এক দুঃস্বপ্নের মতো সময় পার করেছে এবং এখনো তার জের টেনে চলছে দেশের মানুষ। কোটা সংস্কারের মতো নিরীহ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আর নিরীহ থাকেনি। ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে শত নিহত, হাজার হাজার গ্রেপ্তার এবং অগণিত আহত হয়েছে। এই ধরনের রাষ্ট্রীয় দমনের চিত্র এই ভূখণ্ডের মানুষ স্বাধীনতার আগে এবং পরে আর দেখেনি।
কারফিউ দিয়ে, সেনাবাহিনী নামিয়ে, বর্ডার গার্ড মোতায়েন করে, হাজার হাজার রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস ছুড়ে এক নারকীয় কাণ্ড চালিয়েছে সরকার। এমনকি হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করেও যখন ছাত্র-জনতাকে পিছু হটাতে পারেনি তখন সুট অ্যাট সাইট ঘোষণা করে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তারা। আর এখন ব্লক রেইড চালিয়ে রাতে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ছাত্র পরিচয় পেলেই। অবস্থা দেখে যে কেউ ধারণা করতে পারেন যে, দেশের জনগণের ওপর বিদেশি দখলদার বাহিনী আক্রমণ ও অত্যাচার চালাচ্ছে।
আন্দোলনকারী এবং সরকার উভয় পক্ষই বলেছেন, কোটা সংস্কারের দাবি যুক্তিসঙ্গত। তার পরও সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল কেন? এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসবে বারবার। কোটা সংস্কারের এই যুক্তিসঙ্গত আন্দোলন ২০১৩ সাল থেকেই ছাত্ররা করে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান থাকা সত্ত্বেও তাদের নাতি-পুতিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি।
প্রতি বছর শ্রমের বাজারে আসে ২২ লাখের মতো যুবশক্তি কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত। প্রায় ১০ লাখ কর্মপ্রত্যাশী চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে। যে নারী ঘরের বাইরে পা ফেলতে ভয় পেত সেই নারীদের প্রায় ১১ লাখ কাজ করছে এখন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। জীবনের ঝুঁকি, সম্মানের ঝুঁকি, প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কোনো কিছুই বিদেশে চলে যাওয়া রোধ করতে পারছে না বরং বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা ও সংখ্যা বাড়ছে। ফলে একদিকে তীব্র বেকারত্ব অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮ শতাংশের বেশি পূরণ না হওয়ার কারণে কোটা সংস্কারের দাবি যৌক্তিক বলে সবার কাছেই বিবেচিত হতে থাকে।
বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের হামলা ও পুলিশি অত্যাচার সত্ত্বেও এই আন্দোলন ক্রমেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ২০১৮ সালে প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ধরনের কোটা বাতিল করলে সমস্যা তো সমাধান হয়নি বরং নতুন জটিলতার বীজ রোপিত হয়েছিল। যা পরবর্তীতে হাই কোর্টে রিট এবং আদেশের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়। ফলে ২০২৪ সালে আবার আন্দোলন গড়ে উঠে।
এ বছর জুলাইয়ের ১ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকে এবং ক্রমাগত শক্তি অর্জন করে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উক্তিতে অপমানিত হওয়া এবং ওবায়দুল কাদেরের ছাত্রলীগ দিয়েই আন্দোলন মোকাবিলা করার মতো বক্তব্যের পর পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক থাকেনি। ছাত্রলীগকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে।
শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়, নারী শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা পরিচালনা করা হয় এবং আহত ও চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের ওপরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও আক্রমণ করে ছাত্রলীগকর্মীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও রাতের বেলা আন্দোলনরতদের ওপর হামলা হয়। এর বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের প্রবল প্রতিরোধে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এর পর ১৬ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ লাভ করে।
রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র এবং বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর যেন আগুন জ্বলে ওঠে ঢাকাসহ সারা দেশে। রাস্তায় আন্দোলনকারী, পথচারী, জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো শিশু, ছাদের ওপর বাবার কোলের শিশু এমনকি কার্নিশে ঝুলে থাকা শিশুও নিহত হয়েছে গুলিতে। এই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে সাঁড়াশি আক্রমণ পরিচালনা করা হলেও ছাত্র-জনতাকে আন্দোলন থেকে সরানো যায়নি। সারা দেশে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনী নামিয়ে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করেছে সরকার। ফলে নিভে গেছে কত সম্ভাবনাময় জীবন প্রদীপ, পঙ্গু হয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষ।
