ঢাকা ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সংকট

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৪, ১১:৪৮ এএম
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সংকট
নেহা কুমার

ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলোর এক সূচকে দক্ষিণ এশিয়াকে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল অঞ্চল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে সর্বাধিকসংখ্যক ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং এখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভেঙে পড়েছে। 

প্রতিটি রাষ্ট্রেই গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। ভৌগোলিকভাবে এ দেশগুলো খুবই কাছাকাছি এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাস প্রায় একই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো জটিল সংকটের মুখোমুখি, যা জরুরিভাবে সমাধান করা দরকার।

ভারত এসব দেশের ওপর আঞ্চলিক শক্তি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অশান্তির মূল কারণগুলো বোঝা এবং তার সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা বন্ধুত্বহীন শাসনব্যবস্থা স্থাপনের সম্ভাবনা ভারতের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। 

দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় জাতিগত এবং ধর্মীয় সমস্যা বিরাজমান। এ ছাড়া শক্তিশালী রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। 

পশ্চিমা দেশগুলোর ঔপনিবেশিক শাসনের সময় এই দেশগুলো তাদের সামাজিক কাঠামো তৈরি করতে অনেক সংগ্রাম করেছে। শ্রীলঙ্কার ‘অভিজাত শাসনের’ প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সিংহলি এবং তামিলদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা।
এই পদ্ধতিটি ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ফলে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। 

একইভাবে সামরিক শাসন এবং গণতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে বাংলাদেশের ঘন ঘন পরিবর্তন হওয়ায় দেশের রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা তুলে ধরেছে। সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, জনগণ ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ‘দ্য অরিজিন অব পলিটিক্যাল অর্ডার’ এবং ম্যাকিয়াভেলির ‘অবজারভেশন অব গভর্ন্যান্স ইকো’ চ্যালেঞ্জগুলো যেভাবে সমাধান করা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতিতে তা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

এই অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি, ভাষাগত গোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর বিভেদের কারণে রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকে জটিল করে তোলে। চলমান জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাতগুলো জাতীয় পরিচয় এবং শাসন কাঠামো তৈরিতে আরও বাধা সৃষ্টি করেছে। 

দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলগুলো কার্যকর গণতন্ত্র আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অঞ্চলে পদ্ধতিগত গণতন্ত্রের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও সমতা নিশ্চিত করার পরিবর্তে প্রক্রিয়া তৈরিতে বেশি সময় ব্যয় করে। যদিও গণতান্ত্রিক আদর্শ সংবিধানে নিহিত রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। 

ইসলামিক মতাদর্শে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান রয়েছে। কিন্তু ভারতে ‘হিন্দুত্ববাদ’ বিরাজমান। এ মতাদর্শগত ভিন্নতা আঞ্চলিক বৈষম্য এবং সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, যা গণতান্ত্রিক ধারা এবং অনুশীলনের মধ্যে গভীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকরী আঞ্চলিক কাঠামোর অভাব রয়েছে।

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) আন্তরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব প্রশমিত করতে বা আঞ্চলিক একীকরণকে উন্নীত করতে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর দ্বিপক্ষীয় বিরোধ, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের ঐতিহাসিক এবং আঞ্চলিক বিরোধ, যা সম্মিলিত আঞ্চলিক অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। 

অধ্যাপক হ্যাপিমুন জ্যাকব তার প্রবন্ধ ‘দ্য অ্যান্ড অব সাউথ এশিয়া’য় খুব সুন্দরভাবে এশিয়ার সংযোগবিচ্ছিন্নতা তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ খুব কমই তাদের আঞ্চলিক পরিচয় দেয়। ‘দক্ষিণ এশিয়া’ শব্দটিকে একীভূত সত্তার চেয়ে ভৌগোলিক পরিমাপ হিসেবে সবাই বেশি দেখে।

এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দিতে হবে। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা বহিরাগত দেশের দেওয়া সমাধানের ওপর নির্ভর করা শুধু জটিলতা বাড়ায়। স্থিতিস্থাপক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, প্রকৃত গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করা এবং আঞ্চলিক সংহতি বৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যৌথ প্রচেষ্টা অপরিহার্য।

বিশ্বব্যাংক এই অঞ্চলটিকে একটি সম্ভাবনাময় জায়গা হিসেবে তুলে ধরেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা শুধু টেকসই শান্তি এবং সহযোগিতামূলক শাসনের মাধ্যমেই সম্ভব। 

