ঢাকা ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

হাওয়ায় ভেসে থাকা থেকে মাটিতে নেমে আসার অনুভূতি

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪২ এএম
হাওয়ায় ভেসে থাকা থেকে মাটিতে নেমে আসার অনুভূতি
অমিয় দত্ত ভৌমিক

আজ থেকে পাঁচ শ বা হাজার বছর পর ইন্টারনেট আবিষ্কারের আগের সময়টাকে বলা হবে আদিম যুগ। আর আমরা যেটাকে আদিম যুগ বলছি সেটাকে ‘আদিম দাদার যুগ’ বলা হতে পারে। সে হিসেবে আমরা যারা ইন্টারনেট যুগের আগে জন্মেছি তারা আদিম যুগের মানুষ হিসেবে বিবেচিত হব। আর যারা এই আদিম যুগের শেষ ধাপ আর ইন্টারনেট যুগে প্রবেশের সময়টা দেখেছি, তারা কোন হিসেবে বিবেচিত হব, তার সঠিক নাম আমি এখনো দিতে পারছি না।

আজ আমার এই লেখাটি যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। আমরা যারা আদিম যুগ থেকে ধীরে ধীরে ইন্টারনেট তথা আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছি, তাদের কাছে বিষয়টি বেশ মজার। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বা তারপর যারা জন্মেছে তারা আদিম যুগের মধ্যে পড়ছে না। তবে তার বাবা-মা, দাদা-দাদিরা আদিম যুগের।

আধুনিক যুগে প্রবেশের পর থেকে আমরা কমবেশি সবাই আদিমতা ভুলে এই যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখে গেছি। আমাদের হাতে আদিমকালে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিকস জিনিসের পরিবর্তে চলে এসেছে অত্যাধুনিক সব ডিভাইস। এগুলোই এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। এক দশক আগেও কিছু কিছু অফিস-আদালতে ‘সেমি আদিম’ যুগের ইলকট্রনিকস জিনিসের ব্যবহার ছিল। 

বিশেষ করে দেশে-বিদেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে টেলিফোনের ল্যান্ডলাইন, ফ্যাক্স ইত্যাদি। ধীরে ধীরে এগুলোও আর ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক অফিসে যন্ত্রটি থাকলেও তা সচল আছে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ আছে।

আধুনিক যুগে প্রবেশের পর আমরা সবচেয়ে বেশি যে জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তা হলো ইন্টারনেট। এর ব্যবহার এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সব জায়গাতেই এটি সমানভাবে সমাদৃত। আমাদের কাছে এটি এখন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হয়েছে। অনেককে তো বলতে শোনা যায়, এটি নাকি অনেক ক্ষেত্রে ‘টনিক’ হিসেবে কাজ করে। 

সন্তান লালন-পালন করতে ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলেও অনেকে অভিমত দেন। আবার এর বদৌলতে ঘরে বসেই দলবদ্ধ আড্ডাও চলে। যাক ওসব কথা। আসি সাম্প্রতিক বিষয়ে।

মাঝেমধ্যে এই ইন্টারনেট ডাউন হয়ে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছু বিষয়ের সঙ্গে আমাদের কমবেশি পরিচয় আছে। এটা স্বল্প সময়ের জন্য হতো। তবে বিকল্প ব্যবস্থাও থাকত। কোম্পানি বদল করে বা একসঙ্গে একাধিক সংযোগ ব্যবহার করে সবাই কাজ চালিয়ে নিতে পেরেছেন। 

কিন্তু গেল কয়েক দিন দেশজুড়ে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংস আন্দোলনের ফলে বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। এটাও সপ্তাহখানেক হয়ে গেল। এর প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন বিরাট ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি জনজীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার! যারা শতভাগ ডিজিটাল জীবনযাপন করেন, তাদের তো ‘ঘোর কলি’ চলছে। তাদের খাওয়া, ঘুম, চলাফেরা সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

অন্যদিকে ইন্টারনেটের বদৌলতে সংবাদমাধ্যমেও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। আগে যেভাবে সংবাদ সংগ্রহ বা প্রকাশ করা হতো, তা থেকে সরে আধুনিক যত পদ্ধতি আছে সবই ব্যবহৃত হচ্ছে এই দুনিয়ায়। ফলে সংবাদ সংগ্রহে সংবাদমাধ্যমগুলোকে বেগ পেতে হচ্ছে। 

আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বড় একটা অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ভিত্তি করে মূল ধারাকে ছাড়িয়ে ফেসবুক বা ইউটিউবকে সংবাদ পাওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম মনে করে থাকে। ফলে এসব নেশাতুরদের চলছে ‘ঘোর কলি’।

অন্যদিকে যারা, আধা আদিম আর আধা আধুনিক তারা একটা অন্য রকম অনুভূতি পাচ্ছেন। অনেক দিন পর এমন একটা সময়ের অপেক্ষা হয়তো তারা করেননি। কিন্তু যেকোনোভাবেই হোক, এমন একটা সময় তারা উপভোগ করছেন। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের মতো সেই দিনগুলো অল্প সময়ের জন্য হলেও ফিরে পেয়েছেন। আর চলমান ইন্টারনেটবিহীন পারিবারিক আড্ডায় সন্তানদের সঙ্গে আদিম হতে যাওয়া যুগের কিছু প্রচলিত সামাজিক ও পারিবারিক চিত্র কেমন ছিল তা হয়তো বোঝাতে পারছেন।

আমরা যান্ত্রিক জীবনে শুধু ছুটছি আর ছুটছি। যতটুকু সময় ঘরে কাটানোর সুযোগ হয় তারও অধিকাংশ কেটে যায় মোবাইল ফোন ঘিরে। এতে এক সময়ের পারিবারিক রীতিগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই কয়েক দিন ভাসমান দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অনুভূতি নতুন প্রজন্মের কাছে একেবারেই অনভিপ্রেত। তবে তাদের আগের প্রজন্মের থেকে শোনা কথাগুলো সপ্তাহখানেক আগ পর্যন্ত অনেকটা গল্পের মতো লাগলেও তা যে সত্যিই এমন ছিল, এটা নিশ্চয়ই বুঝতে আর বাকি থাকার কথা নয়।

যে শিশুটি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল সেটে গেম খেলত, সে এখন টেলিভিশন দেখছে। অনেকেই লুডু খেলছে। সবকিছু বন্ধ থাকায় পরিবারের সবাই বসে টেলিভিশনে সিনেমা বা নাটক দেখছে। খাবার টেবিলে বসে দাদা-দাদি, মা-বাবার সঙ্গে আড্ডা হচ্ছে। পরে পড়বে বলে ফেলে রাখা বইগুলোও হয়তো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। 

মোট কথা, এক ছাদের নিচে থেকেও যে পরিবারের সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব ছিল তা অল্প সময়ের জন্য হলেও সবার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে। 

