বাংলাদেশের রাজনীতি খুবই দুর্বল ও নিম্নমানের হয়ে পড়েছে। সরকার যে রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে পরিচালিত হয়, সেই শক্তি মাঝে মাঝে ব্যবহার করার মতো অবস্থায় সরকার থাকে না। রাজনৈতিক দলের মধ্যে ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ও হলের ছাত্ররা সেই দলের রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে রাজনৈতিক দলের প্রভাব থাকা উচিত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দলের প্রভাবের কারণে অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলের প্রভাবে শিক্ষক ও ছাত্রদের দুরূহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যাচ্ছেন। যখন দেশে কোনো ক্রান্তিকাল আসে, তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে এমন ঘটনা দেখা যায়নি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এবারই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল। কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এত মানুষ মারা গেল, যা কখনো কেউ চিন্তা করেনি। সরকারের বোঝা উচিত ছিল ছাত্র আন্দোলন বড় আকার ধারণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতাই বলা যায়।
এখন দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এটা জাতীয় জীবনে বড় দুর্যোগের লক্ষণ। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকার কেন সমঝোতা করতে পারল না? কোটা সংস্কার আন্দোলন সমাধানযোগ্য ছিল। সরকার কেন ছাত্রদের ওপর বাহিনী নামিয়ে দিল এবং দেশে কারফিউ জারি করল?
সরকার ছাত্রদের এভাবে শান্ত করতে পারে না। সেনাবাহিনী ও পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের কেন শান্ত করতে গেল। রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান করা দরকার ছিল। বাহিনী দিয়ে কতদিন দেশ শান্ত রাখা যায়? সরকারকে রাজনৈতিকভাবেই সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমান সরকারি দল বেশ বড় এবং শক্তিশালী। তা ছাড়া বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের শক্তি একদমই ভেঙে পড়েছে। বিএনপি দেখতে অনেক বড় দল মনে হলেও আসলে তেমন শক্তিশালী নয়।
তারা ইতোপূর্বে সরকার হটানোর জন্য অনেক আন্দোলন করেছে। কিন্তু তাতে কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কাজেই জাতীয় রাজনীতির নিম্নগামিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ আছে, তাদের মধ্যেও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে জাতীয় সমস্যার রূপ নিয়েছে, তার সমাধান করা জরুরি। এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে দেশ চলতে পারে না। যারা দেশের বুদ্ধিজীবী আছেন, তারাও সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারছেন না।
আন্দোলনকে ঘিরে যখন দেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলল, তখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন যে, বিএনপি ও জামায়াত এসব কাজ করেছে। গণমাধ্যমে যা উঠে এসেছে, তাতে মনে হলো অন্য কোনো রহস্য আছে। এর ভেতরে দেশদ্রোহের ব্যাপার আছে, যারা এসব কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমান যে সংকট তৈরি হয়েছে তা সহজে নির্মূল হওয়ার নয়। এ ক্ষেত্রে বিশিষ্টজনেরা, বিভিন্ন বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থা এর উত্তরণে ভালো পরামর্শ দিতে পারবে। তবে সরকার খুব চেষ্টা করলে এই আন্দোলনের ভেতরের রহস্য বের করতে পারবে। সরকার রহস্য ভেদ করে সংকট মোকাবিলা করার পথ বের করতে পারে। সেই রহস্য জনগণকে জানাতেও পারে, নাও পারে।
সরকার দেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ দিয়ে জামায়াত, বিএনপির লোক গ্রেপ্তার করছে। দেশে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ তারাই করেছে বলে সরকার মনে করছে। তবে ছাত্ররা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে না। তাই অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছাত্রদের গ্রেপ্তার করায় দেশের বিপদ আরও বাড়বে।
ছাত্ররা কী চায়? তাদের পালস বুঝেই সরকারের সমাধানের পথ বের করতে হবে। ছাত্রদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল এবং সমাধানযোগ্য ছিল। এখন প্রশ্ন হলো- কেন এত মানুষ মারা গেল? এটা সামান্য কোনো বিষয় নয়। এ কারণেই এ হত্যার বিচার চেয়ে সারা দেশের মানুষ মাঠে নেমে গেছে। তবে এখনো সরকারের হাতেই নিয়ন্ত্রণ আছে। সরকার এই আন্দোলনের বর্তমান প্রেক্ষাপটের রহস্য বের করে সমাধান করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষকদের অনেক আগেই ছাত্রদের সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। তা হলে এতগুলো ছাত্রের প্রাণ যেত না। শিক্ষকরাই ছাত্রদের অভিভাবক এবং তাদেরই সর্বপ্রথম ছাত্রদের পাশে এগিয়ে আসা উচিত ছিল।