যেহেতু দক্ষিণ এশিয়া এখন জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, সেহেতু এই অঞ্চলের নেতাদের নিজস্ব শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্ধারণ করতে হবে। আঞ্চলিক নেতৃত্বের সুযোগ এবং দায়িত্ব উভয়ই গ্রহণ করে তাদের গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সময় এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত অধ্যয়ন বিভাগ; শ্রী বালাজি বিশ্ববিদ্যালয়, পুনে, ভারত। দ্য স্টেটস্ম্যান থেকে সংক্ষেপিত 
অনুবাদ: সানজিদ সকাল

ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি: চাই ইউরোপ ও চীনের ঐক্য

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ পিএম
ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি: চাই ইউরোপ ও চীনের ঐক্য

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের বিপক্ষে ইউরোপীয়দের অস্বীকৃতি এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের হাতে চলে গেছে। ইউরোপীয় নেতাদের ট্রাম্পকে বিচ্ছিন্ন, আমেরিকান আগ্রাসন রোধ এবং বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। 

বিশ্বের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপথগামী বাণিজ্যযুদ্ধ তার রাজনৈতিক আধিপত্য এবং ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (MAGA) আন্দোলন উভয়ের জন্যই সমাপ্তির সূচনা হতে পারে। যদি জার্মানি এবং ইউরোপ শক্তিশালীভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াকে ভালোমতো সমন্বয় করতে পারে, তাহলেই সম্ভব। 
ইউরোপীয় কমিশন এবং বিদায়ি জার্মান সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ট্রাম্পের দাবি মেনে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা। বিশেষ করে তার অর্থনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক বিজয়ে পরিণত করা। এখনই স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, ট্রাম্পকে খুশি করা কেবলমাত্র বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থার পতনকেই বাড়াবে এবং বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক শাসনকে আরও দুর্বল করবে।

ট্রাম্প প্রশাসন (যা বহুপক্ষীয় বাণিজ্য আদেশ ভেঙে ফেলতে চায়) বা চীন (যা এটি সংরক্ষণ করতে চায়) বিজয়ী হবে কি না তা নির্ধারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় নেতারা সুস্পষ্ট পছন্দের পক্ষপাতি। তারা বহুপক্ষীয়তার পক্ষে দাঁড়ান এবং চীনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যান। তাদের তৃতীয় কোনো বিকল্প নেই। এই সংঘাতে জার্মানি ও ইউরোপ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি অনুসরণ করে ট্রাম্পের দাবি মেনে নেওয়া বহুপক্ষীয়তার অবসানকে সমর্থন করার সমতুল্য হবে।

ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে ইইউর ব্যর্থতা মর্মান্তিক অদূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। যদিও ইউরোপে ট্রাম্পের শুল্কের সরাসরি অর্থনৈতিক প্রভাব অনেকটা কম থাকবে। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি ফল বিশেষ করে জার্মানির রপ্তানির মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক মডেলের জন্য ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে। ট্রাম্পের কাছে নতি স্বীকার করলে জার্মানের সমৃদ্ধির ভিত্তিকে নাড়া দেবে। এতে বৈষম্যহীন, ন্যায্যতা এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে উন্মুক্ত বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর অন্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। 
জার্মানি এবং ইইউ কীভাবে ট্রাম্পের শুল্কের প্রতিক্রিয়া জানাবে? আগত জার্মান সরকার, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ইউরোপীয় অংশীদাররা চীনের সঙ্গে মিলে এবং আমেরিকান পণ্যের ওপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করে বহুপক্ষীয়তাকে রক্ষা করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যতের আলোচনায় ইউরোপীয় নেতাদের অবশ্যই দুটি মূল শর্তের ওপর জোর দিতে হবে। প্রথমত, তাদের বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বহুপক্ষীয়তার প্রতি নতুন করে অঙ্গীকারের আহ্বান জানানো উচিত। এর মধ্যে কেবলমাত্র প্রাক-সংকটের সময়ে শুল্ক এবং অন্য বাণিজ্য বাধাগুলো ফিরিয়ে দেওয়াই নয় বরং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মতো বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানকে পুনরুজ্জীবিত করা। যুক্তরাষ্ট্র তার আপিল সংস্থায় নতুন বিচারক নিয়োগে বাধা দিয়ে পদ্ধতিগতভাবে অবমূল্যায়ন করেছে।

WTO সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়। অন্যান্য বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান যেমন জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংককে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের ক্ষমতা দিতে হবে। বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের দুর্বলতম অর্থনীতির দেশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব ও সুরক্ষার জন্য। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের উচিত ন্যায্য প্রতিযোগিতা এবং সাধারণ নিয়মগুলোর ওপর চাপ দেওয়া, বিশেষ করে যখন এটি মার্কিন-ভিত্তিক প্রযুক্তি জায়ান্টগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আসে। কারণ তারা নিয়মিতভাবে ডেটা সুরক্ষা, নৈতিক মান এবং বাজার প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত EU আইন ও প্রবিধান লঙ্ঘন করে থাকে।

