল যায়নি।

 কোথাও পাইপই বসেনি। মোদি-মমতা ব্যানার্জির সরকার মিলে দেখাচ্ছে জল পৌঁছে গেছে। সম্প্রতি শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর সভা ছিল। সেখানে সভামঞ্চে চা না পেয়ে মজা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এরা এখানে চা-ও দেয় না।’ সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য চা আনতে ছুটে গেছিলেন মন্ত্রী, তৃণমূল নেতারা। কিন্তু শিলিগুড়ি যে জেলায়, সেই দার্জিলিংয়ে প্রায় ৫৩ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে এখনো পানীয় জলের লাইনই পৌঁছায়নি। যে বাড়িগুলোতে লাইন পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে, তার একাংশে শুধু পাইপই পৌঁছেছে, জল যায় না সেই পাইপে। সংখ্যালঘু নিবিড় মুর্শিদাবাদের দাঙ্গাবিধ্বস্ত সমশেরগঞ্জের তৃণমূলের পঞ্চায়েতপ্রধানরাও স্বীকার করেছেন যে, গ্রামবাসীর একাংশ জল কিনে খান। অনেকে জল বয়ে আনেন দূর থেকে।

সম্প্রতি বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করে ৬৭ বছর পর পতিরামে সমবায় সমিতির দখল নিল তৃণমূল। ঘটনাকে ঘিরে জোর চর্চা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায়। রাজ্যে নজিরবিহীন ঘটনা, বলছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ওই জেলার পতিরাম কো-অপারেটিভ অ্যাগ্রিকালচারাল ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের মনোনয়ন পর্ব জমার শেষ দিনেই পাঁচ ও চার আসনের সমঝোতা করে সমবায়টির দখল নেয় তৃণমূল ও বিজেপি। গোটা রাজ্যে শাসক দল তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষই বিজেপি। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে পুরসভা, বিধানসভা থেকে শুরু করে লোকসভা নির্বাচন- সবতেই একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে। কিন্তু পতিরামের এ সমবায় নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপির এমন গোপন সমঝোতা কার্যত অস্বস্তি বাড়িয়েছে উভয় শিবিরকে।

১৯৫৮ সালে গঠিত পতিরাম কো-অপারেটিভ অ্যাগ্রিকালচারাল ক্রেডিট সোসাইটির শেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৫-তে। তার পর থেকে প্রশাসকের অধীনে চলছিল সমবায়। চলতি বছরে নতুন করে নির্বাচন ঘোষিত হতেই জোরদার প্রস্তুতি শুরু হয় সব পক্ষের। কিন্তু মনোনয়ন জমার শেষ দিনে চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়; নয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটি তৃণমূল ও চারটি বিজেপি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।

 বোঝাপড়ার জেরে ভোট পড়ার আগেই বোর্ড দখল দুই দলের। শাসকবিরোধী সমঝোতায় এমন ‘অঘটন’ অভাবনীয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এটি শুধুই স্থানীয় স্তরের ঘটনা নয়; এতে রাজনীতির ভবিষ্যৎ অভিমুখের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে।
যদিও এ নিয়ে কড়া মনোভাব পোষণ করেছেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তৃণমূল সভাপতি সুভাষ ভাওয়াল। তিনি জানান, ‘বিজেপির সঙ্গে কোনো প্রকার সমঝোতা দল মেনে নেবে না। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ। ব্লক সভাপতির কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করা হয়েছে।’ তৃণমূলের কোথাও জনপ্রিয়তা না থাকলে সেখানে দল হারবে, কিন্তু কোনোভাবেই বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করবে না।

অন্যদিকে, বিজেপির জেলা নেতৃত্বের মুখে কুলুপ। দলের জেলা সভাপতি স্বরূপ চৌধুরীর কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি। মণ্ডল সভাপতি ছোটন চক্রবর্তী অবশ্য জানিয়েছেন, বিষয়টি তার জানা নেই।
পতিরাম কো-অপারেটিভ অ্যাগ্রিকালচারাল ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের ম্যানেজার হিমালয় বিশ্বাস বলেন, এতদিন ইলেকশন হলেও এবারে সিলেকশনের মাধ্যমে সমবায় গঠিত হয়েছে। নয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটি তৃণমূল ও চারটি বিজেপি। 

