দীর্ঘদিন থেকে আমরা একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জীবনযাপন করছিলাম। ঘরের বাইরে শঙ্কা এবং ভীতি ছাড়াই যাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় শঙ্কা এবং ভীতি আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করছে। সার্বিকভাকে দেশ এখন চরম সংকটে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ব্যানারে একটার পর একটা দাবি-পাল্টা দাবি দিয়ে দেশে সংকট জিইয়ে রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন শুরু করেছিল, সেখানে অনেকেরই সমর্থন ছিল। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়েরও অনেকই এই আন্দোলনে একাত্ম হয়েছিলেন।
এখানে উল্লেখ না করলেই নয় যে, কোটা সংস্কার ইস্যুটি আদালতে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে আন্দোলন চলমান রেখেছিল। এমনকি আন্দোলনকারীরা দ্রুত কোটা সমস্যার সমাধান করতে সরকারকে চাপ দিতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি আদালতেই নিষ্পত্তি হবে। এমনকি আন্দোলনকারীদের আদালতের রায় পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে আহ্বান জানানো হয় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে।
তার পরও সরকারের অবস্থান এবং আন্দোলনকারীদের অবস্থানকে ঘিরে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিল- তারা হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের রাজাকার দাবি করে মধ্যরাতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কোনোভাবেই আন্দোলনকারীদের রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়নি। ধারণা করা হয়, কে বা কারা আন্দোলনটিকে নস্যাৎ করার এবং ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করে।
এর পরই বেশ কিছু ভুল বোঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর পরই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সব প্রতিশ্রুতি দেন। তার পরও আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে সরকারকে বিপাকে ফেলার অপচেষ্টা অব্যাহত থাকে। সারা দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভয়াবহ তাণ্ডব চালানো নয়। দেশ-বিদেশে ভুল এবং মিথ্যা তথ্য গুজব আকারে ছড়ানো হয়।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে সংঘর্ষে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে- তার জন্য পুরো দেশবাসী ব্যথিত। যেসব প্রাণ ঝরে গেছে তা কোনো দিনই পূরণ হবে না। যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন সেই আন্দোলনকে পুঁজি করে যে ধরনের সহিংসতা হয়েছে- সেটি আন্দোলনের কোনো ভাষা হতে পারে না। দেশের জনগণ কেউই আন্দোলনের নামে নাশকতা সমর্থন করে না। যারা এমন নিকৃষ্ট কাজটি করেছে তাদের প্রতি দেশবাসীর ঘৃণা থাকাটা স্বাভাবিক।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে এক ধরনের প্রতিযোগিতা থাকে। এমনকি এই প্রতিযোগিতাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তাই বলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে প্রতিযোগিতাকে প্রতিহংসা রূপ দিয়ে নাশকতা হতে পারে না। এখনো যে পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে তাতে সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে যাতে আর কোনো জানমালের ক্ষতি না হয় সেজন্য সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট ও সতর্ক রয়েছে। এখনো সীমিত আকারে কারফিউ চলছে দেশব্যাপী।
কোটা সংস্কারের মূল দাবি মেনে নেওয়ার পরও যখন শিক্ষার্থীদের একাংশ আন্দোলনে রয়েছে তাতে অনুমান করতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, ইতোমধ্যেই কোটা সংস্কার আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ লাভ করেছে। সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে নতুন নতুন দাবি নিয়ে ছাত্রসমাজের একাংশ নানা ধরনের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ এবং শঙ্কাও বেড়ে চলেছে। দেশের মানুষকে জিম্মি করে সরকার পতনের যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে- তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাম্য নয়।
এখন সাধারণ মানুষ বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে। কারণ কখন কোন সহিংসতা কিংবা নাশকতা আবার তৈরি হয়। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আমার কাছে মনে হয়েছে সরকারও এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। গত এক যুগ ধরে দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে, তার সুফল দেশবাসী আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে আসছিল।
সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের ভাবমূর্তি বিদেশেও অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। উন্নয়ন ও মর্যাদার প্রতীক মেট্রোরেল, সেতু ভবন, ডাটা সেন্টারসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর, হামলা এবং আগুন দেওয়ার ঘটনা পরবর্তীতে জনজীবেনে দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। সহিংসতায় যারা মারা গেছে বা আহত হয়েছে তারাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, দেশ এবং দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মেট্রোরেল স্টেশন এবং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির জন্য মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে রাজধানীতে যানজট বেড়েই চলেছে। মেট্রোরেল চালু হয়ে রাজধানীতে জনজীবনের চলফেরায় যে স্বস্তি ছিল সেটি এখন হারাতে চলেছে। ডাটা সেন্টার পুড়ে যাওয়ায় সারা দেশে ইন্টারনেট সার্ভিসে সংকট দেখা দিয়েছে। যথাযথভাবে এখনো পুরো নেটওয়ার্ক সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব পড়ছে, তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও এর প্রভাব অপূরণীয়। বাজারব্যবস্থা, দোকানপাট, ব্যবসাবাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া আতঙ্ক এবং সহিংসতার শঙ্কায় এবং জনগণের নিরাপত্তা বিবেচনা করে সারা দেশে নজিরবিহীনভাবে রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে দূর-দূরান্তে যাতায়াতে মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। অনেককে কষ্ট করে বাসে চলতে হচ্ছে। অথচ অনেকেই আছে যারা বাসে ভ্রমণ করতে পারে না। সেতু ভবনে আক্রমণ চালিয়ে সরকারি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এই সম্পদের ক্ষতি নিঃসন্দেহে দেশবাসীর ক্ষতি।
দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আমাদের সন্তানরা এখন বাসায় বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের। ছোট ছোট বাচ্চারা মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বাসায় বন্দি হয়ে ডিপ্রেশনে পড়ে গেছে।
বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে যে খ্যাতি পেয়েছিল- তা নিমিষেই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ যাচ্ছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। একটি মহল বাংলাদেশকে এখন বিশ্বের বুকে খাটো করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
একটি দেশের রাজনৈতিক বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে কোনো আন্দোলন জিইয়ে রাখার অপকৌশল পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রে হয় কিনা সেটি আমার জানা নেই। এই মুহূর্তে যেকোনোভাবেই দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া জরুরি। দেশের সাধারণ জনগণ জনজীবনে স্বস্তি নিয়ে আবার চলাফেলা করুক- এটি আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]