সাম্প্রতিক সময়ে গুগল প্রকৃতপক্ষে অনুসন্ধানে অবৈধভাবে একচেটিয়া অধিকার তৈরি করেছে, তা ইস্যুটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয় যুক্তরাষ্ট্রের আদালত। জার্মানির অর্থমন্ত্রী জর্গ কুকিস পর্যবেক্ষণ করেছেন, ইউরোপীয় দেশগুলো মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের দেওয়া পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যদি ইইউ এখন কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই ক্ষতিকারক প্রভাব আরও গভীর হতে থাকবে। এতে ইউরোপকে ট্রাম্পের নীতির কারণে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।

বিশ্বব্যাপী ভারসাম্যহীনতা সংশোধন করতে এবং বহুপক্ষীয়তাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীন, ইইউ ও জার্মানির কাছ থেকে অর্থপূর্ণ ছাড় এবং সংস্কারেরও প্রয়োজন হবে। অভ্যন্তরীণ সংস্থাগুলোর জন্য ব্যাপক ভর্তুকি এবং অন্যান্য সহায়তার মাধ্যমে অন্যায্য সুবিধা অর্জনের জন্য চীন বারবার বহুপক্ষীয় নিয়মগুলোকে ক্ষুণ্ন করেছে। কিন্তু জার্মানিকে অবশ্যই তার নিজস্ব বিশাল চলতি উদ্বৃত্ত কমাতে হবে, যা মূলত দেশীয় প্রবিধান এবং অন্যান্য কাঠামোগত বাধার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এতে বিদেশি কোম্পানিগুলো তার বাজারে প্রবেশ করা কঠিন করে তোলে। এ বিকৃতিগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে যথেষ্ট সুবিধা দিতে পারে। এরকম একটি সুষম বাণিজ্য চুক্তি ট্রাম্পের কাছে আবেদন করতে পারে এবং তাকে পথ পরিবর্তন করতে উৎসাহিত করতে পারে বলে বিশ্বাস। 

অর্থনৈতিক খরচ সত্ত্বেও ট্রাম্পের বৈশ্বিক শুল্কযুদ্ধ ইউরোপকে বহুমুখী বিশ্বে একটি মধ্যস্থতাকারী এবং বহুপক্ষীয়তার রক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এখন সময় এসেছে, ইউরোপ তার মূল্যবোধের জন্য দাঁড়িয়েছে। চীন, কানাডা, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের মতো অংশীদারদের সঙ্গে একীভূতভাবে প্রতিক্রিয়া সমন্বিত করেছে। একযোগে বিশ্বের সব প্রধান অর্থনীতির সঙ্গে সংঘর্ষের উসকানি দিয়ে ট্রাম্প গুরুতর কৌশলগত ভুল করেছেন। হয়তো স্বল্পমেয়াদে ইউরোপকে অনেক ব্যয় করতে হবে। তবে ট্রাম্পকে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার অনুমতি দেওয়া ইইউ অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হবে। 

লেখক: জার্মান অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ম্যাক্রো ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগ
হামবোল্ট ইউনিভার্সিটি, বার্লিন 
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

রানা প্লাজা: বিচার হবে কতদিনে?

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩০ এএম
রানা প্লাজা: বিচার হবে কতদিনে?

২০১৩ সালে রানা প্লাজা নামে একটি ভবন ধসে ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন, আহত হয়েছিলেন ২ হাজার ৫০০ শ্রমিক। এ ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল দেশে-বিদেশে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন অনেকেই। তাদের টাকায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কিন্তু দায়ীদের বিচার এবং শাস্তি হয়নি এখনো। ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১২ বছর পার হয়েছে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কারখানা দুর্ঘটনা হিসেবে রানা প্লাজা ভবন ধসকে বিবেচনা করা হলেও তা থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়েছে কতটুকু, তা এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।

 এই ভয়াবহ কাঠামোগত হত্যার মাত্র পাঁচ মাস আগেই ২০১২ সালে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে জীবন হারিয়েছিলেন ১১২ জন। তার দগদগে স্মৃতি মন থেকে মুছে যেতে না যেতেই রানা প্লাজা ভবন ধস শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীকেই নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু ১২ বছর পর হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এ ঘটনা যতটা আবেগকে নাড়া দিয়েছিল ততটা দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করেনি সংশ্লিষ্ট কাউকে। ফলে ২০১৬ সালে টাম্পাকো এবং ২০১৭ সালে মাল্টি ফ্যাবস কারখানা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ছোট-বড় নানা ধরনের দুর্ঘটনা যেমন ঘটেই চলেছে, তেমনি বড় দুর্ঘটনারও বিরাম নেই। ২০২১ সালের জুলাই মাসের ৮ তারিখে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লেগে ৫২ জনের মৃত্যু মনে করিয়ে দেয় সস্তা শ্রমিকের জীবনটাও কত অবহেলার। 

