এখন কোটা আন্দোলন নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছে। অনেক কথা শেষও হয়ে গেছে। বহু কথা নতুন শুনছি। আমরা বহু বছর পর আমাদের রাস্তায় মিলিটারি, বিজিবি প্রভৃতি দেখলাম। শিক্ষার্থীদের হাতে বন্দুক, পুলিশের সামনে, সেটিও দেখা হলো আবার। নতুন করে ‘রাজাকার’, ‘দেশপ্রেমিক’ ইত্যাদি বিনির্মাণ আমরা শুনেছি।
কেউ বলছেন, এটি জামায়াত-শিবিরের কাজ এবং তারাই এতে জড়িত। এই আন্দলনে যার কোনো মূল্য নেই। ফলে যারা কোটার বিপক্ষে কথা বলছেন, তারা কিছুটা সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করছেন। লাভ হচ্ছে না। বরং আমি বলব, তারা মারাত্মক ভুল করছেন। কেননা এন্তার মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে তাদের। মিথ্যায় টান পড়ার উপক্রম এবং এই মিথ্যা এমন নয় যে মানুষ বুঝতে পারছে না।
খুবই বুঝতে পারছে এবং এই নানাবিধ মিথ্যা বলার কারণে আমি নিশ্চিত, মানুষেরা তাদের সত্যি কথাও হয়তো আর বিশ্বাস করবে না ভবিষ্যতে। এ দেশের ছাত্র নেতৃত্বের দুর্বলতা অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু মুখ ফুটে বলেননি। এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হলো। আসলে এই ছাত্র নেতৃত্ব বহুক্ষেত্রে অন্যায়ের ওপর ভর করেছিল। সেসব কিচ্ছা আমরা বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় পড়েছি। রাজনীতির অভিভাবকরা তাতে গ্রাহ্য করেননি।
ফলে খুব অপমানজনকভাবে তাদের তাড়িয়ে দিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের চলে যেতে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্রমশ পড়ল বিপদে। পাশাপাশি আমরা দেখলাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের কঠিন নীরবতা এবং নিষ্ঠুরতার অংশী হতে। তারা পুলিশকে বলতে পারলেন না আমাদের শিক্ষার্থীরা শান্তিভঙ্গ করেনি, ওদের মারবেন না। তারা বরং মারাত্মকভাবে চুপ থাকলেন।
কিছু শিক্ষক অবশ্যই এগিয়ে এলেন, খুব হাতে গোনা। একজন ভিসি পাওয়া গেল না, একজন ডিনকেও নয়। ভিসিরা এ কারণে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে অপদস্থ কম হলেন না। যদি এদের হুঁশ ফেরে এবার। ফিরবে, সে আশা কম। শিক্ষক সমিতির কেউ কেউ কিছু একটা করে দায় সারলেন। সেটি আবার অনেক কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর।
অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থা। এখন আমরা নানা জায়গা থেকে নানা বক্তব্য পাচ্ছি। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। যেন এক গোলক ধাঁধা। পুলিশ প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে পারল না। এ দেশের শিক্ষকদের এত অগ্রাহ্য করা, আগে কখনো দেখা যায়নি। এর জন্য অবশ্যই দায়ী আমাদের ভিসিকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এখন কিছু একটা বলে ছেলে ভোলানোর মতো কিছু বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা হচ্ছে। তবে যারা বলছেন, তারা নিজেরাও জানেন যে তাদের কথা কেউ আমলে নিচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সমর্থক কিছু সাংবাদিক আমি চিনি। তারা তো নিয়মিত কথা বলছেন এই আন্দোলনের পক্ষে। আহত-নিহত আর আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের পক্ষে।
আমি আমার জীবনের একটি দীর্ঘ সময় বিদেশে এবং বিশেষত পশ্চিমা দেশে থাকা অবস্থায় একজন বাংলাদেশি পাইনি, যিনি বাংলাদেশে ফিরে আসতে চান। তার প্রথম চিন্তা এবং চেষ্টা, কী করে ওই দেশে থেকে যাওয়া যায়। হ্যাঁ, আপনার জন্য সেই লোকটি চিন্তার হতে পারে, যিনি নাকি সব সুবিধা নেওয়ার পর এই দেশের মঙ্গলের চিন্তা করেন না, এই দেশ বিলং করেন না। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তার অবস্থান ভারতে হতে পারে, আমেরিকায় হতে পারে, সৌদি আরবে হতে পারে।
শুধু একটি দেশ নিয়ে আপনার মাথা ঘামানো ঠিক না। এরা সবাই আসলে এ দেশে নিরাপত্তা চায়, এ দেশের নেতৃত্বের মেরুদণ্ড দেখতে চায়, যা দেখাতে আমাদের নেতৃত্ব সব সময় ব্যর্থ। বরং তারা উল্টাপাল্টা কথা বলায় ব্যস্ত, যা শুনে আমাদের সবচেয়ে ছোট শিক্ষার্থীও হাসে। খুব অশিক্ষিতের মতো কিছু একটা বলে তারা পার পেয়ে যেতে চান। অথচ মেরুদণ্ড দেখাতে তারা ব্যর্থ সব সময়। যেভাবে আমাদের পাশের দেশ ভারত-পাকিস্তান, মালদ্বীপ, এমনকি নেপালের প্রতিনিধিরা বিদেশি প্ল্যাটফর্মে কথা বলেন।
আপনাদের সেই সাহস অর্জন করতে বহু বছর লাগবে। সেখানেও আপনি ব্যর্থ। এটি কেবল একটি উদাহরণ। ফলে যে শব্দগুলো আমরা শুনতে চাই না, সেটি এদের অবলম্বন হয়েছে এবং সেখানে আপনি, আমি, আমরা সবাই ব্যর্থ নই কি? কেন আমাদের পাস করা ছেলেটি তার সময় নষ্ট করবে শিরীষগাছতলায়, যেখানে অভদ্র রাজনীতির চর্চা হয় ছাত্ররাজনীতির নামে? একটিই কারণ, এদের সঙ্গে থেকে থেকে যদি একটি চাকরি জোগাড় করা যায়!
