কোটা সংস্কার নিয়ে চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এ রায়কে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন এবং স্বাগত জানিয়েছেন। কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলনের চরম সহিংস রূপ দেখেছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় সম্পদের চরম ক্ষতি করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনা এ দেশের ইতিহাসে খুবই দুর্ভাগ্য ও দুঃখজনক। ছাত্রদের আন্দোলনের নামে এ রকম সহিংসতা ও তাণ্ডব আগে কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো অশুভ হাত থাকতে পারে। এটা কখনোই ছাত্রদের দ্বারা সংঘটিত কাজ হতে পারে না। এই আন্দোলন শুরুর আগে দেশে শিক্ষক আন্দোলন হলো, যা প্রত্যয় স্কিম নিয়ে। এরপর সরকার দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছিল, যার অংশবিশেষে কিছু দুর্নীতিবাজ ধরাও পড়ল। সাধারণ মানুষ এতে খুশিও ছিল। কিন্তু কী এমন ঘটনা ঘটল যার কারণে দেশে শতাধিক প্রাণহানি ঘটল। অবশ্যই সরকারের গোয়েন্দা বিভাগকে এ ব্যাপারে আরও নজরদারি থাকার দরকার ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সরকার উৎখাতের বিষয়টিও এ বিষয়ের মধ্যে নিহিত ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার বিষয়। যদিও অনেকে সেটাই মনে করেছেন। দেশে জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। দেশে যাতে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করে, জনগণ স্বাভাবিক জীবন পায়, সে জন্য সরকারের এ সিদ্ধান্ত।
সকালে রাস্তা দিয়ে হেঁটে অফিসের দিকে এগোচ্ছিলাম, কথা হলো এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, অনেক শ্রমিক শ্রেণির মানুষকে মিছিলে যাওয়ার ব্যাপারে অর্থ দেওয়া হয়েছে। তারা অর্থ পেয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। অর্থাৎ হতাহতদের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণি বেশির ভাগ অংশজুড়ে রয়েছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ করফিউ, সহিংসতা বোঝে না। তারা চায় দুবেলা পেটের খাবার। পণ্য সরবরাহ কম থাকায় নিত্যপণ্য পেতে জনসাধারণকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিক্রেতারা সব ধরনের নিত্যপণ্য বাড়তি দরে বিক্রি করছেন। এমন অবস্থায় বাজারে গেলে প্রত্যেক ক্রেতারাই চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা। দেশের সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে বাজার তদারকি না থাকায় ব্যবসায়ীরা যে যেমন পারছেন দাম সেভাবেই নিচ্ছেন। এভাবেই বিক্রেতারা ভোক্তার পকেট কাটছেন। রাজধানীর সব কাঁচাবাজারের অবস্থা প্রায় একই। এ অবস্থায় সরকারকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বাজারও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। উৎপাদন বন্ধ থাকায় পোশাক খাতে প্রতিদিন ক্ষতি ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (বিজিএমইএর, সভাপতি)। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকির সম্ভাবনাও রয়ে গেছে। টানা অচলাবস্থায় কেউ কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসায়িত হবেন। সবকিছু মিলিয়ে আগামীতে অর্থনীতির দুর্দিন আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
কারফিউ চলাকালে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় পুরো দেশের আর্থিক কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে। এ কারণে অর্থনীতিতে হতাশা বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছেও নেতিবাচক বার্তা যাবে। ডিজিটাল সব সেবা বন্ধ হয়ে গেছে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায়। ব্যাংকিং সেবা বন্ধ থাকায় মানুষ চরমভাবে ভোগান্তিতে পড়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির প্রি-পেইড গ্রাহকদের সীমাহীন দুর্ভোগ বেড়েছে। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় প্রি-পেইড কার্ড রিচার্জ করতে পারছেন না রাজধানীসহ সারা দেশের গ্যাস ও বিদ্যুতের গ্রাহকরা। এ ছাড়া ওয়াসার এটিএম বুথ থেকে যারা প্রি-পেইড কার্ড দিয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতেন, তারাও পানি পাচ্ছেন না।
সাধারণ ছুটিতে ব্যাংক বন্ধ থাকায় নগদ অর্থ তুলতে না পেরে দুর্ভোগে পড়েছে অগণিত মানুষ। জীবনযাপনের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটাও থমকে গেছে। সাধারণ ছুটির সঙ্গে কারফিউ আরও দীর্ঘায়িত হলে মানুষের মধ্যে অনিশ্চিত আশঙ্কা তৈরি হবে। সাধারণ ছুটি চলাকালে আগের মতো এটিএম বুথের সেবা চালু থাকার ঘোষণা থাকলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় নগদ অর্থ উত্তোলনসহ ব্যাংকের নানাবিধ সেবা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেও এমএফএস (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস) অপারেটরদের মধ্যে বিকাশ ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
জরুরি প্রয়োজনে যারা বাইরে বের হচ্ছেন, সেখানেও ভোগান্তি থেমে নেই। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কয়েক গুণ ভাড়া হাতিয়ে নিচ্ছেন পরিবহনচালকরা। এ ছাড়া রোগীকে হাসপাতালে নিতে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে স্বজনদের। তথ্যমতে, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে প্রায় ৬৭০ জনের মতো পর্যটক আটকা পড়েছেন।
অস্থির সময় থেকে মুক্তির জন্য দেশবাসী পরিত্রাণ চায়। আমরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি সেই দিনটির জন্য। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসার জন্য এক বুক আশা করে থাকা ছাড়া আর কোনো পথ নেই আমাদের সামনে। শিক্ষার্থীরা তাদের রায় পেয়েছেন। তারা অতিদ্রুত আন্দোলন পরিহার করে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাবেন। তাদের নিরাপত্তায় সরকার তৎপর হবে। তাদের আন্দোলন কলুষিত করতে তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব হয়েছে, এটা এখন অনেক মহলই নিশ্চিত করেছে। শিক্ষার্থীদেরও শুভবুদ্ধির উদয় হবে এ শিক্ষার মাধ্যমে। দেশের সরকার ও নীতিনির্ধারণীদের আরও দূরদর্শী হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে অত্যন্ত সহনশীলতার সঙ্গে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আরও তৎপর হয়, সে বিষয়টি নজর দিতে হবে।
আশঙ্কা প্রকাশ করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের বাতাবরণে তরুণ প্রজন্মের একাংশের মানসিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভাবধারা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা দেশের জন্য বড় আশনিসংকেত। তারা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যা হচ্ছে, তা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুব অবমাননাকর।
যে ক্ষত নিয়ে দেশ দাঁড়িয়ে আছে, তা সারাতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যাবে। অনেকগুলো জীবনের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রশমিত হলো ঠিকই, কিন্তু এর রেশ রয়েই গেল। এখন শিক্ষার্থীরা যে দাবিগুলো তুলে ধরছেন সরকারের কাছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। আদালতের প্রতি সম্মান জানিয়ে শিক্ষার্থীদেরও সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে হবে। সরকার দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সেই পরিবেশ সুনিশ্চিত করবে। আমরা সাধারণ মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে আর থাকতে চাই না। আমরা শান্তি চাই। পরিত্রাণ চাই সব হানাহানি থেকে। বাংলাদেশে শান্তি ফিরে আসুক, সেটাই কামনা করছি।
লেখক: উপসম্পাদক (সম্পাদকীয়, সাহিত্য বিভাগ)
খবরের কাগজ ও ইতিহাস গবেষক
[email protected]