বাংলাদেশে যেসব শিল্পকারখানা/প্রতিষ্ঠানে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে (যেমন- সারাকা গার্মেন্টস, স্পেকট্রাম গার্মেন্টস, রানা প্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টস, টাম্পাকো ফয়েলস, এফআর টাওয়ার, বিএম ডিপো, সজীব ফুডস, নিমতলী ট্র্যাজেডি, বেইলি রোড ট্র্যাজেডি, এসএন কর্পোরেশনের গ্রিনইয়ার্ড ইত্যাদি) এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তদন্ত করা হয়েছে, তার প্রতিবেদন কখনই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতিসংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ও পরিসংখ্যানসহ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তা অন্ধকারে রয়ে গেছে।

রানা প্লাজা ভবন ধসের পর কিছু প্রশ্ন উঠেছিল। এসব দুর্ঘটনা কি নিছক দুর্ঘটনা নাকি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড? দুর্ঘটনাগুলো কি আকস্মিক নাকি অনিবার্য ছিল? কেউ কি এর দায় নেবে না? বাংলাদেশে চাইলেই কি কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা যায়? প্রায় ১৭টি প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করা যায় না। ফ্যাক্টরি প্লান পাস করাতেই তো জমির কাগজপত্র লাগে, সাইট প্লান, মাস্টারপ্লান লাগে, কনস্ট্রাকশন প্লান লাগে, মেশিন লে আউট ও ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্লো চার্ট লাগে। তাহলে ভবন ধসের পর সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, ভবন নির্মাণের অনুমতি দেন যারা তারা কি দায়িত্ব পালন করেছিলেন? কারখানা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কি নিয়মিত পরিদর্শন করা হয়? এখানে দুর্নীতি না দায়িত্বহীনতা- কোনটা প্রধান সমস্যা? নাকি দুর্নীতির কারণেই নিয়ম থাকা সত্ত্বেও দায়িত্বে অবহেলা করা হয়েছিল? 

আইন নাগরিককে সুরক্ষা দেয়। প্রশ্ন ওঠে সেখানেও। আইন কোন ধরনের নাগরিককে সুরক্ষা দেয়? ক্ষমতাবানের ক্ষমতার সুরক্ষা নাকি দুর্বলের ন্যূনতম অধিকারের সুরক্ষা? একটি অপরাধ বা অন্যায়ের শাস্তি হলে যেমন অপরাধপ্রবণতা কমতে থাকে, তেমনি অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল স্পেকট্রাম কারখানার ভবন ধসে ৮০ জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর যদি কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিত তাহলে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার দুঃখজনক ঘটনা হয়তো ঘটত না। 

দেশের জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে। এই আয় বৃদ্ধিতে শ্রমজীবীদের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তাদের প্রতি দায়িত্ব প্রতি পদে পদে অস্বীকার করা হচ্ছে এমনকি কর্মক্ষেত্রে নিহত বা আহত হওয়ার পরেও। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৮৪ ডলার হিসেবে একজন শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত যেকোনো বয়সী নাগরিকের আয় বার্ষিক ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার বেশি। আর উৎপাদনের চাকা ঘোরান যারা, তাদের জীবনের চাকা থেমে গেলে ক্ষতিপূরণ ২ লাখ টাকা। শ্রমিকের জীবন নিয়ে একি তামাশা নয়? এই তামাশা এক সময় বিয়োগান্তক বেদনা ও অপমানে পর্যবসিত হয় যখন সেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্যও বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। 

রানা প্লাজা ভবন নির্মাণ হয়েছিল অবৈধভাবে, ফাটল দেখা যাওয়ার পর শ্রমিকরা কাজে যেতে চাননি, তাদের জোর করে কাজে পাঠানো হয়েছে। শ্রমিকরা চাকরি হারানোর ভয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন। ভবনে জেনারেটর নিয়মানুযায়ী স্থাপন করা হয়নি। ভবন ধসের পর বিরোধী দলের কর্মীরা পিলার ধরে ঝাঁকি দিয়েছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন। পাঁচটি কারখানায় প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন কিন্তু কোনো ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না সেখানে- এসব তথ্য কী প্রমাণ করে? শ্রম দপ্তর, পরিদর্শন দপ্তর এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি কেউ কি তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন, দায় এড়াতে পারবেন কি কেউ? 