এই ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা আমাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে পেছনে নিয়ে গেলেও পরিবার বা সমাজের যে আলাদা একটা প্রাণ আছে, তা এই প্রজন্মের সামনে হাজির করতে পেরেছে।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, খবরের কাগজ

রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির দুর্দশা তাড়াতে হবে

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৫৮ এএম
রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির দুর্দশা তাড়াতে হবে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবেই গৃহীত হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল যে, এরা হলো রাষ্ট্রের মতাদর্শিক স্তম্ভ এবং সেই সঙ্গে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের স্মারক। আশা করা গিয়েছিল যে, তারা কখনোই পরিত্যক্ত হবে না। তাদের নির্দেশনাতেই আমরা সামনে এগোব। কিন্তু মূলনীতিগুলো আর আগের মতো নেই, বদলে গেছে। আর বদলে যে গেছে সেটা বোঝার জন্য সংবিধানের সংশোধনীগুলোর অবস্থার খোঁজ করার দরকার হয় না, সর্বত্রই তাদের মলিনতা টের পাওয়া যায়। পরিবর্তন গোটা আর্থ-সামাজিক আবহাওয়াজুড়েই ঘটেছে। আবহাওয়াটা ভালো নয়। 

মূলনীতি চারটি কেন এসেছিল? এসেছিল আমাদের সমষ্টিগত সংগ্রামের ফলে এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার হিসেবে। না-এসে উপায় ছিল না। শুরুতে, যুদ্ধকালে, মূলনীতি ছিল তিনটি: ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। এদের কেউই ভুঁইফোঁড় নয়। আকাশ থেকেও পড়েনি। কোনো ষড়যন্ত্রের কারণে কিংবা করুণার পথ ধরে আবির্ভূত হয়নি। তাদের আসাটা ছিল যেমন অনিবার্য তেমনি স্বাভাবিক। 

একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরুই হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। দ্বিজাতিতত্ত্বটা ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভরশীল। বাঙালিরা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে দেখে পাকিস্তানি হানাদাররা ক্ষিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে গণহত্যায়। ঘা লেগেছিল তাদের স্বার্থে। তারস্বরে তারা ঘোষণা করেছিল ইসলামকে রক্ষা করবে; ইসলাম রক্ষা আর পাকিস্তান রক্ষা তাদের কাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল। হানাদারদের যারা পালের গোদা, সামরিক বাহিনীর মস্ত মস্ত বীরপুরুষ, তারা ধর্মকর্মের জন্য বিখ্যাত ছিল না। নিজেদের শৌর্যবীর্য তারা ধর্মাচরণের ভেতর দিয়ে প্রদর্শিত করেনি। পাকিস্তানি জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামাজ পড়তেন বলে জানা যায় না; রোজার মাস কখন আসে কখনই বা বিদায় নেয় তার খবর যে রাখতেন না এমন প্রমাণ আছে। অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রের শেষ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ খ্যাতি জঙ্গের ময়দানে যতটা না প্রকাশ পেয়েছে ততধিক ধরা পড়েছে মদ্যপানের আসরে। কিন্তু ওই রাষ্ট্রনায়করা কেউই রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করতে কার্পণ্য করেননি। ধর্মকে তারা ব্যবহার করেছেন ধর্মের স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থেই। অপরদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূত্রপাতই হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে নাকচ করে দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের চেয়ে অবশ্যই বেশি ধার্মিক; কিন্তু ধর্ম ও রাষ্ট্রকে তারা কখনোই একাকার করে ফেলতে চায়নি। আলাদা করে রাখতে চেয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে উৎসাহী হয়েছিল সেটাও ধর্মের প্রয়োজনে নয়, ইহজাগতিক প্রয়োজনেই। তারা আশা করেছিল পাকিস্তান তাদের শোষণ থেকে মুক্ত করবে। হুজুরদের স্ফীতি দেখলে এখনো তারা অস্বস্তিই বোধ করে, ভরসা পাওয়া দূরের কথা। 

মূলনীতির আরেকটি ছিল গণতন্ত্র। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের নামনিশানা ছিল না। সেখানে শাসন ছিল পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক; অসামরিক কখনো কখনো, সরাসরি সামরিকই ছিল বড় একটা সময়জুড়ে। এটা তো জানা সত্য যে, প্রকৃত গণতন্ত্র ভোটের চেয়ে বেশি কিছু; সে গণতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে নাগরিকদের অধিকার ও সুযোগের সাম্য, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব। যথার্থ গণতন্ত্র তো ছিলই না, ভোটের গণতন্ত্রও দেখা যায়নি। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে কোনো সাধারণ নির্বাচন হয়নি, শেষমেশ যখন হলো তখন রাষ্ট্র নিজেই গেল দু-টুকরো হয়ে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তও কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাই। ইহাজগতিকতার প্রতিষ্ঠার জন্য তো অবশ্যই, নাগরিকদের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যও ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন দূর করাটা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। 

যাকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলছি সেটার অর্জন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব নয়। তার কারণ সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা না করলে অধিকার ও সুযোগের সাম্য আসে না; ধনবৈষম্য বহুবিধ বৈষম্যের আকর হয়ে দেখা দেয়। পাকিস্তান আমলে সব ক্ষেত্রেই সেটা ঘটেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম হয়েছে তাতে জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন, সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। বড় দুটি ঘটনায়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এবং উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে, সমাজতন্ত্রীরাই ছিলেন সম্মুখবর্তী শক্তি। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লড়াইটাতে তারা নেতৃত্ব দিতে পারেননি। সেটা দিতে পারলে লড়াইয়ের মীমাংসাটা হয়তো অন্যরকমের হতো, এবং রাষ্ট্রীয় চার নীতির মধ্যে সর্বশেষ যেটি, অর্থাৎ সমাজতন্ত্র, সেটিই এককভাবে প্রতিষ্ঠা পেত; অন্য তিনটির আবশ্যকতা থাকত না। 

