বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল- বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রে চাকরিতে যে কোটা পদ্ধতি প্রচলিত আছে তার সংস্কার করা। সেই আন্দোলন প্রথম দিকে বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। যদিও জনগণের চলাচলে একটু কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ছাত্ররা কারও গাড়ি ভাঙচুর করা, আগুন দেওয়া- এসব থেকে বিরত ছিল। ছাত্ররা যেসব জায়গায় সমাবেশ করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেসব জায়গায় সুরক্ষা দিয়েছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যেদিন মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দিতে গেল, সেদিন তারা সচিবালয়ের সামনের ব্যারিকেড উঠিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে এগিয়ে গেল। পুলিশও তাদের সঙ্গে সঙ্গে গেল। কিন্তু তখনো পুলিশ তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করেনি।
আমরা ধারণা করেছিলাম, আন্দোলনকারীরা যেভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছে এবং সংযতভাবে আচরণ করছে। এই আন্দোলন কোনোভাবেই সহিংসতার দিকে যাবে না। আমি সারাটি জীবন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝেই কাটিয়ে দিয়েছি। সে কারণেই এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের আমি ভালোমতো জানি। তারা কখানো সহিংসতার দিকে যাবে, তা মনেও করিনি। ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবেই দাবি আদায় করবে, এটাই আমরা ভেবেছি। ছাত্র আন্দোলন সেভাবেই চলছিল।
সরকারবিরোধী কিছু রাজনৈতিক দল তারা প্রকাশ্যে ছাত্র আন্দোলনকে প্ররোচিত করেছে। ছাত্রদের কোটা বাতিলের আন্দোলনকে অন্যদিকে প্ররোচিত করার অর্থই হচ্ছে, সরকারকে চরিতার্থ বা ব্যর্থ করতে চায়। কোটা আন্দোলনকে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যখন সহিংসতার দিকে গেল, তখনই বুঝতে হবে সরকারবিরোধী দলগুলো প্ররোচনা দেওয়ার চেষ্টা করল।
ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে বলা হলো যে, রাস্তায় যেসব গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, বিটিভিতে আগুন, গাড়ি ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অপকর্ম হয়েছে, তার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এ ধরনের কোনো সহিংসতার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলন কোনোভাবেই জড়িত না। এতে বোঝাই যায়, কারা এ কাজগুলো করছে। আমরা রাস্তাঘাটের যে চিত্র দেখছি, গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দিয়ে সহিংসতা করছে তারা আর যা-ই হোক ছাত্র না। সহিংসতাকারীদের বয়স, আচার-আচরণ দেখে তাদের ছাত্র বলে মনে হয় না।
এভাবে ছাত্র আন্দোলনকে সন্ত্রাসী ও সহিংস পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া একেবারেই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের ইন্ধনে হয়েছে। সরকার এগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। ছাত্র আন্দোলনের ৩ জন সমন্বয়ক আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল এবং তারা ৮ দফা দাবি পেশ করেছে। ৮ দফা দাবির মধ্যে যে দাবিগুলো আছে সেগুলো সরকার বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিচার-বিবেচনা করবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কোটাটি ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ৮০ শতাংশ মেধা ও ২০ শতাংশ কোটার মধ্যে রেখে উচ্চ আদালতে আজ উপস্থাপন করা হবে। উচ্চ আদালত সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে আসবে।
ছাত্র আন্দোলনের মূল যে দাবি সেটা হলো কোটা সংস্কার করা। ১৯৭২ সালে থেকে যে কোটা প্রথা চালু হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে তা এখন ৫৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই কোটা সংস্কার চেয়েছে ছাত্ররা। ছাত্রদের এই দাবি যৌক্তিক দাবি। যেকোনো মানুষই মনে করবে যে, কোটার সংস্কার করা দরকার।
সব দেশেই কোটা প্রথা আছে। পৃথিবীর উন্নত, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই কোনো না কোনো কাঠামোতে কোটা প্রথা চালু আছে। কিন্তু কোটা প্রথা চালু হলেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর সেটা পর্যালোচনা করে কমবেশি করা যায়। এ কারণেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে এবং এর সংস্কার করা প্রয়োজন। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা প্রশাসন প্রজাতন্ত্রের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা প্রথা রহিত করেছিল এবং সেভাবেই চলে আসছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রিটের কারণে সেই আদেশ বাতিল করায় ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। সরকারের যে অবস্থান এবং সরকারের উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা, তা কিন্তু একই জায়গায় আবদ্ধ আছে। ছাত্রদের দাবি ও সরকারের অবস্থানের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই এবং এর সমাধানও সম্ভব। এতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।