দেখা গেছে, ২৯টি ব্র্যান্ড রানা প্লাজায় অবস্থিত পাঁচটি ফ্যাক্টরিতে তৈরি পোশাকের অর্ডার দিত। তাদের কি কোনো দায় ছিল না কর্মপরিবেশ দেখার ব্যাপারে? একটা হিসাব দাঁড় করিয়েছিল ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন নামের একটি সংস্থা। তারা দেখিয়েছে, একটি টি-শার্টের বিক্রয় মূল্যের মাত্র দশমিক ৬ শতাংশ পান শ্রমিক অর্থাৎ ১০০ টাকার টি-শার্টে শ্রমিকের প্রাপ্তি মাত্র ৬০ পয়সা। কারখানা মালিক ৪ শতাংশ পান লাভ হিসেবে, ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা ব্র্যান্ড পায় ১২ শতাংশ আর ইউরোপ-আমেরিকার বিক্রেতা পান ৫৯ শতাংশ। শ্রমিকরা রক্ত পানি করা শ্রমে মুনাফা জোগান দেশি-বিদেশি মালিকদের। শ্রমিক ভবনের নিচে চাপা পড়লে কিংবা আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করলে তা দেখা যায়। কিন্তু প্রতিনিয়ত যে লোভের আগুনে পুড়ছে কিংবা লাভ বা মুনাফার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ছে তা কিন্তু সহজে চোখে পড়ে না। 

বাংলাদেশে ৭ কোটি ৪০ লাখ শ্রমজীবী মানুষ, এরাই উৎপাদনের প্রধান চালিকাশক্তি। কলকারখানা, কৃষিক্ষেত্র, সেবা খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান অর্থবছরে ৫০ লাখ কোটি টাকার বেশি সম্পদ সৃষ্টি করবে তারা, যাকে আমরা জিডিপি বলি। দেশের রপ্তানি আয় ৫৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে গার্মেন্ট খাত থেকে গত বছর ৪৬ বিলিয়ন ডলার বা ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় হয়েছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ। শ্রমিকের শ্রমের ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়, জিডিপি বাড়ে কিন্তু সবচেয়ে কম মজুরি পান তারা। গার্মেন্টশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বনিম্ন ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এরপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি। তাদের শ্রম যেমন সস্তা, তাদের জীবনটাও তেমনি কমদামি।

 শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের মৃত্যু হলে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এনিয়ে শ্রমিক সংগঠন এবং সমাজসচেতন মানুষের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল- কর্মক্ষম মানুষের জীবনের মূল্য কি এত কম? একজন কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু মানে একটি পরিবার পথে বসে যাওয়া। আর যদি পঙ্গু হয় তাহলে পরিবারের জন্য সে এক ভয়াবহ বোঝা, সমাজের কাছে করুণার পাত্র হয়ে পড়ে। শ্রমিকের শ্রম দিয়ে একদল মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে, বিদেশে টাকা পাচার করে অথচ সেই শ্রমিক শ্রমের ন্যায্য মজুরি পায় না, কাজ করতে এসে মৃত্যুবরণ করে- পঙ্গু হয়, তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় না।

রানা প্লাজা ভবন ধস দেখিয়েছে অনেক কিন্তু শিখিয়েছে কি কিছু? শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা, ন্যায্য মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ, আহতদের চিকিৎসা পুনর্বাসনের কাজে যে অনেক পিছিয়ে আছি, প্রতি বছর ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দিবস সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রশ্ন জাগিয়ে রাখে, জীবিকা অর্জন করতে গিয়ে জীবন হারানো আর কত? 

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]

শিক্ষকদের চাকরি: পশ্চিমবঙ্গে অসন্তোষের আগুন

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪৩ পিএম
শিক্ষকদের চাকরি: পশ্চিমবঙ্গে অসন্তোষের আগুন
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

যারা সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর, যাদের ওপর দেশগঠনেরও ভার, প্রকাশ্যে তাদের ওপর পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চালাচ্ছে, পেটে লাথি মারছে, বাংলার মানুষকে এমন দৃশ্যও দেখতে হলো রাজ্য সরকার ও তাদের পুলিশ বাহিনীর সৌজন্যে। এই নির্মমতা কি চাকরিহারা শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন বলে কেবল তাদের ওপর আক্রোশ, নাকি শিক্ষাকেই মেরে হটিয়ে দেওয়ার জন্য এ বর্বরতা?...

