গণ-আন্দোলন বা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন কোনো স্বৈরতন্ত্র উৎখাত হয়, তখন তার সুযোগ নেয় কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ। গত ৫ আগস্ট আচমকাই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং দেশ ছাড়ার খবর আসে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঠিক পরপরই কয়েক ঘণ্টা কার্যত কোনো আইনের শাসন ছিল না। আন্দোলনকারীরাও সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সেনাবাহিনীও অপ্রস্তুত ছিল।
সেই রাতে লুটপাট হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। আবার জনগণের উদ্যোগেই বহু মন্দিরের বাইরে পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে। অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব যারা দিয়েছেন, তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেন। রাতের মধ্যেই আন্দোলনের প্রধান শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ যাবতীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। যেমন নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি অকার্যকর। দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবই দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এগুলো সবই সরকারের আদেশক্রমে চলত। এগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি।
প্রকৃতপক্ষে গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়কে কলঙ্কিত করার মতো বেশ কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার লোকজন দেশে রয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থানের পর শূন্যতার সুযোগে নৈরাজ্য, লুটপাট, সাম্প্রদায়িক হামলা দেখা যাচ্ছে- এসব হামলা ও নৈরাজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রথমত, যারা বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগের দ্বারা অত্যাচারের শিকার হয়েছেন।
মার খেয়েছেন। তারা পাল্টা মার দিতে গিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, সুযোগসন্ধানী মানুষ, যারা এই সুযোগে লুটপাট করতে চেয়েছেন। তৃতীয়ত, সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিবাদী শক্তি, যারা পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করেছে। ভাস্কর্য ভেঙেছে।
ইতোপূর্বে আমরা অনেক গণ-অভ্যুত্থান দেখেছি। এবারের অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো কোনো রাজনৈতিক দল এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়নি। আগের যেকোনো গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাই এবারের গণ-অভ্যুত্থানের পার্থক্য আছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে ছিল রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থিদের তিন জোট। তারা তিন জোটের রূপরেখা দিয়েছিল।
কিন্তু তিন জোটের রূপরেখার অংশীদার সবাই পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় গিয়ে রূপরেখাবিরোধী কাজ করেছে। এবারের গণ-অভ্যুত্থানে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছিল না। নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দলীয় পরিচয় নেই; ঘোষিত কিছু আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য আছে।
সেখানে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা আছে। পাশাপাশি এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে অনেক শিক্ষক এসে দাঁড়িয়েছেন, সাংবাদিকরা দাঁড়িয়েছেন, আইনজীবীরা দাঁড়িয়েছেন, লেখক, শিল্পী, অভিভাবক, শ্রমিক সবাই এসেছেন। এটি তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী।
এই গণ-অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ। সর্বজনের বাংলাদেশ নির্মাণ। সমস্যা হলো, যে রাজনৈতিক দলগুলো এই আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, তারা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার যাতে গণ-অভ্যুত্থানের এই আকাঙ্ক্ষার দিকে অগ্রসর হয়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রয়েছে, বাস্তবে বরাবর তারা এর বিপরীত কাজটিই করেছে। ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠী ও রাজনীতির সঙ্গে নানা মাত্রায় সমঝোতা করেছে। দেশজুড়ে জমি দখল, বনাঞ্চল দখলের মতো কাজ তারা করেছে। বিপুল পরিমাণে হিন্দুদের জমি, সম্পদ তারা দখল করেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আবার হাসিনার পদত্যাগের পরের সন্ধ্যা এবং রাতেও হামলার শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ নিয়ে গড়পড়তা ভারতীয়দের ধারণা অস্বচ্ছ। এর জন্য আমি ভারতের মূলধারার মিডিয়াকে দায়ী করব। কেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বর্তমানে ভারত রাষ্ট্রের প্রতি বিক্ষুব্ধ, সে-সংক্রান্ত আলোচনা ভারতীয় মিডিয়ায় আসে না। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয়রা বিষয়গুলো জানতেই পারেন না।
