বিশ্বে এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। প্রথম শিল্পের বৈশিষ্ট্য ছিল রেলপথ, বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার ও উৎপাদনে যন্ত্রের ব্যবহার। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব শুরু হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন দিয়ে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব যাকে কম্পিউটার বা ডিজিটাল বিপ্লবও বলা যায়। ক্ষুদ্র ও শক্তিশালী সেন্সর, মোবাইল ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং চতুর্থ বিপ্লবের মূল শক্তি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গুণগত পার্থক্য আছে, এ বিপ্লবে মেশিনকে বুদ্ধিমান করা হয়েছে। অন্য বিপ্লবে যন্ত্রকে ব্যবহার করেছে মানুষ আর এ বিপ্লবে যন্ত্র নিজেই নিজেকে চালানোর সক্ষমতা অর্জন করছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে যন্ত্রকে বুদ্ধিমান করা হচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে যন্ত্রের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি এবং প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা অনেক দ্রুত। ইন্টারনেটের কারণে এর কার্যক্রমের আওতা অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে।
শিক্ষার আরও একটি কাজ হলো মানুষকে আলোকিত করা, আলোকিত সমাজ গঠন করা। আবার অনেক অশিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে আমরা শিক্ষিত একজন মানুষের চেয়েও বেশি মেধা ও মননশীল গুণাবলি খুঁজে পেতে পারি। পৃথিবীতে অনেক মনীষী আছেন, যারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেননি। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রথাগত যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তাতে প্রকৃত সৃজনশীল প্রতিভাধর মানুষ তৈরি হচ্ছে খুব কম। এর মূল কারণ হচ্ছে, মননশীলতা ও উন্নত চিন্তাধারা সৃষ্টির বিষয়টিকে পুরোপুরি অবহেলা করা হয়েছে বা কম গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন, তা হলো শিক্ষা যে গবেষণার বিষয় হতে পারে সে ধরনের মনোভাব এখন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে খুব একটা গড়ে ওঠেনি বা এই প্রবণতা খুব একটা তৈরি হয়নি।
তারুণ্য হলো মানুষের জীবনে সাহস, সংগ্রাম ও সৃজনশীলতার সময়। পুরোনো ভেঙে সংস্কার করে নতুন কিছু করা যেন তারুণ্যের ধর্ম। সমাজের এই সংস্কারকাজে তরুণসমাজকে সাহস ও সততার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরা সমাজের সর্বস্তরে পরিবর্তনের কাজ শুরু করবে এবং এ ক্ষেত্রে তরুণ সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই সবচেয়ে কার্যকর।
সমাজে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি দেখলে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিবাদ যদি তরুণসমাজের কাছ থেকে আসে, তাহলে তা কেউ ঠেকাতে পারবে না। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। শিক্ষা হতে হবে মানসম্মত। আর দেশে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার পরও শিক্ষা খাতে দুর্নীতির ভূত বারবার গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
শিক্ষানীতির খণ্ডিত বাস্তবায়ন ও শিক্ষা আইন প্রণয়নে অস্বাভাবিক ধীরগতি সেই ঘটনাগুলোকেই বারবার উসকে দেয়। শিক্ষা খাতে দুর্নীতি, জাতিকে মেরুদণ্ডহীন করার অপচেষ্টার শামিল। শিক্ষা নিয়ে আর হেলাফেলা করার দিন নেই। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
একটি জাতি শিক্ষায় যত উন্নত, সে জাতির উন্নতির মাত্রাও তত বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস না করে, তাদের সঠিকভাবে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার, সেখানে শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি পিতামাতার দায়িত্ব রয়েছে, নাগরিক সমাজের ভূমিকা রয়েছে, তেমনি প্রশাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আমরা সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার কথা বললেও বাস্তবে তা কতটা কার্যকর হচ্ছে, সে বিষয়ে আমাদের কোনো ধরনের গবেষণা নেই। ফলে লেখাপড়ার চাপে পড়ে একজন শিক্ষার্থী তার পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শিক্ষা ও জ্ঞানের আরও উপাদান রয়েছে, তা তার অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। ফলে তার মধ্যে কল্পনাশক্তির বিষয়টি গৌণ হয়ে যাচ্ছে।
আর যখন কল্পনাশক্তি তৈরি হচ্ছে না, তখন প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ তৈরির বিষয়টি মুখ্য না হয়ে গৌণ হয়ে পড়ছে। ফলে উন্নত ও উদার চিন্তাধারা না থাকায় একধরনের আজগুবি চিন্তাধারার যান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠছে। এর প্রধান কারণ শিক্ষার্থীর প্রকৃত ও নিজস্ব কল্পনা এবং চিন্তাশক্তি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে না।
আজকের তরুণসমাজই ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক। তারা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সমাজ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করবে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সব কল্যাণমূলক কাজে যুবসমাজের অংশগ্রহণ আবশ্যক। তরুণসমাজ ঘুমিয়ে থাকলে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সমাজের আকাশ থেকে কখনো কালো মেঘের ছায়া সরবে না। সমাজ পরিবর্তন করতে হলে তরুণসমাজকে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি দেশ ও সমাজের কথাও ভাবতে হয়। সব সমাজকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসতে হবে। যৌবন অসীম প্রাণশক্তির উৎস। সে জন্য তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে গতিশীল ও প্রতিশ্রুতিশীল করতে হবে। জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থা সংস্কার করে নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য প্রথমে তরুণসমাজকে জেগে উঠতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবেই সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব। তারুণ্যের শক্তিই পারে সমাজকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
কিন্তু তরুণদের বেকারত্বকে অর্থনীতির জন্য একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের নীতিমালায় অনুপস্থিত। জাতীয় যুবনীতি তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যে ঘোষণা করেছে তার নিরিখে কাজ করতে হবে।
নীতিমালায় তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা রয়েছে, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। অবশ্য অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান বেশি হওয়ায় কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হতে হবে বেসরকারি খাতকে। সেখানে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারকে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে।
আমরা শিক্ষা পেয়ে তরুণদের দক্ষ কর্মী হিসেবে দেখতে চাই, আমরা বেকারত্বের অভিশাপ দেখতে চাই না, তরুণদের হতাশ দেখতে চাই না, আমরা উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চাই। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। এ জন্য সব সময় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে।
বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় একটি কার্যকর উপায় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং অন্যান্য কর্মশক্তির বিভিন্ন বিভাগের জন্য চাকরি তৈরি করে। চাকরির সংখ্যা, তাদের ধরন এবং কোন সেক্টরে চাকরি তৈরি করা হবে, তার একটি চিত্র থাকতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো
[email protected]