‘কর্ম শেষে নববর্ষে বাবু ঘরে আসে। হাতে মিষ্টি, এসেন্স শিশি আর পাঁজি পাশে।’ এককালে এই ছড়াটি এপার বাংলায় খুব প্রচলিত ছিল। গ্রাম মফস্বল থেকে অনেকেই চাকরি বা রোজগারের জন্য কলকাতায় আসতেন, থাকতেনও। ছুটিছাঁটায় বাড়ি ফিরতেন সংসারের খুঁটিনাটি সামগ্রী কিনে নিয়ে। কিন্তু বছর শেষে বাঙালি বাবুটি যখন বাড়ি ফিরতেন তখন নতুন বছরের উপহার হিসেবে যাই কিনুন না কেন ভুলতেন না একটি পাঁজি কেনার কথা। গৃহিণী ছাড়াও কাকিমা, পিসিমাদের অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী তো বটেই, তাছাড়া অন্য অনেক তিথি-ক্ষণ মনে রাখতে হতো তাদের।

 পঞ্জিকা ছাড়া আর কেই-বা তাদের সেসব মনে করাতে পারে। কেবল কি তাই, কবে কখন যাত্রা করলে নির্বাঞ্ঝাট হবে, সদর আদালতের মামলার শুভক্ষণের খবর তো পঞ্জিকাতেই মিলবে। এমনকি বাতের ব্যথা হঠাৎ বাড়ল কেন, সামনে কি অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমা? চট করে কুলুঙ্গি থেকে পাঁজিটা নামিয়ে চোখ বুলানোই ছিল রীতি। যেন পঞ্জিকাই বদ্যির বিধান আবার অভিভাবকও বটে। অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে, বাড়িতে নতুন অতিথির আগমন থেকে গৃহপ্রবেশ- সবকিছুরই তো একটি শুভদিন চাই, সেই শুভ দিনটির হদিশ পাঁজি ছাড়া আর কে দিতে পারে?

মুদ্রিত আকারে বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশের বয়স প্রায় ২০০ বছর। দু-এক বছর কম বেশি হতে পারে। বয়স যাই হোক কালের পরিক্রমায় বাঙালির অতীত ঐতিহ্যের মধ্যে যে কটি বিষয় এখনো টিকে আছে, অবশ্যই পঞ্জিকা তার মধ্যে অন্যতম একটি। নতুন বাংলা বছরের শুরুতে বাঙালি এখনো পঞ্জিকা কেনার জন্য ব্যস্ত হয়, পুরোনো বছর ফুরিয়ে আসতেই তার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কেউ একথা বলতেই পারেন যে, পঞ্জিকা তো বোঝাই করা কুসংস্কার আর অচল রীতিনীতির একত্রবাস। যদি তাই হয়, তবু বলতে হবে সেই পঞ্জিকা যে বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের একটি বিরাট দর্পণ।
সেই পঞ্জিকা হিসেবে ১৪৩১ পার করে ১৪৩২-এ পা দিয়েছে। নতুন বাংলা বছরের শুরুতেই পশ্চিম বাংলা এবং ভারতে দুটি ঘোরতর ‘অমঙ্গল’ ঘটে গেছে। বিদেশি প্রবচন বলে, দিনের শুরুটা দেখলেই বোঝা যায় বাকি দিনটা কেমন যাবে। তাই বছরের শুরুতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে এপার বাংলার মানুষ।

দেশের শীর্ষ আদালতের একটি রায়ে গোটা বাংলায় আজ অন্ধকার নেমে এসেছে, বিপন্ন বোধ করছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বস্তরের মানুষ। কারণ, আদালত ২০১৬ সালের এসএসসির গোটা প্যানেল বাতিল করায় ২৫ হাজার ৭৫৩ শিক্ষক তাদের চাকরি হারিয়েছেন। তার জেরে চাকরিহারাদের পরিবারগুলো যে পথে এসে দাঁড়িয়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। রাজ্যের চারপাশে প্রতিদিন যা ঘটছে তাতে রাজ্যবাসী আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যারা সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর, যাদের ওপর দেশগঠনেরও ভার, প্রকাশ্যে তাদের ওপর পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চালাচ্ছে, পেটে লাথি মারছে, বাংলার মানুষকে এমন দৃশ্যও দেখতে হলো রাজ্য সরকার ও তাদের পুলিশ বাহিনীর সৌজন্যে। এই নির্মমতা কি চাকরিহারা শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন বলে কেবল তাদের ওপর আক্রোশ, নাকি শিক্ষাকেই মেরে হটিয়ে দেওয়ার জন্য এ বর্বরতা?
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নেতাজি ইনডোরে সভা ডেকে চাকরিহারাদের আশ্বস্ত হতে বলেছেন।