উভয় দলের সদস্যদের মধ্যে সমঝোতা বাইরে হয়ে থাকলে তাদের কিছু বলার থাকে না। তবে এমন ‘চুপিসাড়ে বোঝাপড়া’ মানতে নারাজ স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশও। এ নিয়ে পতিরাম পঞ্চায়েত প্রধান তথা ওই সমবায়ের সদস্য পার্থ ঘোষ জানিয়েছেন, ‘আমার জানা মতে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল।’

রাজনীতির শুদ্ধতায় এ সমঝোতা এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন। পতিরামে যা ঘটল, তা কি নিছক ব্যতিক্রম? নাকি নিচুতলার ‘ভোটের সমীকরণে’ জোটের আগাম ইঙ্গিত? আপাতত সেই উত্তর খুঁজছে গোটা জেলা।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

চলচ্চিত্র হিসেবে সোনার কেল্লার প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তির বছরে সেই পশ্চিমবঙ্গই আর এক স্বঘোষিত জাতিস্মরের খোঁজ পেয়েছিল। সেদিন ছিল ২৬ এপ্রিল, ২০২৪। সেই ‘জাতিস্মর’ নিজের গত জন্মের কথা জানালেন মালদহে। তিনি শিশু নন, তিনি ছবি আঁকেন না। গুজরাটের ভাদনগরে জন্ম নেওয়া সেই ৭৩ বছরের বৃদ্ধ সেদিন এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে আমি আগের জন্মে এই বাংলার মাটিতে জন্মেছিলাম। না হয় পরের জন্মে আমি এই বাংলারই কোনো মায়ের কোলে জন্ম নেব।’...

পলাশী, প্রাচুর্য ও প্রহেলিকা

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ০৮:২২ পিএম
পলাশী, প্রাচুর্য ও প্রহেলিকা
সৈকত ইসলাম

নবাবি আমলে বাংলা সম্পদশালী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল এখানে কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উচ্চমান ও কম মূল্য, যা বাংলার বাইরে এসব জিনিসের প্রচণ্ড চাহিদা তৈরি করে। এ স্বল্পমূল্য কোনো প্রাচুর্যতার লক্ষণ নয়। যে ইবনে বতুতা এ দেশের প্রাচুর্যতার বর্ণনা করেছেন, তিনি তার জবানিতেই বলেছেন- ‘এ অঞ্চলের প্রজারা ফসলের প্রায় ৫০ ভাগ খাজনা দেয়, এর বাইরেও আছে অন্য কর।...

আজ পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সিরাজউদদৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের সূচনাকাল বলা যায় এ তারিখকে। বলা হয়ে থাকে, এক সুখী-সমৃদ্ধশালী অঞ্চল দারিদ্র্য আর পরাধীনতার গহ্বরে প্রবেশ করে এ পরাজয়ের মাধ্যমে, যার স্থায়িত্ব ছিল পরবর্তী ১৯০ বছর।

বাংলাকে  সুখী ও সমৃদ্ধশালী অঞ্চল হিসেবে অভিহিত করার ইতিহাস অনেক পুরোনো। মৌর্যযুগ থেকে শুরু করে মোগল আমলের প্রায় ১৮০০ বছরের যে বর্ণনা তাতে এ অঞ্চলকে দেখানো হয়েছে অতিশয় প্রাচুর্যপূর্ণ ও সম্পদশালী হিসেবে। এখানে আরব পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনা উল্লেখযোগ্য। ভ্রমণকাহিনিতে ইবনে বতুতা বলেন, ভারতবর্ষ এক বিশাল দেশ। আশ্চর্যের বিষয় হলো এর অধিকাংশই অত্যন্ত উর্বর। তার মধ্যে বাংলা হলো অন্যতম। এত উর্বর দেশ পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। বাংলার সম্পদ ও ঐশর্য অতুলনীয়। 

স্বর্গরাজ্য হিসেবে প্রাচীন বাংলার যে ছবি আঁকা হয়েছে। তার শিল্পী বিদেশি বণিক বা বণিকবেশে আসা পর্যটকরা। বিদেশি পর্যটকরা ছবি এঁকেছেন সেই সব মানুষের আর তাদের অর্থনীতির, যাদের সঙ্গে তারা মিশেছেন। এ অঞ্চলে আসা এই বিদেশি বণিক আর পর্যটকরা সাধারণ মানুষের কাছে যাননি। তাদের সঙ্গী ছিলেন এ দেশে তাদের ব্যবসায়ী সহযোগী, জমিদার বা উচ্চশ্রেণির আমলা। তারা ছিলেন দেশের অন্যতম সম্পদশালী। এই বণিক আর পর্যটকদের চোখে বাংলা ছিল তাই স্বর্গের মতোই সীমাহীন সম্পদের খনি। 