মনে আছে যে, একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে তিনটি নীতির কথাই শোনা গেছে; জাতীয়তাবাদ যুক্ত হয়েছে যুদ্ধজয়ের পরে। সংযোজনটা জাতীয়তাবাদীরাই করেছেন। আগে যে করেননি সেটা হয়তো প্রয়োজন মনে করেননি বলেই। কেননা যুদ্ধটা তো আত্মস্বীকৃত ও ঘোষিত রূপেই ছিল জাতীয়তাবাদী। কিন্তু মূলনীতির তালিকায় পরে যে জাতীয়তাবাদকে যুক্ত করলেন তার পেছনে তাড়নাটি কী ছিল? সেটা কি এই যে, নিজেদের এই মর্মে আশ্বস্ত করাটা দরকার পড়েছিল যে তারা জাতীয়তাবাদ থেকে বিচ্যুত হবেন না? নাকি অন্য তিনটি মূলনীতিকে নিয়ে তাদের অস্বস্তি ছিল, সেগুলো যাতে জাতীয়তাবাদকে অভিভূত করে না ফেলে, তার জন্যই জোরেশোরে জানিয়ে দেওয়া যে, জাতীয়তাবাদ আছে এবং থাকবে? এই জিজ্ঞাসাটা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে। তাত্ত্বিকভাবেও জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দূরত্বটা কোথায় ও কতটা তা নিয়েও তদন্ত চলতে পারে, বিশেষ করে এই জন্য যে, হানাদার পাকিস্তানিরাও জাতীয়তাবাদীই ছিল এবং তারা খুবই দূরে ছিল অন্য তিনটি মূলনীতি থেকে। আর এটাও তো জানা আছে আমাদের যে, জাতীয়তাবাদীরা যদি সমাজতন্ত্রের আওয়াজ তোলে তাহলে সেটা হয়ে দাঁড়ায় অশনিসংকেত। হিটলার তো জাতীয় সমাজতন্ত্রের আওয়াজ তুলেই তার দেশের লোককে ক্ষেপিয়েছিলেন; নিজের দলের নামও রেখেছিলেন জাতীয় সমাজতন্ত্রী জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি। আর গণতন্ত্র অর্থ যদি কেবলি ভোট হয় তবে তো ডিক্টেটর হিসেবে আবির্ভাবের সময় তার পক্ষে ভোট পড়েছিল শতকরা ৮৮টিই। তাহলে? মুসোলিনিও যাত্রা শুরু করেছিলেন সমাজতন্ত্রের পতাকা হাতেই, পরে সুযোগ বুঝে তুলেছেন জাতীয়তাবাদের পতাকা। সমাজতন্ত্রীদের সমাজতন্ত্র আর জাতীয়তাবাদীদের সমাজতন্ত্র এক বস্তু নয়, একেবারেই আলাদা। 

মোটাদাগে সত্যটা এই রকমের যে, জাতীয়তাবাদ যখন আত্মরক্ষামূলক না হয়ে ক্ষমতালিপ্সু হয় তখন তার হাতে কোনো নীতিই নিরাপদ থাকে না। একাত্তরে প্রকাশ্যে যুদ্ধটা চলছিল পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের; এতে পাকিস্তানিরা ছিল ক্ষমতালিপ্সু, বাঙালিরা আত্মরক্ষাকারী। ক্ষমতালিপ্সু হিটলারের, মুসোলিনির ও ইয়াহিয়া খানের জাতীয়তাবাদ আবার পুঁজিবাদীও বটে। পুঁজিবাদের প্রথম কাজ বৈষম্য সৃষ্টি করা; যে জন্য চরিত্রগতভাবেই সে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের বিরোধী। ওই তিনটি নীতি বৈষম্য মানে না, উল্টো তার অবসান চায়।

বাংলাদেশের আদি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর বর্তমানে যে দুর্দশা এর ভেতরে আমাদের গত ৫৩ বছরের আর্থ-সামাজিক ইতিহাসটা লুকিয়ে রয়েছে। এটি পুঁজিবাদী উন্নতির ইতিহাস। একদিকে ঘটেছে উন্নতি অপরদিকে অবনতি। যেমন- ঢাকা শহরে প্রচুর মোটরগাড়ি এসেছে, কিন্তু তাতে শহরের বাসিন্দাদের চলমানতা বাড়েনি, উল্টো কমেছে। দেশে অনেকে ধনী হয়েছে, ইতোমধ্যে বিশ্বমানের একজন ধনীর সন্ধান পাওয়া গেছে, অচিরেই তাদের সংখ্যা বাড়বে। এর বিপরীতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। দুর্নীতিতে আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হতে পেরেছি, বায়ুদূষণে ঢাকা সারা পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল, কিন্তু নারী-নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত নিষ্ঠুরতর হচ্ছে। শিক্ষিতের হার বাড়ছে; কিন্তু তিন ধারার শিক্ষা তিন দিকে ছুটছে। আধুনিকতা বেপরোয়া হতে চাইছে, আবার ধর্মের হেফাজতিরাও বেগে ধেয়ে আসছে। পুঁজিবাদী এই উন্নতির পক্ষে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর সঙ্গে শত্রুতা না-করে উপায় নেই; এবং সেটাই সে নিয়মমাফিকই করে চলেছে। মূলনীতিগুলোর দুর্দশা সামাজিক দুর্দশারই প্রতিচ্ছবি। অতিশয় বিশ্বস্ত। উন্নতির নিচে চাপা পড়ে নিঃশব্দে ক্রন্দন করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর দুর্দশাও সে-খবরটাই দিচ্ছে। একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, কয়েক লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো ওই সংগ্রামেরই অর্জন। পাশাপাশি অর্জন আমাদের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতও। তাদের রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আজ দেশবাসীর; নীতিগুলোর স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থে; বাঁচার প্রয়োজনে। এবং ভুলবার কোনো উপায়ই নেই যে লড়াইটা হবে পুঁজিবাদবিরোধী। রাষ্ট্রীয় চার নীতির দুর্দশা পুঁজিবাদই ঘটিয়েছে, তাকে না তাড়ালে আমাদের মুক্তি নেই। এটা একাত্তরে সত্য ছিল, আজ সেটা সত্য আরও স্পষ্টরূপে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মার্কিন নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে  বৈশ্বিক সংকটের পরিধি

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
মার্কিন নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে 
বৈশ্বিক সংকটের পরিধি
ডালিয়া আল-আকিদি

আমেরিকার বেশির ভাগই ভোটারদের মধ্যে দেশের অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমেরিকানদের রুটি-রুজির বিষয়গুলো যেমন- চাকরি, মুদ্রাস্ফীতি, স্বাস্থ্যসেবা খরচ এমন উদ্বেগ যা দৈনন্দিন মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি 
অনুরণিত হয়, তারা সেই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বেশি চিন্তিত।...

চলমান মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, বিশেষ করে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা দিগন্তে বড় আকার ধারণ করছে, তা হলো আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। 
৫ নভেম্বরের নির্বাচন শুধু মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যতই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা গঠনে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবারের মার্কিন নির্বাচনে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। কারণ এবারের নির্বাচনের ফল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান অংশগ্রহণ এবং প্রভাবের কারণে অনেক কিছুরই গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। 

জোট এবং ক্ষমতার ভারসাম্যকে নতুন আকার দিতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ভোটারের চোখে পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। আগের যুদ্ধগুলোতে দেখা যায় যে, আফগানিস্তান এবং ইরাকের মতো বড় আকারের যুদ্ধে সরাসরি সামরিক বাহিনী জড়িত ছিল। বর্তমানে বিশ্বে চলমান যে যুদ্ধ চলছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সশস্ত্র সংঘাতে সরাসরি জড়িত নয়।
ফলে ভোটারদের অগ্রাধিকারগুলো অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিদেশের মাটিতে আমেরিকান বুটের অনুপস্থিতির অর্থ হলো বৈদেশিক নীতি ভোটারদের মনে ততটা ভারী নয়। বিশেষ করে সামরিক বাহিনী নিযুক্ত করা বা জাতীয় হুমকির মতো তেমন তাৎক্ষণিক অনুভূতি নেই।

ভোটারদের এমন অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার মধ্যে বড় একটি প্যারাডক্স রয়েছে: যদিও ব্যালট বাক্সে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিণতি হতে পারে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মতো অস্থির অঞ্চলে যেখানে অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশি মাথা ঘামায়। তাদের নিজেদের অনেক জটিলতা এবং গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়গুলো তাদের কাছে দ্বিতীয় মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তারা নিজেদের ঘরে বসে প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে এবং উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। এবারের নির্বাচনে ভোটারদের ভোটের ওপর নির্ভর করছে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রভাব কেমন হতে পারে। 

বিশ্বব্যাপী যত যুদ্ধ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাগুলো কেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর সীমিত প্রভাব বিস্তার করে। কারণ এসব ঘটনার পেছনে মূল অনুঘটক থাকে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম এবং সর্বাগ্রে আমেরিকান ভোটারদের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে কারণ তারাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো পররাষ্ট্রনীতির অন্তর্নিহিত জটিলতা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে কূটনীতি, সামরিক কৌশল, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং সাংস্কৃতিক বিবেচনার বিষয়গুলো জড়িত। ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সব সময় এক ধরনের ছায়ার মতো বিষয় হয়ে থাকে, যা সারা বিশ্বে উদ্বিগ্ন প্রভাব পড়ে। 

রাজনীতিবিদরা প্রায়শই এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো পরিচালনা করা কঠিন বলে মনে করেন, যা ভোটারদের সঙ্গে অনুরণিত হয়। ভোটাররা আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলোর সূক্ষ্মতা বা বিস্তৃত প্রভাব সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে না। ফলে প্রার্থীরা প্রায়শই পররাষ্ট্রনীতির গভীর আলোচনাকে এড়িয়ে চলেন। তারা সবসময় দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন যাতে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এবং বিতর্ক করা সহজ হয়। 

ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘস্থায়ী দ্বিদলীয় সমর্থনের বিষয় রয়েছে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনাগুলো ভোটারদের মতামতকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করার সম্ভাবনাকে আরও হ্রাস করেছে। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয়ই তাদের মতের অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলের পক্ষে শক্তিশালী সমর্থন বজায় রাখে। আমেরিকার রাজনীতিতে বিভেদমূলক সমস্যা কম। যদিও ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক উন্নয়নগুলো বিশ্ব মঞ্চে গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। 
তবে এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সামনে একটি সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা অপ্রত্যাশিতভাবে তার ভোটারদের ভিত্তিতে নাড়া দিতে পারে।

 আরব আমেরিকান ভোটাররা ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য দলের সমর্থক। তবে তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে মোহভঙ্গের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এমন একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক সমর্থনকে পঙ্গু করতে পারে। ইহুদি সম্প্রদায়ের দীর্ঘকাল ধরেই ডেমোক্র্যাটদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত। পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ করে ইসরায়েলকে নিয়ে ডেমোক্র্যাট পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। যদিও তাদের অগ্রাধিকারে স্বতন্ত্রতা থাকে। তবে উভয় গ্রুপই ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের অনুভূতি ভাগ করে নেয় যা ডেমোক্র্যাটদের জন্য আগামী নির্বাচনে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। 

আরব আমেরিকানদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে জো বাইডেন প্রশাসনের নীতি বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে তাদের প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। যদিও এই জনসংখ্যা জাতীয় নির্বাচনের ফলকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করার ভূমিকা যথেষ্ট নাও হতে পারে। তবে মূল যুদ্ধক্ষেত্রের রাজ্যগুলোতে এর ঘনীভূত উপস্থিতি আরব আমেরিকানদের অসন্তোষকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। তাদের অনেকেই মনে করেন যে, বর্তমান প্রশাসনের প্রচেষ্টা অপর্যাপ্ত এবং নির্বাচনে ভোটের মাঠে এর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। 

একই সময়ে, ইহুদি ভোটাররা তাদের নিজেদের হতাশা প্রকাশ করছে বিশেষ করে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান সংঘর্ষে ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া দেখে। ইহুদি সম্প্রদায়ের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনের আরও কঠোর অবস্থান নেওয়া উচিত। ইসরায়েলের পক্ষে সংঘাতের অবসান ঘটাতে আরও সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করা উচিত বলে তারা মনে করে। এই অসন্তোষের অনুভূতি ইহুদি ভোটারদের মধ্যে পার্টির দীর্ঘদিন ধরে থাকা সমর্থনকে ক্ষুণ্ন করার হুমকি দেয়।

সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা যায়, কমলা হ্যারিস সেই সমর্থন বজায় রাখতে সংগ্রাম করছেন। যেমনভাবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ২০২০ সালে মিশিগানকে সুরক্ষিত করতে তারা সাহায্য করেছিল। এমন একটা মূল রাজ্যের অপূরণীয় ক্ষতি সামগ্রিক নির্বাচনের মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে। 

সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো একটি বিষয় পরিষ্কার করে যে, আমেরিকার বেশির ভাগই ভোটারদের মধ্যে দেশের অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমেরিকান্দের রুটি-রুজির বিষয়গুলো যেমন- চাকরি, মুদ্রাস্ফীতি, স্বাস্থ্যসেবা খরচ এমন উদ্বেগ যা দৈনন্দিন মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি অনুরণিত হয়, তারা সেই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বেশি চিন্তিত। 

রান্নাঘরের টেবিলের কথাবার্তা কখনো বিশ্বব্যাপী সংঘাত বা কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে হতে পারে না। তবে মুদি জিনিসের দাম, গ্যাসের দাম কীভাবে কমানো যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। এই বাস্তবতার কারণে আমেরিকান ভোটারদের মানসিকতা সম্পর্কে জানা যায়। 

পররাষ্ট্রনীতি ধারাবাহিকভাবে ভোটারদের উদ্বেগের বাইরে থাকে। আন্তর্জাতিক ঘটনা যতই ফলপ্রসূ হোক না কেন, বেশির ভাগ আমেরিকান মনে করেন যে, তারা প্রতিদিন যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার বাস্তবায়ন চায়। 

রাজনীতিবিদরা যারা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সমর্থন পেতে আশা করেন তাদের অবশ্যই প্রতিদিনের উদ্বেগের সমাধান করতে হবে। এটাই বাস্তবতা। কারণ আমেরিকার জনগণের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকের মধ্যদিয়ে নির্বাচনে জয়ী বা হেরে যেতে হয়।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, আমেরিকান সেন্টার ফর কাউন্টার এক্সট্রিমিজম। 
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৩ এএম
দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে
এ টি এম মোস্তফা কামাল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর চাঁদাবাজির সব ক্ষেত্র থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়ার প্রেক্ষিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল সে স্থান তো শূন্য থাকার কথা, কারণ চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট, হোর্ডিং অবৈধ কাজ। আওয়ামী লীগের এই জাতীয় অবৈধ কাজের বিরুদ্ধেই তো ছাত্র-জনতার আন্দোলন। সেই শূন্য স্থান কি ইতোমধ্যে পূরণ হয়ে গেছে? কারা সেটা পূরণ করল?...

দ্রব্যমূল্য অসহনীয় পর্যায়ে লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা চরম বিপাকে পড়েছে। একটা মাঝারি সাইজের ফুলকফির দাম ১২০ টাকা, এক কেজি গাজরের দাম ১৬০-১৮০ টাকা, এক কেজি টম্যাটোর দাম ২৬০-২৮০ টাকা, কাঁচা মরিচের কেজি ৪০০ টাকা, ধনিয়া পাতার কেজি ৪০০ টাকা, খোলা বাজারে ডজনপ্রতি ডিমের মূল্য ১৭০-৮০ টাকা, ব্রয়লার মুরগির কেজি ২২০ টাকা, গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ টাকা, একটু বড় সাইজের ইলিশের দাম কেজিপ্রতি ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা- এমন কেন হবে? এরূপ দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করা বাংলাদেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। যাদের মাসিক আয় ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা, তারা ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ, গ্যাস খরচ বহন করে বস্তির টিনশেড ঘরে বসবাস করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করে খেয়েপরে ন্যূনতম উপায়ে বেঁচে থাকবে কী করে? ডিম, মাংস, ইলিশ মাছ খাওয়ার কথা চিন্তা করা তাদের পক্ষে আর শোভনীয় হচ্ছে না।

 এ দেশের ৭১ শতাংশ লোক অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। এমনিভাবে কি এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করবে? সরকার যদি এরূপ অবস্থায় চুপ করে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে আমাদের জাতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে অপুষ্টির শিকার একটা বিকলাঙ্গ জাতি।  

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে (Atlas of Sustainable Development Goals 2023) উল্লেখ করা হয়েছে- বাংলাদেশের ১৭ কোটি লোকের মধ্যে ১২ কোটি ১০ লাখ (৭১ শতাংশ) লোক স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারে না। কারণ তাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই (সূত্র: প্রথম আলো ৭ জুলাই ২০২৩)। যে দেশের ৭১ শতাংশ লোকের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ক্রয় করে খাওয়ার সামর্থ্য নেই, সে দেশে মাঝারি মাত্রার দুর্ভিক্ষাবস্থা বিদ্যমান বলে মনে করার যুক্তিসংগত কারণ আছে। উন্নত দেশ হলে এই ৭১ শতাংশ লোকের সবাইকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দেওয়া হতো স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ক্রয় করে খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য। আমাদের দেশে সাধারণ জনগণকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই। 

আমাদের দেশে ওপরের দিকের ৫ শতাংশ আর নিচের দিকের ৫ শতাংশের মাথাপিছু আয়ের ব্যবধান ৮০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। অথচ উন্নত দেশে এই ব্যবধান অত্যন্ত কম। উন্নত দেশে নিম্ন শ্রেণির কর্মজীবীদের আয় আর উঁচু শ্রেণির কর্মজীবীদের আয়ের খুব বেশি ব্যবধান নেই। এর কারণ হচ্ছে, উঁচু শ্রেণির কর্মজীবী আর নিম্ন শ্রেণির কর্মজীবীকে একই ধরনের বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে হয়, একই দাম দিয়ে কাঁচাবাজারের সদাই কিনতে হয়। তাই তো উন্নত দেশে দেখা যায়, যারা গৃহকর্মে সহায়তার পার্টটাইম কাজ করে তারাও ভালো মডেলের গাড়ি চালিয়ে কর্মস্থলে যাতায়াত করে। আমাদের দেশে কেউ সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশটাকে তো একটা মডেল সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে। সেই মডেলটা অবশ্যই হবে ইউরোপিয়ান মডেল। আমরা কি এখনো কোনো মডেল নির্ধারণ করে আমাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে পেরেছি?   

সব কৃষিজাত পণ্য কৃষকদের কাছ থেকে অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে থাকে। ইলিশ মাছও জেলেদের কাছ থেকে কম মূল্যে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে থাকে। তার পর ঢাকার পাইকারি মার্কেট কারওয়ান বাজারে ওই সব কাঁচামাল/ ইলিশ মাছ পৌঁছানোর সময় এসব পণ্য পরিবহনকারী ট্রাক থেকে বিভিন্ন নেতার নামে/ সংস্থার নামে ঘাটে ঘাটে চাঁদা আদায় করা হয়। এই চাঁদাবাজির কারণেই দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গঠন করে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। যেমন- ব্রয়লার মুরগি, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ইত্যাদি। ব্রয়লার মুরগির ব্যবসায়ী তো সীমিত।

 কোনো প্রভাবশালী নেতা ব্রয়লার মুরগির ব্যবসায়ীদের ডেকে সিন্ডিকেট গঠন করে ব্রয়লার মুরগির দাম নির্ধারণ করে সবাই একই দামে সেটা বিক্রি করছে, সিন্ডিকেট গঠন করে প্রতিযোগিতাকে স্তব্দ করে দিল। তাই তো দেখা যাচ্ছে, এক সপ্তাহ আগে যে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছিল ১৭০ টাকা কেজি দামে, এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ২১০-২২০ টাকায়। একইভাবে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডিমের দামও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব জিনিসের দাম কমাতে গেলে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে, প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।  

পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যবসায়ীরা হোর্ডিং করে থাকে। ডিমের মতো পণ্যকেও আমাদের দেশে হোর্ডিং করার খবর জানা যায়। ধরুন, কয়েক লাখ ডিমকে গুদামজাত করে রেখে আস্তে আস্তে অধিক মূল্যে বাজারে ছাড়া হলো। চাঁদাবাজ, সিন্ডিকেট-হোর্ডিং যারা করে থাকে তারা নিজেদের রক্ষা করার প্রয়োজনে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলার চেষ্টা করে থাকে। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথমে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় নিয়ে আসার আবশ্যকতাও রয়েছে। 
  
৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর সমগ্র দেশে পুলিশ অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে যায়। প্রায় তিন-চার সপ্তাহ কাঁচাবাজারে শাকসবজির দাম অনেক কম ছিল। এই তিন-চার সপ্তাহ রাস্তাঘাটে খুব একটা চাঁদাবাজি ছিল বলে মনে হয় না। চাঁদাবাজি না থাকার সুবাদে কাঁচাবাজারে শাকসবজি, ডিম বেশ কম মূল্যেই বিক্রি হয়েছিল। এর পর থেকে আবার চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট, হোর্ডিং পদ্ধতির প্রয়োগ, আওয়ামী এবং ভারতীয় কারসাজির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশচুম্বী।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজির সব ক্ষেত্র থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়ার প্রেক্ষিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল সে স্থান তো শূন্য থাকার কথা, কারণ চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট, হোর্ডিং অবৈধ কাজ। আওয়ামী লীগের এই জাতীয় অবৈধ কাজের বিরুদ্ধেই তো ছাত্র-জনতার আন্দোলন। সেই শূন্য স্থান কি ইতোমধ্যে পূরণ হয়ে গেছে? কারা সেটা পূরণ করল? সেই পূরণ করাটা কি জাস্টিফাইড? অন্তর্বর্তী সরকারের এই ক্ষেত্রে ভূমিকা কী? ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সহায়তাকারী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও সুস্পষ্ট হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হবে সব ক্ষেত্রে ন্যায়ানুগ কার্যক্রম করা। ন্যায়ানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কারও মুখের দিকে তাকানোর কোনো অবকাশ নেই। এ ক্ষেত্রে ন্যায়ানুগ কার্যক্রম মানে হচ্ছে চাঁদাবাজি নির্মূল করা, সিন্ডিকেট ও হোর্ডিংয়ের মূলোৎপাটন করা। সমগ্র দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জেল জরিমানার দণ্ডারোপ করা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সমর্থনদানকারী দলগুলোর উচিত সরকারকে এ কাজে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতীয় আধিপত্য কমানোর লক্ষ্যে মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং অন্যান্য বিকল্প উৎসের সন্ধানের আবশ্যকতা রয়েছে।  

অন্তর্বর্তী সরকারের এই বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকার কিংবা ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ করে দিতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থ হওয়ার মানে হবে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার গণধিকৃত শেখ হাসিনার সরকারের পুনর্বাসনে সহযোগিতা করা। সুতরাং, চাঁদাবাজি উৎখাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব

দশভুজা মা দুর্গা ও অসুরবধ

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩০ এএম
দশভুজা মা দুর্গা ও অসুরবধ
কাজল দেবনাথ

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বারো মাসে তেরো পার্বণের প্রধান পার্বণ শারদীয় দুর্গোৎসব। দেবীপক্ষের শুরু মহালয়ায়। এদিন ভোরবেলা দেবীপক্ষকে আবাহন করে ভক্তরা গেয়ে ওঠে- ‘জাগো তুমি জাগো’। ভক্তের প্রার্থনা- মাতৃরূপে, শক্তিরূপে, জ্ঞানরূপে আমাদের আশীর্বাদ করো। আসুরিক প্রবৃত্তিকে বিনাশ করে আমাদের কলুষমুক্ত করো। পিত্রালয়ে তোমার আগমনে ধরিত্রী হোক ধন্য।
পুরাণ মতে, রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজন-প্রতারিত সমাধিবৈশ্য, মেধষমুণির পরামর্শে বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। আমাদের দেশে এটি বাসন্তী পূজা নামে প্রচলিত। চৈত্রের শুক্লপক্ষে পূজিত হন মা দুর্গা। 

তবে বাংলাদেশে এখন এই পূজা পালিত হয় কম। শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন শরৎকালে। দেবতাদের দিন ছয় মাস, রাত ছয় মাস। মাঘ থেকে আষাঢ়- এই ছয় মাস দেবতাদের দিন অর্থাৎ উত্তরায়ণ। শ্রাবণ থেকে পৌষ- এই ছয় মাস রাত অর্থাৎ দক্ষিণায়ন। উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্রত, দক্ষিণায়নে নিদ্রিত। শরৎকাল দক্ষিণায়ন বিধায় দেবীকে জাগরণের জন্য ‘বোধন’ করতে হয়। এটিই অকালবোধন। বসন্তকাল উত্তরায়ণের মধ্যে পরে, দেবী থাকেন জাগ্রত। তাই বাসন্তী পূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না।

শরতের শুক্লপক্ষে ভক্তের অকালবোধনে মা দুর্গা লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, কলাবউ মং মাথার ওপর শিবকে নিয়ে কৈলাস থেকে সপরিবারে এসেছেন পিত্রালয়ে, বাঙালির পূজামণ্ডপে। বাংলাদেশে এবার ৩১৪৬১ পূজামণ্ডপে পূজিত হচ্ছেন মা দুর্গা। দুর্গার কাঠামোয় আরও আছেন অসুর। সঙ্গে আছে দুর্গার বাহন সিংহ, কার্তিকের বাহন ময়ূর, গণেশের বাহন ইঁদুর, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা ও সরস্বতীর বাহন শ্বেতহংস। মন্ত্র পাঠে প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে শুরু হয় পূজা। ষষ্ঠী, সপ্তমী, মহাষ্টমী ও নবমী পূজা শেষে বিজয়া দশমী। মাকে বিদায় দেওয়ার ক্ষণ। পাঁচ দিনের পূজা শেষে দশমীতে আবারও মন্ত্র পাঠে মাকে পূজামণ্ডপেই দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় দেয় ভক্তকুল। এরপর নদী-পুকুর-জলাশয়-সাগরে প্রতিমা নিরঞ্জন এবং প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দুর্গাপূজার সব আনুষ্ঠানিকতা। 

মা দুর্গা অশুভ শক্তি বিনাশ করে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার মূর্ত প্রতীক। অসুরের কঠোর তপস্যা ও ধ্যানে তুষ্ট ব্রহ্মা। এর পুরস্কারস্বরূপ ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের প্রার্থনা জানায় অসুর। অন্যথায় প্রত্যাখ্যান করবে বর। নিরুপায় ব্রহ্মা বর দিলেন, ‘কোনো পুরুষের হাতে বধ হবে না অসুর’। এই বর পেয়েই স্বমূর্তি ধারণ করে দেবকুলকে প্রকম্পিত করে তোলে অসুর। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মির আলোকপুঞ্জ হতে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। দেবতারা একত্রিত হয়ে যার যার অস্ত্র তুলে দিলেন দেবী দুর্গার হাতে। দুর্গা হলেন দশভুজা। এই দশভুজা মা দুর্গার হাতেই বধ হলো অসুর। মৃত্যুকালে অনুতপ্ত মহিষাসুরের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করলেন দশভুজা মা দুর্গা। মর্তলোকে দুর্গাপূজায় শুভশক্তি দেবী দুর্গার পদতলে থেকে অশুভ শক্তি অসুরও পূজিত হবে। জয় হলো দেবকুলের। জয় হলো শুভ শক্তির।

ঐতিহাসিকদের মতে, এ বাংলায় জাঁকজমকের সঙ্গে মহাধুমধামে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৬) রাজত্বকালে বর্তমান রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ। কথিত আছে, ওই সময় তিনি প্রায় ৮ লাখ টাকা খরচ করেছিলেন এই দুর্গাপূজায়। দুর্গাপূজা মূলত রাজসিক পূজা। রাজা, জমিদার এবং সচ্ছল পরিবারেই কেবল দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। আয়োজকও ছিলেন তারাই। তবে দশ গ্রামের ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই মেতে উঠত এই পূজাকে কেন্দ্র করে। মায়ের সন্ধ্যা আরতির পর শুরু হতো যাত্রাপালা, কবিগান ও নর্তক বাঈজির জলসা। 