 তিনি এই বলেও আশ্বাস দিয়েছেন যে, যোগ্যদের চাকরি যাবে না। যদিও তার কথায় মোটেও ভরসা রাখতে পারেননি সদ্য চাকরিহারারা। কারণ তিনি যাদের সমস্যার সমাধান করবেন বলে ডেকে এনেছেন তাদের কোনো কথা না শুনে একতরফা কথা বলেছেন। অন্যদিকে, চাকরিহারারা ডিআই অফিসে তাদের দাবি নিয়ে অভিযান করলে পুলিশ প্রকাশ্যে লাঠি আর লাথি দিয়ে শিক্ষকদের ওপর বর্বরতার জঘন্যতম নিদর্শন স্থাপন করে। অথচ মজার ব্যাপার হলো এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের নেপথ্য কারিগররা যারা, তারা চুরি-জোচ্চুরি-চিটিংবাজি এবং ঘুষের মতো অন্যায়-অপরাধের পরও কোনো শাস্তি ছাড়াই বহাল তবিয়তে আছেন। তারা শিক্ষক নিয়োগে লাগামহীন দুর্নীতি করার জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে লাভবান হয়েছেন। অথচ তাদের ওপর কোনো আঘাত নেমে এল না। তারা এই বিপর্যয় থেকে অনায়াসেই রেহাই পেয়ে গেলেন।
 যদিও বা তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই অতি স্বল্প সংখ্যককে দোষী চিহ্নিত করতে পেরেছে কিন্তু বড় অংশটাই প্রমাণ অভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েও স্বচ্ছন্দেই বিরাজ করছে। তাহলে যোগ্যদের চাকরিহারা হওয়া এবং তাদের দুর্ভোগের দায় কাদের?

ওএমআর শিট নষ্ট করা এবং সেগুলোর মিরর ইমেজ সংরক্ষণ না করার অভিযোগে বিদ্ধ এসএসসিও দায় নিতে নারাজ। এদিকে মমতা সরকার কথায় কথায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে টেনে আনছে। কেন বারবার বিরোধীদের দিকে আঙুল উঠছে, কেন বিজেপি, সিপিএম প্রসঙ্গ টেনে আনা হচ্ছে। এরা কেউই তো নিয়োগপ্রক্রিয়ার ধারেকাছে নেই। নিয়োগ তো করেছিল সরকার, যার মাথায় মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, এসএসসি। অতএব, ২৬ হাজার চাকরিহারা হওয়ার জন্য বিরোধীরা কেন, যা কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি, অন্যায়-অপরাধ এবং দুর্নীতি সব কলঙ্কের বোঝা রয়েছে রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীর মাথায়। অথচ এই জটিল এবং ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে যাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না, সেই যথার্থ মেধাসম্পন্ন শিক্ষকদের ঘাড়ে চরম শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার পরও যখন তাদের ওপর পুলিশের লাঠির আঘাত এবং শিকক্ষকদের পুলিশের লাথি সহ্য করতে হয়, তার পরও কারও কণ্ঠে অনুশোচনার লেশমাত্র তো দূরের কথা, কেউ কেউ শিক্ষকদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

একথা অনেকদিন আগেই স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, যোগ্য শিক্ষকদের এই পরিণতির জন্য দায়ী মূলত নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই বঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন, তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার এবং তাদের দালাল চক্র। এমন নয় যে, এই সাংঘাতিক ঘটনা অজান্তে বা অসাবধানতাবশত হওয়া ভুল, বরং এটি একটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং সংগঠিত দুর্নীতি, যার মধ্যে সরকার থেকে প্রশাসন এবং কমিশন থেকে বড়-মেজো-ছোট তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীরা বেশ ভালোভাবেই যুক্ত এবং এই প্রক্রিয়ায় কয়েক শ কোটি টাকা অবৈধভাবে লেনদেন হয়েছে। 

রাজ্য সরকার সে কারণেই শুরু থেকে বিষয়টিকে চেপে দিতে এবং ঘেঁটে দিতে অতিরিক্ত তৎপরতা দেখিয়েছে, তাদের কুরুচিকর আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি শিক্ষক থেকে শুরু করে কেউই। কিন্তু কেন এসব? কারণ নিজেদের জঘন্যতম অপরাধকে ঢাকার চেষ্টা, চুরি-ঘুষকে অন্য পথে চালিত করার চেষ্টা ইত্যাদি। লক্ষ্যণীয়, শিক্ষকদের ডিআই অফিস অভিযানে সরকারের যে পুলিশবাহিনীকে আমরা লাঠি চালাতে দেখলাম, প্যান্ট-টিশার্ট এবং হেলমেট পরা এরা কারা? এদের পরিচয় নিশ্চয় কলকাতা পুলিশ নয়, তাহলে? এরা রাজ্য সরকারের ঠ্যাঙারে বাহিনী, পয়সা দিয়ে যাদের লেলিয়ে দিয়ে সরকার ন্যায্য দাবিকে দাবিয়ে দেওয়া বা দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

