সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটাবিষয়ক রায় দিয়েছেন গত ২১ জুলাই। গণমাধ্যমে দেখেছি যে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে আদালতের বিধান মেনে রচিত প্রজ্ঞাপনের খসড়ায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। রায়ের পর দুই দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন মহল এর প্রতিক্রিয়া জানানো শুরু করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, নাগরিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যেমন- জাতীয় মহিলা পরিষদ এবং আদিবাসী ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংগঠন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ইতোমধ্যে তাদের মতামত জানিয়েছে। ৬৬টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি তাদের বক্তব্যে বলেছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর একটি হলো নারী-পুরুষের সমতা। সেই লক্ষ্যে যেতে হলে নারীদের জন্য কোটা অবশ্যই প্রয়োজন।
২০২২ সালের সরকারি জনশুমারি অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫১ শতাংশ নারী। এর অর্থ হলো এই যে দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। তবে সরকারি চাকরিতে নারীদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে সাড়ে ১৪ লাখেরও বেশি কর্মচারী রয়েছেন; যার মধ্যে নারীর সংখ্যা ৪ লাখ ৯ হাজার ৬৮ জন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ নিয়োগ হতো কোটার মাধ্যমে। এই ৫৬ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ নারী; কেননা বিভিন্ন কারণে চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ এখন অনেক কম। এ জন্য সরকারি চাকরিতে নারী কোটা রাখা প্রয়োজন। তাই নারী কোটা তুলে দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। চাকরিতে নারী-পুরুষের যে বৈষম্য আছে তা দৃশ্যমানভাবে কমে যাওয়ার পর নারী কোটা বিলুপ্ত করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নারীদের উপযুক্ত মূল্যায়ন হচ্ছে না।
এ ধরনের দৃশ্যমান বৈষম্য থাকার পরও কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় কিছু নারী শিক্ষার্থীকে বলতে শুনলাম ‘নারী কোটায় চাকরি পাওয়া লজ্জাজনক’। প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীরা কি বাংলাদেশের সব নারীর প্রতিনিধিত্ব করছেন? উত্তর হচ্ছে ‘না’। কারণ এই নারী কোটা সমাজের পিছিয়ে পড়া নারী জনগোষ্ঠীর জন্য। বেসরকারি সংস্থা এলকপের গবেষণায় উঠে এসেছে এসব পিছিয়ে পড়া নারীর কথা। ঢাকা শহরের নারীরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান, দেশের অন্যান্য জেলা বা উপজেলা শহরের মেয়েরা কি সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা পান? পাবনার সাঁথিয়া থানার তাঁতহীন তাঁতি শেফালি মোল্লাকে বাঁচাতে হলে সরকার এখন কোন কোটায় তাকে চাকরি দেবে? দিনাজপুরের কাহারোল থানার ভূমিহীন সাঁওতাল হেমলতা বাস্কে বা হরিজন পল্লির মিনা কুমারীর প্রতিনিধিত্ব কি ঢাকার নারী শিক্ষার্থীরা করছেন? আমার মনে হয় তারা ‘না’ বুঝে বা কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ ধরনের বক্তব্য গণমাধ্যমের সামনে দিয়েছেন। সবার স্মরণ করা প্রয়োজন, যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য আলাদা ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে, সেখানে কীভাবে নারীদের কর্মজীবন নিশ্চিত করার জন্য কোটা থাকবে না।
২.
এবার আসা যাক জেলা কোটায়। সরকার ২০১৮ সালের পরিপত্রের আগ পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে ১০ শতাংশ ছিল বিভিন্ন জেলার জন্য বরাদ্দকৃত। আমাদের দেশের প্রতিটা জেলায় বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সমানভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, মূল বাজেটের বাস্তবায়ন একেক জেলায় একেক রকম হওয়ার ফলে প্রতিটা জেলার জনগণ সমানভাবে সরকারি চাকরি লাভ করেনি। এর বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা সরকারি চাকরি লাভের ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। উল্লেখ্য যে, সব জেলায় মানসম্মত শিক্ষার হার সমান নয় বলে ৯ম গ্রেডের চাকরিতে সব জেলার প্রতিনিধিত্ব দেখা যায় না। ঘূর্ণিঝড় আইলার ভিকটিম সাতক্ষীরার পানখালির বাসিন্দা রবিউল ইসলামের মেয়ে ভেবেছিলেন ১৩তম গ্রেডে চাকরির জন্য। ভাইভাতে গিয়ে হয়তো জেলা কোটার বদৌলতে সরকারি চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করতেন, কিন্তু এখন আর পাবেন কি না, জানেন না।
এর বাইরে সমতলের আদিবাসী ও নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ, যা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। মাত্র ১ শতাংশ কোটা দিয়ে মৌলভীবাজারের খাসিয়া জনগোষ্ঠী বা গাইবান্ধার সাঁওতালদের বা পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ম্র’ জনগোষ্ঠীর ন্যায্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব? রাজনৈতিক ডামাডোলে সমতলের আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আর পিছিয়ে পড়বে বলে প্রতীয়মান হয়।
৩.
আপিল বিভাগের রায়টি সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছি, তার ভিত্তিতে বলা যায় একটি ‘সাংলাপিক’ আবহে রায়টি প্রদান করা হয়েছে। সাংলাপিক বলছি এ কারণে যে, আপিল বিভাগ একদিকে ‘বিচারিক আত্মনিয়ন্ত্রণ’ (judicial self-restraint)-এর নীতি প্রয়োগ করে বলেছেন নীতিনির্ধারণী বিষয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে, বিচার বিভাগের নয়। অন্যদিকে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের বরাত দিয়ে নির্বাহী বিভাগকে ৭ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। উল্লিখিত দুই নীতির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনে আলোচিত দুই নীতির, অর্থাৎ কোটা সংস্কারের এখতিয়ার নির্বাহী বিভাগের এবং বিচার বিভাগ এই বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন- সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। বলা যায়, এই রায়ের মাধ্যমে আন্দোলনকারী পক্ষ ও নির্বাহী বিভাগ সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার পেয়েছে বলে সন্তুষ্টি লাভ করবে। আমার মনের শঙ্কাটি হচ্ছে, ভবিষ্যতে আবার কোনো পক্ষ হয়তো আন্দোলন শুরু করতে পারে বা আদালতে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে রিট মামলা করতে পারে। দেশের নারী জনগোষ্ঠী ও সমতলের আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়নের যে আকাঙ্ক্ষা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রচিত সংবিধানে প্রতিভাত হয়েছে, তা এই রায়ে কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? সম্পূর্ণ রায় হাতে পেলে সেই আলোচনা করব। আপাতত, নির্বাহী বিভাগকে এই প্রবন্ধে আলোচিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনার বিনীত অনুরোধ রইল।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন