ঢাকা ২৯ ভাদ্র ১৪৩১, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সহিংস পরিস্থিতি: বিশিষ্টজনের অভিমত

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৪, ১১:১৯ এএম
সহিংস পরিস্থিতি: বিশিষ্টজনের অভিমত
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, এম হুমায়ূন কবির ও নূর মোহাম্মদ

যে সমস্যা দেখতে পাচ্ছি তা মূলত রাজনৈতিক: ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

এখন যে সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা মূলত রাজনৈতিক। আমি সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো মন্তব্য করি না। তবে এ সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন গ্রুপের বা পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কীভাবে কী করা যায়।

আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী গণভবনে যে আলোচনার ডাক দিয়েছেন, সেটি ভালো কথা। তবে এও গুরুত্বপূর্ণ যে আলোচনার ফ্রেমওয়ার্ক কী হবে, কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, কারা কারা থাকবেন, সেটিও স্পষ্ট করা দরকার। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের পদক্ষেপ নিতে হবে: এম হুমায়ূন কবির 

পদক্ষেপগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হতে হবে। পশ্চিমারা মনে করে, এখানে ব্যাপক মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের জন্য তারা টিম পাঠাতে চায়, তদন্তে সম্পৃক্ত হতে চায়। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, তদন্তে জাতিসংঘের সাহায্য নেওয়া হবে। 

জাতিসংঘ চিঠি দিয়েছে তদন্তের জন্য। তারপর একটা বিচার বিভাগীয় কমিশন করা হয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, জাতিসংঘের কাছে এই মুহূর্তে তদন্তে সহযোগিতা চাওয়া হবে না। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সরকার।

আসলে তদন্ত একটি প্রাথমিক ব্যাপার। এটাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে কী করছেন, সেটাই একটা ব্যাপার। সেটা না করে শুধু ব্যাখ্যা দিতে থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। 

আমার মনে হয়, এই মৌলিক বিষয়গুলো সরকারকে বুঝতে হবে। শুধু ব্যাখ্যা দেওয়ার দিকে মনোযোগ না দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত

আন্দোলন এখন আর কোটার মধ্যে নেই: নূর মোহাম্মদ 

কোটা আন্দোলনের বিষয়টি অত্যন্ত সহজেই সমাধান করা যেত। দেশে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা এমন হতো না। শান্তিপূর্ণ উদ্যোগের মাধ্যমেই কোটার বিষয়টি সমাধান করা যেত।

কিন্তু শাসকগোষ্ঠী ও নেতারা বিষয়টি জটিল করে ফেলেছেন। দিন যত গড়িয়েছে, বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে। কোটা আন্দোলন এখন আর কোটার মধ্যে নেই।

কোটা আন্দোলনকারীরা এখন এক দফার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। এক দফা হচ্ছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর তারা পদত্যাগ দাবি করেছেন। পদত্যাগ করা না পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন। চতুর্দিকে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণ কোথায় ঘটে, তা এক আল্লাহ মাবুদ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।

চারদিকে নানা গুজব চলছে। বিভিন্ন আন্দোলনের সময় এটি হয়ে থাকে। এ জন্য সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। 

সাবেক আইজিপি ও এমপি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পরিকল্পনামাফিক সংস্কার জরুরি

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০২ পিএম
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পরিকল্পনামাফিক সংস্কার জরুরি
ড. এম শামসুল আলম

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়নের নামে নির্বিচারে একধরনের লুণ্ঠন করা হয়েছে। দুর্নীতি, লুণ্ঠন, আত্মসাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা ও লুণ্ঠনকারীকে সুরক্ষা দেওয়াসহ পছন্দমাফিক বিনিয়োগকারী ও ঠিকাদারকে বাছাই করা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে এই কাজ করার সঙ্গে যারাই জড়িত ছিলেন, তারা সবাই অপরাধী। প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগে যাকে খুশি, যখন খুশি, যত খুশি তত ব্যয়ে নিঃশর্তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কথিত উন্নয়ন চলেছে। আজ ১৫-১৬ বছর পর এসে আমরা ঠিক আগের মতোই বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সংকট দেখছি। বরং সংকট নানা দিক দিয়ে নানাভাবে আরও তীব্র ও ঘনীভূত হয়েছে। এর কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। 

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিবিড়ভাবে জড়িত। মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। লুণ্ঠনের অর্থ জোগানোর কারণে এমনটি হয়েছে। সরকার যদি জ্বালানিসংকট দূর করার জন্য তা ব্যয় করত, অর্থাৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকৃত উন্নয়নে সেই অর্থ ব্যয় হলে আজ দেশের এই অবস্থা হতো না। দেশজুড়ে লোডশেডিং থাকত না। দেশে মূল্যস্ফীতি হতো না এবং দেনার দায়ে দেশকে এ খাতে নাজুক অবস্থায় পড়তে হতো না। এসব সৃষ্টির মাধ্যমে সে সময়ের ক্ষমতাসীনরাই লাভবান হয়েছেন। এমনকি তারা নিজেরাও এর অংশ বলতেই হবে। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পরিকল্পনামাফিক সংস্কার করতে হবে। সম্প্রতি কিছু করণীয় প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে ‘সংস্কার কমিশন’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। কমিশন সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন করবে। সে ক্ষেত্রে প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে দেখা যাবে, লুণ্ঠনের কারণে বিদ্যুৎ ও জালানি খাতে যে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়ে আছে, মূল্যবৃদ্ধি করেও সমন্বয় করা যায়নি, সেই ঘাটতি দ্রুত কমে আসবে। বিগত সরকার জ্বালানি খাতে যে গভীর সংকট তৈরি করে গেছে, রাতারাতি তা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সময় দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কর্মপরিকল্পনার আওতায় ভোক্তাদের অন্তর্ভুক্তিতে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন শুরু হলে দ্রুত এর সুফল দৃশ্যমান হবে। লুণ্ঠনমূলক ব্যয় হ্রাস পাবে। মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা প্রশমিত হবে। সে ক্ষেত্রে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা হ্রাস পাবে।

বিদ্যুৎ ও জালানি খাতে রূপান্তর ঘটাতে তিনটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। প্রথমত, নীতিগত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অপচয় কমানোর কৌশল নিতে হবে। তৃতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অতিরিক্ত ব্যয় কমানো উচিত। অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধির দ্বারা যথেচ্ছ লুণ্ঠন করা হয়। জ্বালানি খাতকে রাজস্ব আহরণের বিশেষ খাত বলে মনে করা হতো। এ খাতকে এক দিকে লাভজনক করার অভিপ্রায়ে যত বেশি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তত বেশি সরকারের লাভ হয়েছে। সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট পেয়েছে ও সরকারি কোম্পানি থেকে মুনাফার ভাগ নিয়েছে। এখন বর্তমান সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, রাষ্ট্র এ খাতকে রাজস্ব বা মুনাফা আহরণের খাত হিসেবে দেখবে না। বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খাত মুনাফা ও রাজস্ব আহরণের খাত হওয়ায় যত মূল্যহার বাড়ে, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা ও রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ে। ফলে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। সরকারের ভূমিকায় তাতে উসকানি জোগায়। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এখানেই বিপত্তি। মুনাফাবিহীন কার্যক্রম ও সরকারের রাজস্ব আহরণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে মূল্যবৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার প্রায় ট্যাক্স-ভ্যাট কমায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে তা কখনো হয়নি; যা লুণ্ঠন সুরক্ষার শামিল।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমাদের চাহিদা বেড়েছে বটে। সে ক্ষেত্রে দেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হয়নি। সে জন্য বিদেশ থেকে আমাদের আমদানি করতে হয়। তেল আমদানি বৃদ্ধি না করে নিজস্ব গ্যাসের মজুত ও উত্তোলন বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধিতে অগ্রসর হলে জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জনগণকে মূল্যবৃদ্ধি ও চরম জ্বালানিসংকটের অভিঘাতের শিকার হতে হবে না। বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।

অথচ আমাদের মতো দরিদ্র দেশে সরকার নিজস্ব গ্যাসের মজুত বৃদ্ধি না করে জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানি বাড়ায়। এতে জনগণের জীবন রক্ষার মতো মৌলিক অধিকার বিপন্ন হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিকল্প নেই। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়। উৎপাদন ব্যয় লুণ্ঠনমূলক এবং গড়ে ১৩-১৪ টাকা। এই উৎপাদন ব্যয় জরুরি বিবেচ্য বিষয়। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে না পারলে তা আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধিতে অন্যতম নিয়ামক হবে। সৌরবিদ্যুতের সুফল ভোক্তা পাবে না। মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতের শিকার হবে। বিদ্যুৎ আমদানি বাজার তৈরিতে সহায়ক হবে। পরিবেশ সুরক্ষিত হবে। ছাদ এবং অব্যবহৃত জমি ব্যবহার করে ৫০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। তাতে ৪ টাকার মতো খরচ পড়ে। প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগে উৎপাদন হলে ৬-৭ টাকা বিক্রয় মূল্যহারে এ বিদ্যুৎ বাজার উন্নয়ন সম্ভব। তেমনটা হলে সৌরবিদ্যুৎকে খুব ভালো বিকল্প বলতে হবে। পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও দামের বিষয়টি আগে আলোচনায় আসা দরকার। যে সৌরবিদ্যুৎ ৪ টাকায় উৎপাদন করা যায়, তা ১২-১৩ টাকা মূল্যহারে কেনা হচ্ছে। যে কয়লা বিদ্যুৎ পুরোনো মেশিনসহ নানা সীমাবদ্ধতায় ১০ টাকা ব্যয় হারে উৎপাদন হয়, সেই বিদ্যুৎ আমদানি করা কয়লায় উৎপাদন হয় ১৪ টাকারও বেশি ব্যয় হারে। পারমাণবিক বিদ্যুতের দাম যদি আমদানি বিদ্যুতের মতো বেশি হয়, তাহলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ বিদ্যুতের ভূমিকা কী হবে? বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় তথা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে তা কতটা ভূমিকা রাখবে? এমন সব প্রশ্নের মীমাংসার ওপর নির্ভর করছে এই বিদ্যুতের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়। 

অন্তর্বর্তী সরকারকে খাদ্যনিরাপত্তার মতোই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্যই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন বাণিজ্যিক খাত হিসেবে নয়, কৃষি খাতের মতো সেবা খাত হিসেবে হতে হবে। এই বিবেচনায় ক্যাবের প্রস্তাবিত সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে যদি সরকার জ্বালানি রূপান্তর বিবেচনায় নেয়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধি ব্যতীত ঘাটতি সমন্বয় হবে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে আমরা আশাবাদী।

লেখক: জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব

আন্তসীমান্ত নদী, বাঁধ ও বাংলাদেশের বন্যা

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ এএম
আন্তসীমান্ত নদী, বাঁধ ও বাংলাদেশের বন্যা
ড. এম এ ফারুখ

যে নদী এক বা একাধিক দেশের রাজনৈতিক সীমান্ত অতিক্রম করে তাকে আন্তসীমান্ত নদী বা অভিন্ন নদী বা ইংরেজিতে ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার বলে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ২৬৩টি আন্তসীমান্ত নদী সক্রিয় রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দুটি দেশের সঙ্গে ছোট-বড় মিলিয়ে আন্তসীমান্ত নদ-নদী রয়েছে ৫৭টি। সরকারিভাবে বাংলাদেশ-ভারত এবং বাংলাদেশ-মায়ানমার আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫৪টি ও ৩টি। 

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রিভারাইন পিপল-এর ২০২৩ সালের এক গবেষণায় আরও ৬৯টি বাংলাদেশ-ভারত অস্বীকৃত আন্তসীমান্ত নদীর সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমানায় স্বীকৃত ৫৪টি নদীর মধ্যে ৬টি বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং তার মধ্যে ৩টি নদী আবার ভারত হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে ঢুকেছে। বাকি ৪৮টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ৩৬টি নদীর ওপর ভারত মোট ৫৪টি ব্যারাজ এবং ড্যাম তৈরি করেছে মূলত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, নদীর নাব্য বজায় রাখা এবং সেচ ও পানি মজুত রাখার জন্য। তবে যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, যেকোনো নদীতে বাঁধ বা ব্যারাজ বসানোর অর্থই হলো ভাটি অঞ্চলে পানির প্রাকৃতিক ও যথাযথ প্রবাহে বিঘ্ন ঘটানো। সে জন্য আন্তসীমান্ত নদ-নদীতে বাঁধ বা কোনো প্রতিবন্ধকতা নির্মাণের জন্য কিছু আন্তর্জাতিক আইন আছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আইনগুলোর যথাযথ তোয়াক্কা করছে না। অভিন্ন নদীতে পানির প্রবাহ নিয়ে সংকট শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘটছে এমন নয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এই দুটি দেশ ১৯৬০ সালে সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সই করেছিল। কিন্তু তার পরও দেশ দুটি প্রায়ই একে অপরকে চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। কোশি ও মহাকালী নদী নিয়ে ভারত ও নেপালের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বর্ষা ঋতুতে যখন উপমহাদেশে ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তখন এ-জাতীয় সমস্যা প্রায়ই দেখা দেয়। নিজ দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাঁধ নির্মাণ করেছে চীন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। ভারতে মোট বাঁধের সংখ্যা সাড়ে ৫ হাজার এবং এখানে আরও সাড়ে ৪০০ বড় বাঁধ নির্মাণাধীন। গঙ্গা নদীর অববাহিকাজুড়ে ভারতের বাঁধ আছে ১৮০টির বেশি। 

উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স এলাকায় বয়ে যাওয়া অভিন্ন নদীতে ভারতের প্রায় ৩০টি বাঁধ, ড্যাম ও পানির সংরক্ষণাগার রয়েছে। সিকিমের পর্বতশৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন, ভারত ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লাইফ লাইন বলে খ্যাত তিস্তা নদীর ওপর ১০টির বেশি বাঁধ-ব্যারাজ ও জলাধার নির্মাণ করেছে ভারত, প্রক্রিয়াধীন আছে আরও ৫টি বাঁধের। তবে বাংলাদেশের জন্য অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তসীমান্ত নদীতে নির্মিত ভারতের বিশেষ ৩টি বাঁধ।
 
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত, যা প্রায় ৭ হাজার ৩৫০ ফুট লম্বা এবং প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় বানানো হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে চালু হওয়া এই বাঁধটিতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে এবং ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় পানি এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়। এই বাঁধ তৈরির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীতে জমা পড়া পলি ধুয়ে পরিষ্কার করা এবং গঙ্গার শাখা নদী প্রায়মৃত ভাগীরথীকে পুনরায় গঙ্গার পানিতে জীবন্ত করে তোলা।

তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, গঙ্গার মতো বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হতে পারে। বাংলাদেশের সীমানা থেকে ৬০ কিলোমিটার উজানে ১৯৯৮ সালে গজলডোবা বাঁধ স্থাপিত হয়েছিল তিস্তা নদীর ভারতীয় অংশে। এই বাঁধের ৫৪টি গেট দিয়ে তিস্তার মূল প্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে মূলত তিস্তা-মহানন্দা খালে প্রবাহিত করা হয়। প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে বহমান তিস্তা থাকে পানিশূন্য। ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর হ্রদ থেকে উৎপন্ন আন্তসীমান্ত নদী গোমতীর ওপর ১৯৭০-এর দশকে নির্মিত ডম্বুর বাঁধটি বাংলাদেশ থেকে ১২০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত, যা একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল। এই বাঁধটি সম্পূর্ণভাবে খোলা হয়েছিল ১৯৮৪, ১৯৯৩ ও ২০২৪ সালে।

বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা গঙ্গা তথা পদ্মানির্ভর এবং গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ এই নদীর সেবা পেয়ে আসছে। এই নদী প্রায় ৭০০ কিলোমিটার উপকূল বরাবর জীবজাগতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কার মাধ্যমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মরূকরণ শুরু হয়েছে, প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, বর্ষায় দেশের উত্তরাঞ্চলে তীব্র বন্যা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌপরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচা ঘাটে আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন তিস্তা, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে রংপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। তিস্তার অববাহিকা আনুমানিক ১২ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় তিস্তার ওপর নির্ভরশীল প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা। তিস্তা বাংলাদেশের প্রধান ফসল বোরো ধান চাষের জন্য পানির প্রাথমিক উৎস এবং মোট ফসলি জমির প্রায় ১৪ শতাংশের সেচ প্রদান করে। তিস্তা ব্যারাজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত জেলা ৬টি ও এর আওতাভুক্ত এলাকা সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের আগে বাংলাদেশের ডালিয়া সীমান্তে তিস্তার বার্ষিক গড় পানিপ্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কিউসেক যা, গজলডোবা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর কমে ২ হাজার কিউসেকে দাঁড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন পানিপ্রবাহ ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩০০ কিউসেকে নেমে আসে। তিস্তা অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত এক দশকে প্রায় ১০ মিটার নিচে নেমে গেছে। কৃষকদের সেচের খরচ অনেক গুণ বেড়েছে এবং কৃষিব্যবস্থাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। তিস্তায় পানি ঘাটতির কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষতি হচ্ছে। এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশের সমান।

এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের চাল উৎপাদন প্রায় ৮ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। দেশের উত্তরবঙ্গের খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকার সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পুরো উত্তরবঙ্গের পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত প্লাবিত সাম্প্রতিক বন্যার প্রক্ষাপটে অনেকে দাবি করছেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত গোমতী নদীর ওপর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাইতে অবস্থিত ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও সেখানে পাহাড়ি অঞ্চলে সৃষ্ট ডাকাতিয়া নদীর পানি বৃদ্ধিও গোমতীর পাশাপাশি নদী প্লাবনে ভূমিকা রেখেছে। গত ২৬ আগস্ট ফারাক্কা ব্যারাজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়ে ফিডার ক্যানেলে ৪০ হাজার কিউসেক ও ডাউন স্ট্রিমে ১১ লাখ কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে। এতে নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ এবং ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফারাক্কা ব্যারাজ এলাকায় পানি বিপৎসীমার ৭৭ দশমিক ৩৪ মিটার ওপর দিয়ে বইতে থাকায় বাধ্য হয়ে গেট খুলতে হয়েছে বলে ভারত জানিয়েছে। 

এশিয়ার বৃহত্তম ১০টি নদীর উৎস বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওয়াটার টাওয়ার হিসেবে খ্যাত হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলে, যা বাংলাদেশের অনেকটা উজানের উচ্চধারায় অবস্থিত। অধুনা বাংলাদেশে প্রবাহিত মোট নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি বলে প্রকাশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এসব নদী দিয়ে প্রবাহিত উজানের দেশগুলোর পানি নিম্নে ধাবিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে নেমে যাবে, এটাই চিরন্তন প্রক্রিয়া। দেশের অভ্যন্তরে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রবেশ ঠেকানো এবং সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রাখতেও এই নিম্নধারার পানির প্রবাহ বজায় রাখা জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, উজান থেকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে নেমে যাওয়া পানির ৫৬ শতাংশ ভারতের ও ৪৪ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরের। তাই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতকেও উপলব্ধি করতে হবে যে, উজানে নির্মিত তাদের বাঁধগুলো পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বাংলাদেশকে যেমন বঞ্চিত করছে, তেমনি অকালবন্যায় প্লাবিত করছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার কারণে নষ্ট হচ্ছে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, বাড়াচ্ছে জনদুর্ভোগ।

 সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানে থাকায় ভারত বাংলাদেশের দক্ষিণে বা ভাটিতে নেই, তবু ভারতের পানি আগ্রাসন বা অসম পানিবণ্টন বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। অভিন্ন নদীগুলোর পানি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা, সম্প্রীতি এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত ও গভীরতর করতে পারে। প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র যেমন বন্যানিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ নানাবিধ উপকারী প্রকল্প গ্রহণে সহায়ক হতে পারে এবং বর্তমানের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আগামীতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
[email protected]

আপসের কোনো সুযোগ দেখি না

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপসের কোনো সুযোগ দেখি না
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

এই যে আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না; স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহির দায়ভার গ্রহণ করে না। যে অন্যায়গুলো ঘটেছে, সেগুলো জনগণের জন্য বড় রকমের সমস্যা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র এগুলোকে তার নিজের জন্য কোনো হুমকি বলে মনে করে না।

দেখা যায় যে বড় বড় অপরাধীর শাস্তি হয় না, যে জন্য অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে যে, অনেক অপরাধ সরকারি লোকদের হয় আশ্রয়ে নয়তো প্রশ্রয়ে ঘটে। সরকারি বলতে রাজনীতিক ও বিভিন্ন ধরনের আমলাতন্ত্রের সদস্য- উভয়কেই বুঝতে হবে। শাসক শ্রেণি জনগণের সম্মতি নিয়ে দেশ শাসন করে না। ভোটের তামাশায় তারা জোরজবরদস্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। 