এই আকর্ষণীয় বর্ণনার বাইরে কেউ কেউ জনজীবনের অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন। দেখিয়েছেন প্রদীপের তলার অন্ধকারকে। তেমনই একজন ফ্রাঁশোয়া বার্নিয়ের। বার্নিয়ের বলেছিলেন- এই দেশ সোনা ও রুপায় ভরপুর। সোনা-রুপা পৃথিবীর অন্য স্থান ঘুরে এসে ভারতবর্ষে পৌঁছায় এবং এর গুপ্ত গহ্বরে হারিয়ে যায়। 

অথচ এত সোনা-রুপা থাকার পরও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। এমনকি আমির-ওমরাহদের অনেকেই ভিতরে ভিতরে শোচনীয় অবস্থায় থাকেন। এর একটা কারণ হলো এ সোনা-রুপার বড় অংশ গলিয়ে নষ্ট করে ফেলা হয়। অর্থাৎ গলিয়ে অলংকার প্রস্তুত করা, যা হাত, পা, মাথা, নাক, কান, গলা সর্বত্র অলংকৃত করার মাধ্যমে সোনার অপচয় হয়। 

এক ফরাসির মুখে এ দেশের মানুষের অর্ধাহারে-অনাহারেও থেকেও সোনার অলংকার পরার প্রতি আসক্তি যদি অতিরঞ্জন মনে হয় তবে ফরাসিদের জাতশত্রু এক ইংরেজ রালফ ফিচ তার এ অঞ্চল  ভ্রমণের বর্ণনায় উল্লেখ করেছিলেন- ‘এ দেশের মেয়েরা অসংখ্য হাতির দাঁতের তৈরি চুড়ি পরে আর তাতে তারা এত আনন্দ পায় যে, মনে হয় তাদের আর ভালো খাবারের প্রয়োজন নেই’।  

রালফ ফিচ ছিলেন ভারতবর্ষ ভ্রমণকারী প্রথম ইংরেজ। তার ভ্রমণ বর্ণনার উদ্দেশ্য ছিল এ দেশে ইংরেজ বণিকদের ব্যবসা করার জন্য পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য প্রদান। বিখ্যাত বা কুখ্যাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের সময় রালফ ফিচের ভ্রমণবৃত্তান্ত বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় এবং তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের একজন উপদেষ্টা। বার্নিয়ের তার ভ্রমণ বিবরণ ফ্রান্সের তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন। 

তার উদ্দেশ্য ছিল এ দেশের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো। তাই তাদের বর্ণনায় নিছক প্রাচুর্য আর সম্পদের বাইরে সাধারণ মানুষের অবস্থাও যেমন উঠে এসেছে, তেমনি সম্পদাশালী এ অঞ্চলের সম্পদ যে ছিল অসাম্যের প্রতীক, সেটারও ধারণা পাওয়া যায়।  যা সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত ছিল, এমন ধারণার সমর্থনের বিপরীত প্রমাণ দেয়। 

পলাশীর যুদ্ধের ৭০ বছর আগে বার্নিয়ের লিখেছেন, দিল্লির মতো শহরের প্রতি ১০ জনের সাত/আটজন অতি দরিদ্র ও জীর্ণ। প্যারিসের ঠিক বিপরীত যেখানে ৭-৮ জনই অবস্থাসম্পন্ন। পরবর্তীতে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা অঞ্চলে ব্রিটিশরা আসার আগেই পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় গরিব ছিল। 

ইউরোপীয় কর্তৃক এ অঞ্চলের লুটপাটের শুরু হয়েছিল রাজা ও ধনী ব্যক্তিদের লুকানো সম্পদ দিয়ে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লুটপাট করার মতো তেমন কিছু ছিল না। এ দেশে সম্পদ ছিল সত্যি, প্রাচুর্যতাও ছিল। কিন্তু স্বর্গরাজ্য ছিল না। কারণ ছিল তীব্র অসাম্য। 