আসলে আমরা খুব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি এদের কান্না, এদের মনের ভাষা। আর শাসকশ্রেণি এদের বুঝতে সব সময় ব্যর্থ। বুঝতে চায়ওনি। তারা এখানকার সব চেটেপুটে নিজের ছেলে-মেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে, শেষ জীবনে স্বপ্ন দেখেন- বিদেশেই যদি তার একটি জায়গা হয়! এদের সঙ্গে মারাত্মকভাবে যুক্ত এখন পিয়ন থেকে উচ্চ অফিসার। মানে যিনি কষ্ট করে বিদেশে থাকলেন নিজের যোগ্যতায়, এই চেটেপুটে খাওয়ারা সেটিও দেখল না। হায়রে দুঃসময়!
এই দেশের নেতৃত্ব কখনোই আমাদের স্বপ্ন দেখায়নি। কারণ তারা এদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেননি। তারা চেয়েছেন শুধু ক্ষমতা। সেই তানে সুর মিলিয়েছি আমরা বহুজনে। বহু ক্ষেত্রেই নির্বোধের মতো এবং নিজেদের আখের ঠিক থাকবে কোন কথায়, সেটি বিবেচনা করে। অনেকেই চুপ থেকেছি, কেউ কেউ সব সময় সব শাসকের সঙ্গে গলা মিলিয়েছি। তবে এই আন্দোলনে সবচেয়ে হতাশ করেছে, আমার মতে, আমাদের শিক্ষকসমাজ। তারা এই সংকটে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হতে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ।
অথচ তারাই নাকি দেশের মূল মাথা। এরাই আসলে সুন্দর করে বোঝাতে পারত কী করলে ভালো হয়। তাতে সরকার উপকৃত হতো, হতো দেশ। এত মৃত্যু দেখতে হতো না; এত সম্পদ নষ্ট হতো না। কিন্তু তারা সেটি করলেন না। সরকার এবং সাধারণ মানুষের মাঝে সেতুবন্ধ হয়ে তাদের কাজ করার কথা ছিল। করলেন না। বরং তারা ভয়াবহ নীরবতা পালন করলেন! কিচ্ছু বলার নেই। অথচ শিক্ষার্থীরা কিচ্ছু চায়নি, শুধু একটু অধিকার চেয়েছিল, যৌক্তিক অধিকার।
তারা লাশ হয়ে ঘরে ফিরল (?)। মায়ের কান্নার তোয়াক্কা না করে। তাও ওই অধিকার আদায়ের জন্য। ভাবা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে? সেখানে তারা হিন্দু ছিল না, মুসলিম ছিল না কিংবা অন্য ধর্মের। তারা ছিল শিক্ষার্থী। তারা রাজনৈতিক দলের অংশী ছিল না, সেই সাধ নিয়ে তারা ওখানে যায়নি। তারা শুধু একটি চাকরির অধিকার চেয়েছিল। অধিকার চাইতে গিয়ে রক্তাক্ত হবে, সে এই দেশ বিলং করবে কেন? আপনি করেন কি?
কিন্তু তারা তারপরও করে এবং আপনার আমার চেয়ে অনেক বেশি করে, অনেক সাহসের সঙ্গে করে। আপনি, আমি এই সাহসকেই ভয় পেয়েছি এবং সেটি যে কী ভয়াবহ ভয় তা আমাদের জাতীয় নেতাদের বয়ানে বোঝা যায়। যেমন কিছুদিন আগে এক জাতীয় বড় নেতা বলছেন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তৈরি থাকতে।
মানে, যেন অনেক কিছু হারিয়ে গেছে; এখন খুঁজে দেখ, এলাকা ধরে রাখো। কোনো দরকার ছিল না। এসব গ্লানির নর্দমায় অনেকখানি মাথা খোয়ালেন আমাদের দেশের এক ধন্য অধ্যাপক। ছাইভস্ম সব। অথচ এসব কাম্য ছিল না। কাম্য নয়। খুব সহজ সমাধান ছিল যার, তাকে আমরা লাঠিপেটা করলাম, তার রক্ত ঝরালাম এবং লাশ বানিয়ে ফেললাম। এটি কি তাদের প্রাপ্য ছিল?
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]