যখন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, তখনো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না; ভোটে জেতে তারাই, যাদের টাকা আছে। টাকাওয়ালারা নির্বাচনে টাকা খরচ করে, জেতে এবং জিতে আরও বেশি ধনী হয়। তা ছাড়া এমন ঘটনাও তো ঘটে যে, ভোটার আসে না, ভোট দেয় না, তবু কথিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে যান এবং দম্ভের সঙ্গে দেশ শাসন করেন। সরকার যে টিকে থাকে সেটা জনসমর্থনের দরুন নয়, ক্ষমতার জোরে ও দাপটে। 

বর্তমানে শাসক শ্রেণির জন্য জনসমর্থনের চেয়েও বিদেশি শক্তির সমর্থন অধিক জরুরি হয়ে উঠেছে। মোট কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শাসক শ্রেণির স্বার্থকে নিরাপত্তা দেওয়া। নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইনকানুন, সরকারি-বেসরকারি বাহিনী- সবকিছুই মজুত রয়েছে। আমাদের এই রাষ্ট্রকে তাই বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।

বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন ঠিকই, বলতে হয়, নইলে তারা বুদ্ধিজীবী কেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই কথা বলেন লাইন ধরে। একদল থাকেন সরকারের পক্ষে, কথা বলেন ইনিয়ে বিনিয়ে, সরকারের মুখ চেয়ে। এরা হয়তো ইতোমধ্যেই সুবিধা পেয়েছেন, নয়তো পাবেন বলে আশা করছেন। 

সরকারের বিরুদ্ধে যারা বলেন তারাও আশাবাদী; আশা রাখেন যে, এখন পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আগামীতে সুদিন আসবে এবং তখন সুবিধা পাবেন। তবে তাদের কথায় তেমন জোর থাকে না। প্রথমত, গণমাধ্যম তাদের তেমন একটা পাত্তা দেয় না, কেননা গণমাধ্যমের মালিকরা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চান না, ভয় পান। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও বিরুদ্ধ মত পছন্দ করে না, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে খুশি হয়।

দুই দলের কোনো দলই জনজীবনের গভীরে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সেগুলোর দিকে যেতে চায়নি। দৃশ্যমান সমস্যাগুলো যে গভীর এক অসুখেরই প্রকাশ এবং সে অসুখের নাম যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের দৌরাত্ম্য, সেটা তারা মানতে চান না। মানলে তাদের খুবই অসুবিধা। 

তারা চান ব্যবস্থাটাকে যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে নিজেদের যা প্রাপ্য সেটা বুঝে নিতে। সুবিধা ভাগাভাগির লড়াইটাকে তারা মতাদর্শিক লড়াইয়ের আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখতে চান; রাখেনও। কিন্তু যতই লুকোচুরি খেলুন, তারা যে জনগণের পক্ষের শক্তি নন, এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।

তা ছাড়া এটাও তো মানতে হবে যে, গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা আমাদের দেশে উৎসাহ পায় না। এখানে মতাদর্শিক বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নেই। জাতীয় সংসদ আত্মসন্তুষ্ট দম্ভোক্তি, চাটুকারিতা ও অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে সর্বক্ষণ মুখরিত থাকে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও ছবি যত পাওয়া যায়, চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা তার শতভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কদর নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ চিন্তার মানের ও জ্ঞান প্রকাশের ভাষাগত দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, এমনটা বলা যাচ্ছে না, বরং উল্টোটাই ঘটেছে বলে সন্দেহ।

দলীয় আনুগত্যের বাইরে যে বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, যারা মনে করেন রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না, তাদের সংখ্যা অল্প। যারা আছেন তারাও সুসংগঠিত নন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাদের বক্তব্য প্রচার পায় না। সরকার তাদের অপছন্দ করে; গণমাধ্যম তাদের অবাঞ্ছিত বলে জানে।

রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা, আয় উপার্জন, সে তো সাধারণ মানুষের কারণেই। তবে সম্পর্কটা একপক্ষীয়, দ্বিপক্ষীয় নয়। রাষ্ট্র হুকুম দেয়, জনগণ শোনে, শুনতে বাধ্য হয়। জনগণ যা বলতে চায় রাষ্ট্র তা শোনে না। রাষ্ট্র শাসন করে, জনগণ শাসিত হয়। রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তগুলো বিনা বিচারে ও নির্দ্বিধায় জনণের ওপর চাপিয়ে দেয়; জনগণের কিছু বলার থাকে না, তারা শুধু দেখে এবং সহ্য করে।

রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন প্রণয়ন বিভাগে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বলতে প্রায় কেউই থাকে না। ওদিকে বিচার বিভাগ জনগণের বড় অংশের জন্য অনেকটা নিষিদ্ধই হয়ে রয়েছে। আদালতে যেতে হলে টাকা লাগে, গেলে ন্যায়বিচার কতটা পাওয়া যাবে এবং কবে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েই যায়। মামলা করে নিঃস্ব হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়।

রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ তাই মোটেই দ্বিপক্ষীয় নয়, একপক্ষীয় বটে। দুই পক্ষের যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হতে পারে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম পারে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তুলে ধরতে; পারে কিছু পরিমাণে হলেও রাষ্ট্রকে জবাবদিহির জায়গায় নিয়ে আসতে। কেবল যে পারে তা নয়, পারাটা উচিতও বটে। 

কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম সে কাজটা করে না। সরকারের অর্জন, সরকারি ও সরকারপক্ষীয় লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এর কারণ মালিকরা সবাই সব সময়ে সরকারপন্থি। এই পক্ষপাত মতাদর্শিক অনুপ্রেরণায় নয়, স্বার্থের টানে।

দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠছে। জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা দুঃসহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্য সমস্যা তো বটেই, জনদুর্ভোগের এই দুটি বড় বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে যে সরবতা প্রত্যাশিত তা পাওয়া যাচ্ছে না।

দুর্বলকে রক্ষা করা এবং দুর্জনকে দমন করা একটি আদর্শের কথা। এমন আদর্শ রাষ্ট্র পাওয়া কঠিন, এখন তো পাওয়া যাচ্ছেই না।
আমাদের রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দুর্বলরা রয়েছে দুর্জনদের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র ধনীদের ইচ্ছায় চলে। ধনীরা উৎপাদনের সূত্রে ধনী হয়নি। উৎপাদন যা করার করে মেহনতি মানুষ। ধনীদের অধিকাংশই ধনী হয়েছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরা দুর্বল নয়, এরা দুর্জন। এদের পক্ষে দুর্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দুর্জনদের কারণেই দুর্বলরা দুর্বল থাকে এবং অসহায় বোধ করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় নেই। 

উত্তরণের জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, কিন্তু সফল হইনি। সফল না হওয়ার কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। ওপর কাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে, উন্নতিও হয়েছে, কিন্তু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। শাসক-শাসিতের সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার যে সম্পর্ক সে রকমেরই রয়ে গেছে। 

রাষ্ট্রের নাম বদলেছে, আয়তনে পরিবর্তন ঘটেছে, পুরোনো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসক এসেছে, কিন্তু শাসক-শাসিতের সম্পর্কে মৌলিক রদবদল ঘটেনি। ধনীরা গরিবদের জ্বালাতন করে। এ ঘটনা আগেও ছিল, এখনো আছে। ধনবৈষম্য আগের তুলনায় কমে তো নয়ই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না আসার কারণ সমাজে বিপ্লব না ঘটা। উত্তরণের জন্য সমাজ পরিবর্তনের অব্যাহত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে আপসের কোনো সুযোগ দেখি না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরা জরুরি

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২৮ পিএম
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরা জরুরি
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

দীর্ঘদিন থেকে দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মূলত গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষকদের পদত্যাগের কারণে এমন সংকট তৈরি হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। আমার বিভাগে একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকেই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একই প্রক্রিয়ায় একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে।

আমি কয়েক দিন থেকে লক্ষ করছি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা খুব উৎসাহ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। যদিও এখনো সব শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে ক্লাসে পাইনি। কোনো কোনো শিক্ষার্থী তৎকালীন সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে তারা এখনো ক্লাসে ফিরতে শঙ্কায় রয়েছে। বাকি সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে আসছে। একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হলেও সেশনজটের একটি বড় শঙ্কা তৈরি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মনে একধরনের অস্থিরতা রয়েছে। 

এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। কয়েক বছর আগে করোনার কারণে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তখন তৈরি হওয়া সংকট এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, আমার বিভাগে এমন একটি একাডেমিক ব্যাচ রয়েছে, যাদের স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকলে এক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই ব্যাচ প্রায় দুই থেকে তিন বছরের সেশনজটে পড়ে আছে। বর্তমানে তারা একাডেমিক এমন একটি পর্যায়ে আছে যে, স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকলে তাদের মাস্টার্স শেষ করতে আরও প্রায় দুই বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

তা ছাড়া এই মুহূর্তে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা লক্ষ করেছি প্রতিনিয়ত আলটিমেটাম দিয়ে শিক্ষকদের পদত্যাগ এবং অপসারণে বাধ্য করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর বার্তা এবং প্রজ্ঞাপন থাকলেও সেটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। 

বিশেষ করে যেসব শিক্ষকের নামে নানা ধরনের অনৈতিক কিংবা আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে, তাদের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি চলছে। এ ধরনের বিষয়কে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন, আবার অনেকেই এসব পরিস্থিতিকে হয়রানিমূলক হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। উল্লিখিত নানা ধরনের পরিস্থিতির কারণে একধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতিও ঘটেছে।

কিছু কিছু পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে একজন শিক্ষক আরেকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কাজে লিপ্ত রয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শুধু রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা, ব্যক্তিগত রেষারেষি প্রভৃতি কারণেও অসংখ্য পদত্যাগের কিংবা চাকরি থেকে অপসারণের দাবি উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। 

তবে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে, যেগুলোর প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে। আমি মনে করি, দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অর্থাৎ উপাচার্য নিয়োগ হলে ওই অভিযোগগুলো যথাযথভাবে তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। 

দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগে দলীয়করণ লক্ষ করা গেছে। ফলে যেকোনো ধরনের নিয়োগ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনাতেও দলীয়করণের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। এমনকি এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রাধ্যক্ষ, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালকসহ এমন কোনো পদ নেই যে দলীয়করণের বাইরে রয়েছে। 