এত শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার ফলে ছাত্রদের অভিভাবকরা তাদের সন্তাদের নিয়ে অনেক চিন্তিত। মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন অভিভাবকরা। তাদের সন্তানরাও মানসিক ট্রমাতে ভুগছে। অভিভাবকদের মধ্যে তাদের সন্তান নিশ্চিন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে ব্যাপক সংশয় দেখা দিয়েছে।
সুস্থ রাজনীতি না থাকলে জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি লাভ করেছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কোনো উন্নতি লাভ করেনি। মানুষের সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সুস্থ রাজনীতি বিরাজ করতে হবে। বর্তমান রাজনীতিবিদদের মধ্যে সেই চিন্তা নেই।
আগের দিনে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ছিল, বর্তমানে তা নেই। বুদ্ধিজীবীদের এখন বিশিষ্ট নাগরিক বলা হয়। রাজনীতিবিদদের ভেতরেই শুধু সমস্যা তা নয়, বাইরে থেকেও কোনো কোনো শক্তি রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেকভাবে বুদ্ধি দিয়ে দেশকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এখন যেভাবে আন্দোলন চলছে তা সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে। তবে মনে হয়, এখন যে আন্দোলন হচ্ছে তা সরকারবিরোধী।
দেশের অর্থনীতি একদমই ভেঙে পড়ছে। অর্থনীতি ভেঙে পড়লে সেখানে সুস্থ রাজনীতি টিকে থাকা দায়। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একরকম ভালোই চলছিল।
কিন্তু সরকারি দল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর বেশি প্রভাব বিস্তার করে, তখন শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ থাকতে পারে না। দলীয়করণ এত বেশি বেড়েছে যে, শিক্ষার ভালো পরিবেশ আর নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কবে যে রাজনীতিমুক্ত হবে, তার কোনো লক্ষণ নেই। দেশের রাজনীতি যদি ঠিক না থাকে, তা হলে সবকিছুই ভেঙে পড়বে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত দেশগুলো কি কখনো চায় যে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ রাজনীতিতে সক্রিয় ও উন্নত হোক। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কেন এটা বুঝতে পারেন না। রাজনীতিবিদদের বাইরের পরামর্শ নিতে সজাগ থাকা উচিত।
অতএব এটা স্পষ্টভাবেই বুঝতে হবে যে, পশ্চিমা শক্তির দ্বারা এ ধরনের আন্দোলন পরিচালিত হয়ে থাকে। দেশীয় রাজনীতি বাইরের রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি ভারত, রাশিয়া ও চীন দ্বারা প্রভাবিত। ভারত বাংলাদেশের অনুকূল হয়ে সব সময় কাজ করে থাকে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো নিজেদেরই মোকাবিলা করতে হবে।
ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবারের নির্বাচনের সময় থেকেই বিরোধিতা করে আসছিল। এখনো ছাত্রদের সাধারণ আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক যদি সরকারের বিপক্ষে কাজ করে, তা হলে বাংলাদেশের রাজনীতি কি এগোতে পারে? বাংলাদেশের রাজনীতিকে জনগণের রাজনীতিতে পরিণত হতে বেশ কিছু সময় লাগবে। বাংলাদেশকে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে নিতে সরকার সহযোগিতা পাচ্ছে না।
জাতীয় নির্বাচনের আগে আমেরিকা আমাদের দেশের রাজনীতিতে কতভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এতেই অনুমান করা যায়, ছাত্রদের আন্দোলনের এই সুযোগ আমেরিকা কখনো হাতছাড়া করবে না। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হতো, তা হলে আমেরিকা কি এভাবে দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারত?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যেভাবে বাংলাদেশের ওপর কথা বলেছে, স্বাধীন দেশের সরকারকে তারা কি এভাবে কথা বলার অধিকার রাখে? এ জন্য দেশে সুস্থ রাজনীতির খুব দরকার।
দেশে সরকার পতনের আন্দোলন চলছে। দেশে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি দিয়ে কতদিন দেশ শাসন করা যায়। বর্তমান পরিস্থিতির সমাধান করতে হলে রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক দলকে নিজেদের দলীয় অবস্থান থেকে রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