সংগীতানুষ্ঠান ও উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরও মাতিয়ে রাখত রাজা-জমিদারদের পূজামণ্ডপ। এর সঙ্গে বসত মেলা। পাঁচ দিনের দুর্গাপূজা উৎসব চলত মাসব্যাপী। রাজা-জমিদার প্রথার বিলোপ হলে আর্থিক কারণেই পরবর্তীতে বারোয়ারি পূজা এবং সর্বশেষ আজকের সর্বজনীন পূজা কমিটি। অর্থাৎ সবাই মিলে চাঁদা তুলে দুর্গাপূজার আয়োজন। বাংলাদেশে এই আয়োজনে অর্থ সংগ্রহ আজ আর কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সংখ্যাগুরুসহ অন্য সম্প্রদায় মণ্ডপে কেবল পূজা দেখতে আসেন। অনেকেই চাঁদাও দেন সাগ্রহে। পূজা উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা বা সংকলনে লেখা দেন, বিজ্ঞাপন দেন। 

বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে পূজাঙ্গন সজ্জা আজ একটি নতুন সংযোজন। সেই সঙ্গে ঈদ, পয়লা বৈশাখের মতো দোকানে দোকানে কেনাবেচার প্রচারেও এসেছে নতুন মাত্রা। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পূজার দিনগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ শারদীয় দুর্গোৎসবকে করেছে সর্বজনীন। এর প্রতিফলন শুধু ঢাকা শহরেই নয়, সারা দেশের পূজামণ্ডপেও দর্শনার্থীর একটি বড় অংশ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং আয়োজকদের সর্বজনীনতার কারণেই দুর্গাপূজা আজ দুর্গোৎসব। দুর্গাপূজার মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠান হিন্দু সম্প্রদায়ের, উৎসব সবার। এক কথায় দুর্গাপূজা হিন্দুর, দুর্গোৎসব বাঙালির এবং এরই নির্যাস হলো আজকের বাংলাদেশে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। কিন্তু রাষ্ট্রকেও তো সবার করতে হবে। উন্নীত করতে হবে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ পর্যায়ে।

দশভুজা মা দুর্গার হাতে বধ হলো অসুর। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এই ষড়রিপুর আসুরিক মূর্তিই হলো অসুর, এই রিপুকে সংযত রাখা বা নিধন করাই অসুরবধ। রিপুর অসংযম যেমন একটি ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, তেমনই এই ষড়রিপুর দ্বারা আক্রান্ত রাজনীতি ও সমাজনীতি প্রায়শই দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করায়।

অশুভ শক্তি যেমন অতীতেও ছিল, আজও বিরাজমান এবং আগামীতেও থাকবে। কালের বিবর্তনে কেবল এর রূপ হবে ভিন্ন থেকে ভিন্নতর। এই অসুরশক্তি বিনাশে দেবকুলের মতো আমাদেরও একত্রিত হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সংঘ এবং এই সংঘশক্তিই পরাজিত বা দমনে রাখবে আজকের ও আগামী দিনের অসুরকে। এ বিশ্বাসেই অকালবোধনে প্রতিবছর বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় দশভুজা মা দুর্গার আরাধনা করে।

লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ
[email protected]

পেট আর পকেটের সমন্বয় কি হবে না?

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৫৯ এএম
পেট আর পকেটের সমন্বয় কি হবে না?
রাজেকুজ্জামান রতন

নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি সব স্তরের মানুষের ভোগান্তি বাড়ায় কিন্তু সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কারণ তাদের আয় তো বাড়ে না। শেষ পর্যন্ত একটাই পদক্ষেপ তারা নিতে পারে, তা হলো সংসারের খরচ কমাও, খাওয়া কমাও। 

সংসারের প্রথম প্রয়োজন খাবারের কথা ভাবলে, নিম্ন আয় ও স্বল্প আয়ের পরিবারে প্রাণিজ আমিষের বড় উৎস ডিম ও ফার্মের মুরগি। সরকারের পক্ষ থেকে মুরগির ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, দিনে কমপক্ষে সাড়ে ৪ কোটি ডিমের চাহিদা আছে দেশে। তাহলে শুধু ডিমের জন্য প্রতিদিন বাড়তি টাকা লাগে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। জনগণের পকেট থেকে বের করে নেওয়া এই টাকা কে পায়, কোথায় যায়? 
শ্রমজীবী, মেসে বাস করে যারা, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের আমিষ ও পুষ্টির সবচেয়ে সহজ এই জোগানদাতা ডিমের দামও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। 

প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৮০ টাকা। কোনো কোনো খুচরা বিক্রেতা চাইছেন ১৮৫ টাকাও। সকালের নাশতায় ডিম খেতে চাইলে একটা ছোট পরিবারেও শুধু ডিমের পেছনেই মাসের বাজেট ধরতে হচ্ছে ১৫০০-১৭০০ টাকা। 

ডিমের দামের এমন উল্লম্ফনে হতভম্ব ক্রেতারা। ভারত থেকে সাত টাকার ডিম আসছে। তাহলে ডিমের দাম ১৫ টাকা কেন? বাজার নিয়ন্ত্রণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দ্বিধা করছেন না ক্রেতারা। 

এক মাসে তিন দফায় বেড়ে ডাবল সেঞ্চুরি পার করে ফেলেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। এক দিন আগেও যে ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, বিভিন্ন বাজারে ওই মুরগি এখন ২১০-২৩০ টাকা। দেশি মুরগির দাম ৬৫০-৬৮০ টাকা 
প্রতি কেজি। অন্যদিকে সোনালি কক বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৫০ টাকায়।
চালের দামও বেড়েছে, সব থেকে বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম। প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৭১-৭২ টাকা, আটাশ ৫৭-৫৮ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকা, পাইজাম ৫৬-৬০ টাকা, সুগন্ধী চিনিগুঁড়া পোলাও চাল ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

নিয়ন্ত্রণহীন আগুন সবজির বাজারেও। সবশেষ মুলার কেজিও ছুঁয়েছে ১০০ টাকা। গাজরের কেজি ১২০ টাকা। শেষ ভরসা হিসেবে ব্যবহৃত হয় যে আলু, সেটাও এখন ৭০ টাকা কেজি। করলার কেজি ৮০-১০০ টাকা, বেগুনের কেজি ৭০-১০০ টাকা, চিচিঙ্গা-পটোল-ঝিঙার কেজি ৬০-৮০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০-৮০ টাকা, ঢেঁড়শ ৬০-৭০ টাকা। কোনো তাজা সবজি ৭০-৮০ টাকার নিচে নেই। সবচেয়ে সস্তায় মিলছে শুধু কাঁচা পেঁপে; কেজি ৩০-৪০ টাকা। 