আর দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফলে শিক্ষকরা যারা প্রশাসনের পদে গিয়েছেন, তারা তাদের মনমতো যা ইচ্ছা তাই করেছেন বা করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মতো অভিযোগ স্পষ্টভাবে থাকা সত্ত্বেও দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ওই সব প্রশাসনিক পদধারী শিক্ষকরা কোনো শাস্তির আওতায় আসেননি। এখনো শঙ্কা রয়েছে যে, ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কি না।  

লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাম্প্রতিক অতীতে এবং বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানাবিধ অনিয়ম, অন্যায়ের অভিযোগ প্রায়ই আমাদের সামনে আসছে। এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন কিংবা অনিয়মের কথাও শোনা যাচ্ছে। এর আগেও এমন অনেক অভিযাগ ছিল, কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এসব বিষয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। 

বিশেষ করে বহু প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আসা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে কিংবা দলীয় লেজুড়বৃত্তির বদৌলতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। মূলত এসব ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অনেকে সেটির বৈধতা পেয়ে গেছেন। 

বাংলাদেশে নিজের নীতি-নৈতিকতার অবস্থানের কারণে পদ থেকে সরে যাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। এবারের উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও আমরা সেটি লক্ষ করেছি। অনেকেই দলীয় লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে এখন নিরপেক্ষ সেজে পদ ছাড়েননি। অথচ তারাই একসময় দলীয় লেজুড়বৃত্তি করেই ওই পদগুলোতে বসেছিলেন বা পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। আলটিমেটাম নেই, এই অজুহাতে দলীয় নিরপেক্ষ সাজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক পদধারী কেউ কেউ। আবার জানা গেছে, আলটিমেটাম যাতে না আসে, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে চলছেন তারা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বেচ্ছায় পদ থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা অনেক। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো কোনো প্রশাসকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো কর্ণপাত লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অবস্থা বিরাজ করার পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। 

তার মধ্যে বড় কারণ হলো উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি না হওয়া। সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে অনেকেই উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য হওয়া। যে কারণে তারা সরকার, মন্ত্রণালয় কিংবা ইউজিসিকে শুরু থেকেই খুশি করার তোষামোদিতে ব্যস্ত থাকেন। আর এই খুশির বেড়াজাল সহজে কেউই ভাঙতে পারেন না।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পর্যায়ে কতিপয় তথাকথিত তোষামোদকারী ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে যথাযথ সুশাসন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই সরকার যদি প্রকৃতপক্ষেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে এসে প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগ নিশ্চিত করা। বিষয়টি মোটেও সহজ নয়। তবে ধীরে ধীরে সেই পর্যায়ে যাওয়ার মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই একাডেমিক পরিস্থিতির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

পশ্চিমবঙ্গে দাবি একটাই, জাস্টিস চাই

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৫৭ এএম
পশ্চিমবঙ্গে দাবি একটাই, জাস্টিস চাই
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

প্রায় এক মাস হতে চলল কলকাতার আরজি কর হাসপাতালের ৩১ বছরের এক ট্রেইনি ডাক্তার ‘অভয়া’কে হাসপাতালের ভেতরেই ধর্ষণের পর খুনের ঘটনা। এতে শুধু কলকাতায় নয়, এই জঘন্যতম ঘটনার প্রতিবাদের ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়েছে দিল্লিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে। এ ব্যাপারে কলকাতা হাইকোর্ট কঠোর মনোভাব নেওয়ায় সারা দেশে ডাক্তাদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এমন কোনো শহর নেই, সেখানে ডাক্তাররা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন না।

এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত কলেজের অধ্যক্ষ এখন সিবিআইয়ের কাস্টডিতে আছেন। ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি হাতে নেন।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইকে দ্রুত তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের গত বুধবার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ প্রধান বিচারপতি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই শুনানি হয়নি।

কলকাতা শহরে সব মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার রাস্তায় বেরিয়ে ওই নারকীয় ঘটনার বিচার এবং দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা চাইছেন। এই জঘন্যতম অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং সাজা দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছেন। দিনে ও রাতে তারা কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করছেন। ছাত্রদের সঙ্গে প্রবীণ চিকিৎসক এবং সাধারণ মানুষ কয়েক দিন ধরে রাস্তায় নেমেছেন ‘অভয়া’ হত্যার বিচারের দাবিতে। তারা চান সুবিচার।

ঘটনার মূল হোতা ওই হাসপাতালের অধ্যক্ষ সন্দ্বীপ ঘোষের বিরুদ্ধে অভয়ার ধর্ষণ-খুন চাপা দেওয়া ছাড়াও নানাবিধ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। ঘটনাচক্রে এখন প্রকাশ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভূরি ভূরি খবর আসছে। এই সন্দ্বীপ ঘোষ নাকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ সদস্য।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তায় নেমে এলেও সামনের সারিতে আসতে পারছে না। কারণ আন্দোলনকারী ছাত্র-যুব এবং সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের আন্দোলন থেকে দূরেই রেখেছে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে। রাস্তায় তারা রাতও জাগছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে খবর আসে, দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় অসুস্থ। তাই ৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বসছে না।

এ খবর আসার পর গোটা পশ্চিমবঙ্গে রাত ৯টা থেকে এক ঘণ্টার জন্য রাস্তায় রাস্তায়, বাড়িতে বাড়িতে আলো নিভিয়ে ব্ল্যাক-আউট পালন করা হয়েছে। কলকাতা থেকে কোচবিহার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এই বিক্ষোভ, আন্দোলন, মানববন্ধন। সবার মুখে একটাই কথা- উই ওয়ান্ট জাস্টিস বা আমরা বিচার চাই।