নবাবি আমলে বাংলা সম্পদশালী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল এখানে কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উচ্চমান ও কমমূল্য, যা বাংলার বাইরে এসব জিনিসের প্রচণ্ড চাহিদা তৈরি করে। এ স্বল্পমূল্য কোনো প্রাচুর্যতার লক্ষণ নয়। যে ইবনে বতুতা এ দেশের প্রাচুর্যতার বর্ণনা করেছেন, তিনি তার জবানিতেই বলেছেন- ‘এ অঞ্চলের প্রজারা ফসলের প্রায় ৫০ ভাগ খাজনা দেয়, এর বাইরেও আছে অন্য কর। এই কর এ অঞ্চলের কল্যাণে সেভাবে ব্যবহার হয় না বরং রাজাদের নজরানা দিতেই চলে যায়। ফলে উচ্চহারের কর এ অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে’। 
  
নবাব শায়েস্তা খানের সময় টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত, এ কথার ঐতিহাসিক সত্যতা আছে, তবে চালের এ মূল্যমান নিয়েও অনেক কথা আছে। পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা গেছে, সে সময় মওসুম অনুসারে চালের মূল্য ছিল টাকায় তিন থেকে চার মণ, এ হিসেবে সাপ্তাহিকভাবে যাদের গড় আয় ছিল এক টাকা, তারা মূলত মোটামুটিভাবে শুধু পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে পারত, কিন্তু সেই সময়ে কতজন সপ্তাহে এক টাকা আয় করতে পারত সে হিসাব করলে সংখ্যাটি অনেক কম হয়। তাই বলা যায়, সে সময়ের ভারতবর্ষের সম্পদশালী অঞ্চল বাংলায় সম্পদের মতো বৈষম্যও ছিল বিপুল ও ব্যাপক। বরং এ অঞ্চলে ব্যাপক অসমতা না থাকাটাই হতো ব্যতিক্রম।  

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পদশালীদের গুরুত্ব দিয়ে তাদের স্বার্থে আইন ও নীতি প্রণয়ন করে তা সমাজের অপর সদস্যদের স্বার্থের মূল্যে পুনরায় সম্পদশালীদের আরও ধনসম্পদ অর্জনে সহয়তা করে। এবং এ সম্পদশালীরা যদি হয় অদক্ষ প্রকৃতির তাহলে সেই সম্পদ আসলে শেষপর্যন্ত কারোরই কাজে লাগে না। তৎকালীন এ অঞ্চল ছিল এরই প্রতিচ্ছবি। তাই ক্লাইভের সামনে সিরাজউদদৌলার সম্পদ লুঠের সামগ্রী হওয়া ছাড়া কোনো কাজে আসেনি।

লেখক: প্রাবন্ধিক

জ্বালানি খাতে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অভাব

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ০১:৫৮ পিএম
জ্বালানি খাতে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অভাব
ড. এম শামসুল আলম

জ্বালানি-নিরাপত্তা খাদ্যনিরাপত্তা থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জ্বালানি-নিরাপত্তা না থাকলে খাদ্যনিরাপত্তাও থাকবে না। জ্বালানি-নিরাপত্তা সংরক্ষণের লক্ষ্যে কত উপায়ে সহনীয় ও সাশ্রয়ী মূল্যে জনগণের কাছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সে চেষ্টায় বিশ্বের নানা দেশের সরকার গলদঘর্ম। জ্বালানি-নিরাপত্তা অনিশ্চিত হবে। অর্থনীতি আরও বেশি কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।…

বাংলাদেশে কোনো পণ্যের মূল্যের ওপর বাজার কিংবা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কোনো পণ্যের আমদানি বা বিক্রি সবকিছু বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হলে বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতা থাকতে হয়। নাহলে সরকারকেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বাংলাদেশের বাজারে প্রতিযোগিতা নেই। ভোজ্যতেল, আটা, চাল, ডিম ও চিনি- এসব নিত্যপণ্যের দাম ব্যবসায়ীরা যখন ইচ্ছা তখন বাড়ায়, সেটা থেকেই বোঝা যায় যে বাজারে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। এসব পণ্য সরবরাহ গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে। 

জ্বালানি বাজার বিদ্যমান আইন অনুযায়ী রেগুলেটেড বা নিয়ন্ত্রিত। আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবুও জ্বালানি খাত নিয়ন্ত্রণে নেই। অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা বৃদ্ধি তথা অসাধু ব্যবসা প্রতিরোধ করা যায়নি। বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। বরং সরকার নানা পলিসি ও আইন তৈরির মাধ্যমে তাদের স্বার্থ সুরক্ষা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। বাংলাদেশে এলপিজি আমদানি হয় বেসরকারি খাতে।