একদিকে নির্বিচার গুলি চলেছে রাস্তায়, নিহত আর আহত মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়েছে, হাসপাতালগুলো উপচে পড়েছে, অন্যদিকে রামপুরা টিভি সেন্টারে আগুন, ডাটা সেন্টার ধ্বংস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আগুন, মেট্রোরেলের স্টেশনে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কয়েকটা বিষয় ভাবনার উদ্রেক করে।
ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ থাকায় প্রতিদিন ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে, ব্যাংক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে, ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাস্তবে জানা গেল ডাটা সেন্টার ধ্বংস হয়নি, সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল। আর যেসব স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে সেগুলো রক্ষার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে যত নিষ্ঠুরতা লক্ষ্য করা গেছে, সম্পদ রক্ষায় ততটাই যেন নির্লিপ্ততা প্রত্যক্ষ করেছে জনগণ।
এই সময়কালে আর এক জঘন্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। হাসপাতাল থেকে আহতদের গ্রেপ্তার, ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আটকে রাখা ও নির্যাতন করা, তাদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে প্রেস কনফারেন্স করানো, তাদের খাওয়ানোর নামে মশকরা করা এবং ছবি প্রচারমাধ্যমে দিয়ে অপমান করা সবই করেছে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থা। ডিবি অফিসে কাউকে আটকে রাখার আইনি কোনো বিধান নেই। অথচ ডিবি অফিসে অহরহ এই কাজ চলে আসছে।
মানুষ তাহলে আস্থা রাখবে কী করে? আর সরকারি বক্তব্যকে মিথ্যাচার মনে করে প্রত্যাখ্যান করতে থাকলে তার পরিণতি ভালো হয় না কখনো। এতে সন্দেহ বাড়ে, গুজব ছড়ায় এবং সমাজে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কয়েকটি বিষয়, যেমন মৃতদের যে সংখ্যা সরকারিভাবে বলা হচ্ছে তা পত্রিকায় যে সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে তার সঙ্গে মিলছে না, কোনো মৃত্যুর সঙ্গে পুলিশের গুলির কথা উল্লেখ না থাকা খুবই রহস্যময় ঘটনা। পুলিশের গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে নিহত সাঈদকে আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেলের আঘাতে মৃত্যু বলে রিপোর্ট দেওয়া।
অন্যদিকে গণভবনে নিহতদের নির্বাচিত স্বজনদের মধ্যে চেক বিতরণের ফলাও প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু টাকার চেক দিয়ে রক্তের দাগ কিংবা চোখের জল কি মোছা যাবে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ক্ষমতার সিঁড়ি বানানো, সহানুভূতি দেখিয়ে সন্ত্রাসকে আড়াল করা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা দীর্ঘদিনের দাবি। এখন ক্ষমতায় থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ করে জনসমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
দুর্নীতি, লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র দেখে এবং দ্রব্যমূল্য এবং জনজীবনের সংকটে দিশাহারা মানুষ একটু স্বস্তি চায়। কিন্তু অর্থনীতিতে লুটপাট, রাজনীতিতে দমন-পীড়ন, সংস্কৃতিতে অধঃপতন থাকলে স্বস্তির আশায় গুড়ে বালি মনে হবে। ফলে অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে গুলিবর্ষণকারীদের চিহ্নিত করা, আন্দোলন দমনের ও হামলার উসকানিদাতাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নিহত-আহতদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, গ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিবেশ তৈরি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের একটি গণতান্ত্রিক দেশ নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে আন্দোলন থেমে যাওয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। যে সংকট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল সেই সংকট দূর না হলে আবার জ্বলে উঠতে সময় লাগবে না। এই বিষয়টা যেন সরকার ভুলে না যায়।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]