এ লেখা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সব শহর, গ্রামগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ চলছে। সিপিআই গত ১৫ দিন ধরে ১৫০ ঘণ্টা সন্দ্বীপকে জেরা করেছে। ষড়যন্ত্রের সব খবর এখনো সিপিআই পুরোটা পায়নি। তাই তাকে ‘লাই ডিটেক্টর’ পরীক্ষাও করানো হয়েছে। সিবিআই জানিয়েছে, পলিগ্রাফ পরীক্ষায় এমন সব তথ্য উঠে এসেছে, যা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর।

ধর্ষণ এবং হত্যার ৬ ঘণ্টা পরও তার বাসা থেকে ঘটনার খবর জানানো হয়নি। যখন তারা বললেন, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন হাসপাতালে। ‘অভয়ার’ মা জুনিয়র এবং সিনিয়র ডাক্তারদের সামনে বলেন, আরজি কর আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে। যারা আমার জন্য পথে নেমেছে তারাই আমার শক্তি। ৮ তারিখ আমার মেয়ে মা-মা করে কত কেঁদেছিল। সেদিন তা শুনতে পাইনি। 

এখন প্রতি রাতে শুনতে পাই। যারা ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে, তারাও ঘুমহারা হোক। বিচার না পাওয়া পর্যন্ত যেন না থামে ওই আন্দোলন। ২৭ দিন আগে এই হাসপাতালে দাঁড়িয়েই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তাদের। আরজি করে কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত এবং ধর্ষিত চিকিৎসকের বাবা-মা হাসপাতালে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ফিরে পাওয়ার কথা বলছেন।

চিকিৎসকের ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় অভিযোগ করেন, লাশ দেওয়ার সময় পুলিশ তাদের সাদা কাগজে সই করাতে চেয়েছিল। সে কাগজ তারা ছিঁড়ে ফেলেন।

আরজি কর হাসপাতালের ধরনামঞ্চ থেকে ‘অভয়ার’ বাবা-মা প্রশ্ন তোলেন, সকাল ১০টা ১০ মিনিটে পুলিশ জানতে পেয়েছিল। কেন পরক্ষণেই শারীরিক পরীক্ষা করেনি? মেডিকেল টেস্টে আত্মহত্যা করেছে বলে জানানো হলো কেন? হাসপাতালে আসার পর তিন ঘণ্টা বাবা-মাকে বসিয়ে রাখা হলো কেন? তখন আমরা পুলিশের হাতে-পায়ে ধরেছিলাম। তাও মেয়েকে দেখতে দেয়নি। কেন? পোস্টমর্টেম করতে দেরি হলো কেন?

অভয়ার মা এ ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালকে। একটি খোলা চিঠি দিয়ে মেয়ের হত্যার বিচার চেয়েছেন। ওই চিঠিতে হতভাগ্য মা লিখেছেন: আমাদের মেয়ে ছোটবেলা থেকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। তাই কি তার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই তার সঙ্গে নির্মম, নিষ্ঠুর, পৈশাচিক এ ঘটনা হলো? যে বা যারা এটা ঘটাল, তাদের আড়াল করার জন্য সব তথ্যপ্রমাণ লোপাট করা হলো?

ঘটনার রাতে ১১টা ১৫ মিনিটে আমার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়। তখনো সে হাসিখুশি ছিল। সকালে আমার মেয়ে আর নেই। যা-ই ঘটুক না কেন, বাবা-মা হিসেবে তো আমাদের জানানো উচিত ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। ওদের দায়িত্বেই তো আমরা মেয়েটাকে ওখানে পাঠিয়েছিলাম। বেলা ১১টায় আমাদের ফোন করে বলা হয়, আপনার মেয়ে অসুস্থ। তাড়াতাড়ি চলে আসুন। গাড়িতে যেতে যেতে আসে অতিরিক্ত সুপারের ফোন। বলেন, আপনার মেয়ে সুইসাইড করেছে। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।

আরজি কর হাসপাতাল-কাণ্ডে আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেছে বিদেশেও। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত বাঙালি চিকিৎসকরা একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন। তাতে লেখা হয়েছে, আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী কলকাতা মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্রছাত্রী। আরজি কর হাসপাতালে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘৃণ্য এবং জঘন্যতম অপরাধ আমাদের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। চিকিৎসা শিক্ষা এবং চিকিৎসাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগের খবর শুনে আমাদের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে গেছে।

আমাদের প্রাথমিক দাবি, অতি দ্রুত সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি, একই সঙ্গে আমরা চাই আমাদের চিকিৎসক এবং ছাত্রছাত্রী ভাইবোনেরা যেন একটা নিরাপদ, দুর্নীতিমুক্ত ও সুস্থ পরিবেশে পড়াশোনা ও কাজ করতে পারে। আমরা সর্বান্তকরণে আন্দোলনরত কলকাতার চিকিৎসকদের সঙ্গে আছি। আন্দোলনরত জুনিয়র, সিনিয়র চিকিৎসক, নাগরিক সমাজের দাবি একটাই, আমরা জাস্টিস চাই। জাস্টিস চাই।

লেখক: ভারতের সিরিয়র সাংবাদিক