সরকারি খাতে উৎপাদিত যৎসামান্য এলপিজি সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি এলপিজিসিএল বাজারজাত করে। সে এলপিজি খোলা বাজারে আসে না। আমদানি করা এলপিজির মূল্য অপেক্ষা প্রায় অর্ধেক মূল্যে এ এলপিজি সমাজের এক শ্রেণির সুবিধাভোগী গ্রাহক পায়। ক্যাবের পক্ষ থেকে সাশ্রয়ী মূল্যের এ এলপিজি বস্তিবাসীকে এবং ক্ষুদ্র হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোয় সরবরাহ করার দাবি করা হয়। কিন্তু সে দাবি জ্বালানি বিভাগ আমলে নেয়নি। বরং নানা পলিসি প্রণয়ন করে এলপিজির বাজারে অলিগোপলি প্রতিষ্ঠিত করে।

 সরকারি এলপিজি সাশ্রয়ী দামে না দিয়ে একদিকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করছে, অন্যদিকে কিছু এলপিজি ব্যবসায়ীকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বেশি লাভ করার সুযোগ দিচ্ছে। এতে জ্বালানি বিভাগ সাধারণ মানুষকে ন্যায্য দামে এলপিজি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে এবং তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অবশেষে হাইকোর্টের বাধ্যতামূলক আদেশে বিইআরসি এলপিজির মূল্যহার প্রতি মাসেই পুনর্নির্ধারণের আদেশ দেয়। সে আদেশ না মানা বিইআরসি আইন মতে দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ এলপিজি ব্যবসায়ীরা সে আদেশ মতে নির্ধারিত মূল্যহার অপেক্ষা অধিক মূল্যহারে এলপিজি বিক্রি করে লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এ অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিইআরসি নিষ্ক্রিয়। জ্বালানি তেল আমদানিতে তিনটি পর্যায়ে ব্যবসা হয়- (ক) আমদানি, (খ) মজুত ও (গ) বিতরণ। এ তিনটি ব্যবসার জন্য পৃথক পৃথক তিনটি লাইসেন্সের বিধান রয়েছে। বিইআরসি আইন অনুযায়ী, এ তিনটি ব্যবসা তিন আলাদা আলাদা প্রবিধান দ্বারা বিইআরসির আওতাধীনে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আইন লঙ্ঘন করে বিইআরসির পরিবর্তে জ্বালানি বিভাগ নিজেই তিনটি পর্যায়েরই ব্যয়হার গণশুনানি ছাড়াই জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণ করে। এ অবৈধ উপায়ে নির্ধারিত মূল্যহারে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা সম্পৃক্ত থাকে।

বিশ্বের বহু দেশেই বেসরকারি খাত জ্বালানি সরবরাহ করে। সেসব দেশে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে, আছে আইনের কঠোর প্রয়োগ। আবার বাজারে প্রতিযোগিতাও আছে। বাংলাদেশে এর কোনোটিই নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেখানে সামান্য ভোজ্যতেলের দামই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, সেখানে জ্বালানি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা কোনোভাবেই ভাবা যায় না।

 আইনের কার্যকারিতা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। বেসরকারি খাতের অবস্থা আরও নাজুক। কী দরে পণ্য আমদানি হয়, আর কী দরে বিক্রি হয়, তার হিসাব কে রাখে? এলপিজি ব্যবসায় কী চলছে? বিইআরসি যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, বাজারে সে দামে এলপিজি বিক্রি হয় না। জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হলে এ অবস্থাই হবে। তাতে ভোক্তার কী অবস্থা হবে! শুধু ভোক্তা কেন, শিল্পোদ্যোক্তাদেরই-বা কী অবস্থা হবে! উৎপাদন খাতে জ্বালানি নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিতে পড়বে? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এসব কোনো কিছুই না ভেবে জ্বালানি আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা তোতাপাখির শেখানো কথার মতো করে বলা হচ্ছে। 

ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেওয়ায় এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে। ভোক্তাও বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পর্যায়ে। তাতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যয় বাড়বে। গ্যাস সরবরাহ কমলেও সঞ্চালন ক্ষমতা ও ব্যয় বাড়ছে। বিদ্যুৎ আমদানি বাড়ছে। ফলে ব্যয় বাড়ায় মূল্যহার ও ভর্তুকি বাড়ছে। গ্যাস আমদানি বৃদ্ধিতে গ্যাসে ভর্তুকি ও মূল্যহার বাড়ছে। আবার জ্বালানি আমদানি বেসরকারি খাতে হবে। তাতেও জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধিতে জ্বালানি মূল্যহার আরও বাড়বে। সর্বোপরি লুণ্ঠনমূলক মুনাফা স্ফীত হবে। জনগণ ও রাষ্ট্রের ক্ষত বাড়বে। চাহিদার তুলনায় এলপিজি সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় আড়াই গুণ। 