বিক্রেতাদের অজুহাত, বন্যার কারণে সরবরাহে ঘাটতি, তাই দাম বেড়েছে সবজির। কিন্তু ক্রেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। আগে বলা হয়েছিল, উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ট্রাকে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে ঢাকায় সবজির দাম বেশি। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার খবরে অনেকে মনে করেছিলেন এসব বন্ধ হবে। পুরনো চাঁদাবাজরা তো পালিয়েছে, তাহলে এখন প্রশ্ন- চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি নাকি সরকার ব্যবস্থা নিতে পারছে না। 

মাছের বাজারে অবস্থা আরও কঠিন। পকেটে কম টাকা থাকলে ইলিশের দিকে তাকাতেও ভয় পান বেশির ভাগ ক্রেতা। এক কেজির উপরে ইলিশ ২৫০০ টাকার কম নয়। ৭৫০ গ্রামের ইলিশ কিনতেও ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা লাগতে পারে। চাষের রুই-কাতলার কেজিও ৪০০ টাকা। চাষের কই কেজিপ্রতি ২৮০-৩০০ টাকা, শিং-মাগুর কেজিপ্রতি ৪৫০-৬০০ টাকা, বোয়াল ৭০০-৯০০ টাকা, আইড় ৭০০-৮০০ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৫০০-৬০০ টাকা। ফলে পাঙাশ-তেলাপিয়া ছাড়া সাধারণ মানুষ অন্য মাছ কিনতে পারছেন না। সেই পাঙাশও প্রতি কেজি ২৮০-৩০০ আর তেলাপিয়া ২২০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ।

এত দাম কেন- জিজ্ঞেস করলে মাছ বিক্রেতারা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না। একটু সদাশয় মাছ বিক্রেতা হলে বলেন, সব জায়গায় দাম বেশি, আমরা কী করব? আড়ত থেকেই বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে তাদের। আর ইলিশের দাম এত বেশি কেন, তার কারণ জিজ্ঞেস করলে এক গাল হেসে উত্তর দেন, মাছ তো সব রপ্তানি করে ফেলছে সরকার। ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানি করা হলেও যে দেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়, সে কথা তাদের কে বোঝাবে? 

শুধু খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতা নয়, ওষুধের দামও বাড়ছে ক্রমাগত। সেটা দেখবে কে? তাহলে দেশের পটপরিবর্তন হলেও বাজার সিন্ডিকেট কি একই থেকে গেছে? এই প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্নোত্তরের খেলা বা দায় চাপানো বা দায় এড়ানো যতই চলুক বাস্তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের। 

অর্থনীতির ভাষায় যাকে ইনফ্লেশন বলা হয়, বাংলায় সেটাকে বলা হয় মুদ্রাস্ফীতি। এর কারণ হলো বাজারে পণ্য কম কিন্তু টাকার পরিমাণ অর্থাৎ চাহিদা বেশি। এই ধারণার কারণে ইনফ্লেশন কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভূমিকা পালন করতে বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ইনফ্লেশন কেবল মুদ্রাস্ফীতি নয়। তাই অর্থনীতিতে টাকার পরিমাণ কমিয়ে ইনফ্লেশন কমানো সম্ভবপর হচ্ছে না।

ইনফ্লেশনের মানে যাই হোক না কেন, মানুষ দেখছে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এটাকেই বলা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পণ্যের মূল্য কেবল মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বাড়ে না। দেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির অবস্থা ডবল ডিজিট অর্থাৎ ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ শতাংশে পৌঁছেছে? বছর বছর মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে, সেটা এক কথা আর স্ফীত মূল্য হ্রাস হচ্ছে না কেন, সেটা ভিন্ন কথা। সাধারণ মানুষ অর্থনীতির বিতর্কের চাইতে বেশি আশা করে স্ফীত মূল্য কমে যাক। এর জন্য যে যে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকার সেই সব ব্যবস্থা নিক। 

কেন সাধারণ মানুষ আশা করে স্ফীত মূল্য কমে যাক? কারণ মূল্যস্ফীতি তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়, যার প্রভাব পড়ে পেট থেকে মাথায়। পেটের খাবারে টান পড়ে আর জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ করতে মাথায় চিন্তা ও ঋণের বোঝা বাড়ে। ধরা যাক, ২০২০ সালে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা, গাড়িচালকের বেতন ১৯ হাজার টাকা ছিল। বেতন এখনো তেমনই আছে। অথচ চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, লবণ, চিনি সবকিছুর দাম বেড়েছে। তখন তারা কী করবে? বাজারে গিয়ে সরকারকে গালমন্দ করে আর বেতন বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করে। কাজ না হলে বিক্ষোভ, আন্দোলন করে। 

শ্রমিকরা সংগঠিত বলে রাস্তায় নেমে ক্ষোভ জানাতে পারে কিন্তু নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত কী করবে? চাকরিজীবী বা সীমিত আয়ের মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত মানুষ যারা ব্যাংকের জমানো টাকায় সংসার চালান তাদের বাজারের লিস্ট ছোট না করে উপায় নেই। 

মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা অনেকের কাছেই নির্ভরযোগ্য মনে হয় না। সাধারণ মানুষ প্রতি মাসে বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় যে ৬০টি পণ্য কিনে থাকে, গড়ে সেগুলোর দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। কিছু পণ্য আছে যেগুলোর দাম সামান্য বেড়েছে- ৫-১০ শতাংশ। আবার বাজারের তালিকায় এমন পণ্য আছে যেগুলোর দাম বেড়েছে অত্যধিক, অর্থাৎ ৩০-৪০ শতাংশ। যাদের আয় বেশি তাদের পণ্য ব্যবহারের তালিকা বড়। দাম বাড়লেও কিছু যায় আসে না। যাদের আয় যত কম তাদের তালিকা তত ছোট এবং প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তত বেশি হারে বাড়ে। 

ফলে সাধারণ জনগণের দিকে তাকিয়ে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে নতুন করে ভাবা এবং দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে। অধিক মুদ্রা সরবরাহ, সরকার কর্তৃক অধিক মাত্রায় ব্যয়, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি, আমদানি করা মূল্যস্ফীতি ছাড়া আরও কী গোপন কারণ রয়েছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। কাঁচামালের মূল্য ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কেন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তার কার্যকারণ খুঁজে বের করা দরকার। আবার কাঁচামালের মূল্য কিছুটা হ্রাস পেলেও পণ্যের মূল্য কেন কমে না। তার কারণ ও কারসাজি কী সেটাও উদ্ঘাটিত হওয়া দরকার। কারণ, সমস্যার সমাধান না হলে সান্ত্বনায় হয় না। পেট আর পকেটের সমন্বয়হীনতা দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে জনগণ। 

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]