
আমরা তরুণদের মনে যেমন আনন্দ দেখি তেমনি আবার আক্ষেপও দেখি। যখন শ্রেণিকক্ষে যাই, তখন দেখি শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে অনেক আক্ষেপ এবং হতাশা। এর মূল কারণ কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার একটি পর্যায়ে গিয়ে ভাবতে শুরু করে, তারা কি কর্মসংস্থানের দৌড়ে নিজেকে সফল করতে পারবে? মেধাবীরা অবশ্য বেশ আত্মবিশ্বাসী। বিগত কয়েক বছরে অসংখ্য মেধাবী তাদের যোগ্যতাবলে সরকারি চাকরি পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মেধাবীরাই যে চাকরি পেয়েছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশেষ করে ২০১৮ সালে কোটা বাতিল হওয়ার পর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে একদম খাঁটি মেধাবীদের চাকরি পাওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে বেড়েছে। এমনকি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) নিরপেক্ষতাকে আমরা প্রশংসার জায়গায় রাখতে পারি। আগে আমরা একসময় শুনতাম মামা-খালু না থাকলে চাকরি হয় না। এমনকি এক সময় প্রচুর অর্থ লেনদেন হতো চাকরি পাওয়ার বিনিময় হিসেবে। দীর্ঘদিন থেকে নানা ধরনের কোটা বিভিন্ন চাকরিতে মেধাবীদের বঞ্চিত করেছে। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাতিল হওয়ার পর শুধু মেধাবীরাই সুযোগ পেয়েছে।
আমরা জানি, আমাদের তরুণগোষ্ঠীর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস আর অজেয়কে জয় করার অসীম সম্ভাবনা আছে। নতুন চিন্তা আর ভেতরের সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করার অদম্য সাহস আছে। অন্যদিকে, এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াও আছে। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, তরুণদের এগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা আছে। সম্প্রতি আদালতের রায়ে কোটা পুনর্বহাল হওয়ায় সারা দেশে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে।
আমরা চাই তরুণরা যেমন নিজেদের জীবন গড়বে, তেমনি জীবন গড়ার জাদুকরী শক্তি নিয়ে অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে। এ ক্ষেত্রে শুধু মেধাবীরাই পারে দেশকে ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত জায়গায় নিয়ে যেতে। আর এসব মেধাবীর জন্যই আমরা আশাবাদী হই যে, দেশ একদিন সত্যিকার অর্থেই সোনার বাংলায় পরিণত হবে। মেধাবীরাই দেশের স্বপ্নবাজ, আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী।
আমি নিজে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি। আমি কখনোই কোটাকে সমর্থন করি না। ইতিপূর্বে আমি অসংখ্যবার কোটার বিপক্ষে লিখেছি। বিশেষ করে কোটা সংস্কার নিয়ে ২০১৮ সালে যখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল, তখন লিখেছিলাম। এ জন্য অতি উৎসাহীরা আমাকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে বলে গালি দিয়েছিল। অবশ্য আনন্দের খবর হলো তাদেরই কেউ কেউ এখন কোটার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও নানা ধরনের কোটা রয়েছে।
এমনকি কোটা প্রয়োগে যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। কোটার ভেতরে কোটা প্রয়োগের বিষয়টিও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে পোষ্য কোটার নামে চাকরিপ্রাপ্তির যে বৈষম্য চালু রয়েছে সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে কোটাপদ্ধতিতে সংস্কার আনার দাবিতে সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলনে ছিল। মাঝে শর্তসাপেক্ষে কোটা বাতিল করা হয়েছিল। সম্প্রতি আদালতের রায়ে কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা আবারও রাজপথে।
আন্দোলনে তারা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান এবং স্বীকৃত জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করছে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের হাতে প্রদর্শিত প্ল্যাকার্ডগুলোতে বঙ্গবন্ধুর ছবি এবং তার দেওয়া বক্তব্য লিখে রেখেছেন। আবার অনেক শিক্ষার্থীর হাতে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ছবি। অনেক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবিও হাতে রেখেছেন তারা। দীর্ঘদিন থেকে কোটা সংস্কারের পক্ষে যারা আন্দোলন করছেন তাদের একটি শঙ্কা বারবার কাজ করেছে- সেটি হলো তাদের সরকার-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার শঙ্কা।
অনেক ক্ষেত্রে তাদের ওপর নানা ধরনের মানসিক চাপও সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য অনেকেই ইতিপূর্বে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। যদিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী এই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত আছেন। তবে খুব ন্যায্যভাবেই অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও যুক্ত আছেন এই আন্দোলনের সঙ্গে। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও কোটা বাতিল কিংবা সংস্কারের পক্ষে কথা বলেছেন।
তবে এ কথাও ঠিক যে, রাজনৈতিক একটি মহল এমন ইতিবাচক আন্দোলনকে ভিন্নভাবে কাজে লাগানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যারা কোটা সংস্কারের পক্ষে মাঠে নেমেছে তাদের বেশির ভাগই বর্তমান সরকারের কার্যক্রমকে ইতিবাচকভাবেই দেখে। কিন্তু কোনো কোনো প্রেক্ষাপটে যখন দেখি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন কষ্ট পাই।
বিশেষ করে, কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের উসকানিমূলক একটি বক্তব্য চোখে পড়ল। এর আগেও অর্থাৎ ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনের সময় বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষকের কথোপকথন। যেখানে পরিষ্কারভাবে আন্দোলনকে চাঙ্গা করার ইঙ্গিত ছিল। আমরা সব সময়ই চাইব ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক আন্দোলন সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে যাক। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা রাজনীতিকরণ কাম্য নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সমান সুযোগের নিশ্চিয়তার বিধান থাকলেও কোটাপদ্ধতির ফলে সেটা যথাযথভাবে অনুসরণ সম্ভব নয়। সংবিধানে অনগ্রসর সমাজের জন্য একটি ব্যতিক্রম ব্যবস্থা হিসেবে কোটাপদ্ধতি সংরক্ষণের বিধান থাকলেও দেশের সমগ্র নাগরিকের সমান সুযোগের নিশ্চয়তাকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে। কোটাপদ্ধতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অর্থাৎ চাকরিভেদে ভিন্ন ভিন্ন কোটা অনুসরণ করাতে এর স্বচ্ছতা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব সমাজের ওপর পড়ছে, যা জাতিকে যথাযথ অগ্রসর করতে বাধাগ্রস্ত করছে।
আমরা দেশকে এগিয়ে নিতে সবসময়ই তরুণদের সম্পৃক্ত হতে বলি। এজন্য তরুণদের ন্যায্য অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করি। তরুণদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা যেন আকাশছোঁয়া। কিন্তু যুক্তিসংগতভাবে মেধাবীদের দেনা-পাওনার হিসাবটা তো মেলাতে হবে। কীভাবে মেলানো সম্ভব সেটি নিয়েই আমাদের বেশি ভাবতে হবে। আমরা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করি। কিন্তু কীভাবে সেই উন্নয়ন হবে তা নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়ে সতর্কতা জরুরি।
দেশের মেধাবী তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে না পারলে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। কারণ মেধাবী তরুণগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম। তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুততর এবং টেকসই করা সম্ভব।
কোটা আন্দোলনের আবার যে রূপ দাঁড়িয়েছে, তাতে কোটা সংস্কার বা বাতিলের পক্ষে না গিয়ে কোনো উপায় থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এই মুহূর্তে প্রত্যাশা রাখছি, আবারও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কোটা সংস্কার বা বাতিলের একটি ন্যায্য ও যুক্তিসংগত সমাধান সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের মুখে হাসি ফোটাবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]