নিশ্চয়ই সাম্প্রদায়িকতা একটি বড় সমস্যা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে লড়াইও আছে। সাম্রাজ্যবাদী লুটপাট, সম্পদের কেন্দ্রীভবনের মতো সমস্যাও বাংলাদেশের বড় সমস্যা। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের যা ক্ষতি হয়েছে, তা আর কেউ করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের নাম করে জনগণের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছে আওয়ামী লীগ।
মুক্তিযুদ্ধের নামে লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখল, জুলুমে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনগণের একাংশ বীতশ্রদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছেন? এই দেশের সাধারণ মানুষ। কজন আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন? তারা ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। এই দেশের মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন করেছেন। তাই আমি বারবার করে বলি, মুক্তিযুদ্ধকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের হাতে নিয়ে আসতে হবে।
আরও ঝুঁকির কথাও মনে রাখতে হবে। গত কয়েক দশকে, বিশেষত গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে একটি খুবই অতি ধনী ক্লাস তৈরি হয়েছে। মানে বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে যাদের হাতে এবং এরা স্বৈরতন্ত্রের সুবিধাভোগী। এরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য বড় ধরনের হুমকি।
পাশাপাশি সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে যেভাবে সাজানো হয়েছে; দলের স্বার্থে কিংবা লুণ্ঠনজীবীদের স্বার্থে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে; ক্রসফায়ার, গুম, খুন- এগুলো যেভাবে হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর জন্য বড় ধরনের হুমকি।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তিও স্বৈরতন্ত্রের বিশেষ সুবিধাভোগী। আমি সব সময় বলেছি, বাংলাদেশে সরকারের মধ্যে বিভিন্ন লবি থাকে; মার্কিন লবি, চীন লবি, রাশিয়া লবি, ইন্ডিয়ান লবি তো খুবই শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশ লবিটাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই আন্তর্জাতিক সুবিধাভোগী গোষ্ঠী কিংবা স্বার্থগোষ্ঠী, তারাও গণতান্ত্রিক রূপান্তরে আমাদের জন্য বড় ধরনের হুমকি। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ, কৌশলগত স্বার্থ, এই অঞ্চলে আধিপত্য রাখার স্বার্থ বাস্তবায়ন করতে অগণতান্ত্রিক শক্তি প্রয়োজন হয়। এটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে।
তার মানে গত কয়েক দশকে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বিপুল ধনিক শ্রেণি, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, আন্তর্জাতিক লবি- এই তিন গোষ্ঠী সম্পর্কে সতর্ক না থাকলে কিংবা তাদের এজেন্ডার অধীন হয়ে গেলে গণতান্ত্রিক রূপান্তর বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। আশা করি, এসব বিপদ ও ঝুঁকি সম্পর্কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ও তরুণসমাজ সতর্ক থাকবেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথর থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। সেই আনন্দকে ম্লান করে দিয়ে যারা হিন্দু, আহমদিয়াসহ বিভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর, মন্দির, প্রার্থনাস্থল, বিভিন্ন তরিকার মাজার আক্রমণ করছে, আগুন দিচ্ছে; যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য ভাঙছে, জাদুঘরে আগুন দিচ্ছে; যারা রাহুল আনন্দসহ শিল্পীদের ওপর হামলা করছে এবং তার হাজারও অমূল্য বাদ্যযন্ত্র ভাঙছে; যারা নির্বিচারে মানুষের জীবন বিপন্ন করছে, তারা এই গণ-অভ্যুত্থানের শত্রুপক্ষ।
এদের প্রতিরোধ করতে হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উদ্যোগকে শক্তিশালী করুন। আমরা লুটেরা, দখলদার, খুনি, নির্যাতকদের দ্রুত বিচার ও শাস্তি চাই এবং সব নাগরিক ও সৃজনশীল কাজের নিরাপত্তা চাই।
লেখক: শিক্ষাবিদ