আমরা সব সময় দেখেছি, দেশে ন্যায়সংগত আন্দোলনের পেছনে কিন্তু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল যুক্ত হয়ে যায়। সেই আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়। গত ২-৩ দিনে আমাদের দেশে যা ঘটল তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মানুষের জীবনকে এভাবে লেলিয়ে দেওয়া যায় না।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এর সমাধান করা সম্ভব। ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার জন্যই সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে এমন কোনো সংকট নেই, যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। কোটা সংস্কারের একটা দাবি উঠেছে। আলোচনা চলছে এবং অচিরেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কোটা সংস্কার সমাধানযোগ্য এবং সমাধানের পথে আছে।
সরকারবিরোধী তৎপরতা আছে এবং তারা যে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে সহিংসতা সৃষ্টি করেছে সরকার তার ব্যবস্থা নেবে। যারা অপরাধী বা সন্ত্রাসী, মানুষের জানমালের ক্ষতি করার জন্য রাস্তায় নেমেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকারবিরোধী আন্দোলন হতে পারে কিন্তু সেই আন্দোলনেরও নিয়ম আছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যখন সন্ত্রাসীরা একত্রিত হয়ে যায়, তখন সেটা আর রাজনীতি থাকে না। তখন সেটা অপরাজনীতিতে পরিণত হয়। আমাদের দেশে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করা লোকের অভাব থাকে না।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে সব মতামত প্রকাশ করা যেতে পারে। কোনো আন্দোলনকেই প্রতিহত করা যাবে না। মানুষের জানমালের ওপর আঘাত করা, সরকারি মালামাল, যানবাহন নষ্ট করা যাবে না। বাংলাদেশ টেলিভিশন একটি সম্প্রচার কেন্দ্রে, এতে যারা আঘাত করে, তারা গণতন্ত্রের শত্রু। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আঘাত এসেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে বাংলাদেশে টেলিভিশনের ভেতরে প্রবেশ করে কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছিল। সেই টেলিভিশনেই আবার আঘাত করা হলো ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। ১৯৭৫ সালে দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঢুকে কর্মকর্তাদের হত্যা করেছিল। এবারেও টেলিভিশনের সম্প্রচার কেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়েছে। যারা এই ধরনের কাজ করেছে, তারা একেবারেই অগণতান্ত্রিক। তারা জনগণের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও কথা বলার স্বাধীনতার ওপর আঘাত করেছে। এমনকি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের ওপর আঘাত করেছে এবং কয়েকজন সাংবাদিক মারাও গেছেন। সাংবাদিকদের ওপর কারা আক্রমণ করে? গণমাধ্যমকেও দমন করার চেষ্টা করছে অপরাজনীতির সন্ত্রাসীরা। ছাত্ররা এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত হতে পারে না। আমি ছাত্রদের বিগত আন্দোলনগুলো দেখেছি, তারা এ ধরনের সন্ত্রাসী আন্দোলনে নেই।
আশা করি, উচ্চ আদালতের রায়ের পরে ছাত্রদের মধ্যে আর কোনো সংশয় থাকবে না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা শুরু করবে। বিশ্ববিদ্যালয় তো শিক্ষার্থীদের জন্যই। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখবে।
উচ্চ আদালতের রায়ের পর ছাত্র আন্দোলনে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেটি কাটিয়ে উঠবে। বর্তমানের আঘাত হলো জনগণের ওপর আঘাত। এই আঘাত সরকার ও জনগণ মিলেই প্রতিহত করতে হবে। তবে যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে বা মানুষের জানমালের ওপর আঘাত করে তারা খুব বেশি দূর আগাতে পারে না। জনগণের সমর্থন ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হয় না। এবারের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের সমর্থন আছে। সে কারণেই অভিভাবকরাও এবারের ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন করেছেন। বিটিভি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এবং সেতু ভবনে আঘাত করা কখনোই জনগণ সমর্থন করে না। জনবিরোধী তৎপরতা বা জনগণের স্বার্থের বাইরের কার্যকলাপ সফলতা দেয় না।
সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের সম্পদ ও জনগণের সম্মান রক্ষা করা। সেই দায়িত্ব সরকারকে যেকোনোভাবেই পালন করতে হবে। এটা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। ছাত্রদের দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে অচিরেই দেশের অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবে সরকার, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়