কাজ লাগে কম-বেশি ৪০ শতাংশ। বাদবাকি ৬০ শতাংশই কাজে লাগে না। তাতে সরবরাহ ব্যয় বাড়ে। এ ব্যয়বৃদ্ধি ব্যবসায়ীর মুনাফা বাড়ায় এবং ভোক্তাকে ন্যায্য ও সঠিক মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে এলপিজি কিনতে হয়। শুধু তাই নয়, আশ্চর্যের বিষয় হলো, ২০২১ সালে গণশুনানিতে উপস্থাপিত তথ্যাদিতে জানা যায়, এলপিজি আমদানিতে জাহাজ ভাড়া বাবদ টনপ্রতি ব্যয় ভারতে কম-বেশি ২০ ডলার। বাংলাদেশে কম-বেশি ১১২ ডলার। এমন অসংগতির কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগকৃত মূলধনের ওপর ১৮ শতাংশ এবং মোটের ওপর আরও ১৮ শতাংশ হিসেবে মুনাফা চায়। বিইআরসির মানদণ্ডে তা ৪.১৮-৪.৫৮ শতাংশ। এ দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায়, তেল-গ্যাস আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হলে মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে ভোক্তারা কী পরিণতির শিকার হবে। এ কথা সত্য, বিপিসিতে প্রচুর অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। সেখানে প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা এবং সুশাসনের বড় অভাব। জবাবদিহি নেই। তাদের অন্যায়, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনমূলক কর্মকাণ্ডে জ্বালানি বিভাগের প্রশ্রয় রয়েছে। আমরা এসবের প্রতিকার ও প্রতিরোধ চাই। অথচ বিপিসির দুর্নীতি বন্ধ না করে, তার সার্বিক সক্ষমতা উন্নয়নে দৃষ্টি না দিয়ে বেসরকারি খাতকে জ্বালানি আমদানি করার ক্ষমতা প্রদান দেশের স্বার্থ বিনষ্টের শামিল। সরকার জনসাধারণের স্বার্থ সুরক্ষার দায় 
নিতে অনাগ্রহী। সরকারে এমন অবস্থা রাষ্ট্রের দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।


ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেসওয়েল আমদানি যখন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপিসি কর্তৃক সরবরাহকৃত ফার্নেসওয়েলে কোনো দোষ-ত্রুটি পিডিবি পায়নি। অথচ এমন অজুহাতে বেসরকারি খাতকে ফার্নেসওয়েল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। ২০২২ সালে গণশুনানিতে বলা হয়, বিপিসির কাছ থেকে পিডিবি প্রতি টন ফার্নেসওয়েল কেনে ৭৪ ডলার মূল্যে। অথচ বেসরকারি খাতকে দিতে হয় ৯২ ডলার। তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ে বছরে কম-বেশি ৮ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেসওয়েলের প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি হয় বেসরকারি খাতে। জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি বৃদ্ধি হয় কেন- এ প্রশ্নের উত্তর ওই ৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়েই নিহিত এবং তেল ও গ্যাস আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার কারণও এখানেই নিহিত।
জ্বালানি-নিরাপত্তা খাদ্যনিরাপত্তা থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 জ্বালানি-নিরাপত্তা না থাকলে খাদ্যনিরাপত্তাও থাকবে না। জ্বালানি-নিরাপত্তা সংরক্ষণের লক্ষ্যে কত উপায়ে সহনীয় ও সাশ্রয়ী মূল্যে জনগণের কাছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরaবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সে চেষ্টায় বিশ্বের নানা দেশের সরকার গলদঘর্ম। অথচ বিগত সরকার এ খাতকে বেসরকারি খাতের হাতে তুলে দিয়ে নিজে দায়মুক্ত হতে চেয়েছিল। খাদ্য ব্যবসায়ীরা লুণ্ঠনমূলক মুনাফা লাভের সুযোগ পায়। জ্বালানি আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হলে জ্বালানি ব্যবসায়ীরাও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা লাভের সুযোগ পাবে। জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত হবে। অর্থনীতি আরও বেশি কঠিন চ্যালেঞ্জের 
সম্মুখীন হবে।

লেখক: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