চাকরিহারারা বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী কেন বারবার বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলছেন, কেন তিনি বিজেপি, সিপিএম প্রসঙ্গ টেনে আনছেন? নিয়োগ তো করেছিল তার সরকার, তার শিক্ষামন্ত্রী, এসএসসি এবং এই সবগুলোরই মাথায় ছিলেন তিনি। অতএব, ২৬ হাজার চাকরিহারা হওয়ার জন্য বিরোধিরা নয়, যা কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি, অন্যায়-অপরাধ এবং দুর্নীতি সব কলঙ্কের বোঝা রয়েছে তার মাথায়। তার উচিত ছিল, নতমস্তকে সব দলকে ডেকে সর্বদলীয় বৈঠক করা।

 সমাধানের উপায় খোঁজা। তা না করে তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছেন, দায় এড়াতে চাইছেন, চাকরিহারাদের কোনো কথা না শুনেই একা কথা বলে চলে গেলেন। তাছাড়া এদিন মুখ্যমন্ত্রী চাকরিহারা শিক্ষিকাদের ভলান্টারি সার্ভিস দিতে বলছেন। এর মানে দাঁড়ায় এতদিন ধরে যারা পড়াশোনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী কি তাদের সিভিক টিচার করতে চাইছেন? তিনি আশ্বাস দিয়েছেন দুই মাসের মধ্যে যোগ্যদের জন্য ব্যবস্থা করবেন। প্রশ্ন- মুখ্যমন্ত্রী যে স্বেচ্ছায় কাজ করার পারমর্শ দিলেন, কাজ করলেও তারা কি বেতন পাবেন? আসলে মুখ্যমন্ত্রীকে দুর্নীতি ঢাকতে হবে, তিনি যোগ্যদের চাকরি সসম্মানে ফেরত দিতে পারবেন না। তাই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে কেউ কেউ আশ্বস্ত হলেও বেশির ভাগই বিভ্রান্ত।

এই মামলায় আদালত এসএসসিকে যোগ্য এবং অযোগ্যদের তালিকা জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই তালিকা জমা দেওয়া হয়নি। উল্টে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ওএমআর শিট। শিক্ষা আন্দোলনের সব ক্ষেত্র থেকেই যোগ্য এবং অযোগ্য কারা, তা বাছাই করে আদালতে রিপোর্ট জমা দেওয়ার দাবি তুলেছিল। যাতে যোগ্যদের চাকরি না যায়। কিন্তু রাজ্য সরকার সে সময় সম্পূর্ণ নীরব থেকেছে। সে তালিকা যদি আদালতের কাছে জমা পড়ত তবে আর যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের চাকরি যেত না। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন অযোগ্য প্রমাণ হলে তার কিছু করার থাকবে না।

 কিন্তু সবাই জানেন যে, তার দলেরই নেতা-মন্ত্রীরা টাকা নিয়ে চাকরি বিক্রি করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনোদিনই একবারের জন্য সেসব ঘুষখোর, তোলাবাজ দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রীদের কিচ্ছু বলেননি। এমনকি এদিনও যারা দোষী-অপরাধী তাদের কোনোভাবে তিরস্কার করলেন না। উল্টো তার হাবভাব যেন কিছুই হয়নি। তার এই আচরণ প্রমাণ করে দেয় তিনি দুর্নীতির পক্ষে এবং তাকে সমর্থন করেন। তাই দুর্নীতি ঢাকতেই তিনি চাকরিহারাদের ললিপপ খাওয়ানোর চেষ্টা করলেন।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

 

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: শিল্পে বিনিয়োগ অপরিহার্য

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩৮ পিএম
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: শিল্পে বিনিয়োগ অপরিহার্য
নেছার আহমদ

অর্থনীতিকে গতিশীল করা, নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন এবং শিল্প খাতকে সচল রাখার স্বার্থে গ্যাসের দাম কমানো এবং কারিগরি দিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও গ্রাহক হয়রানি বন্ধ ও শিল্পোদ্যোক্তাদের দ্রুততম সময়ে সেবা প্রদানে নিশ্চয়তা ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চিয়তা প্রভৃতি বিবেচনায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ে দাবি।...

সদ্যসমাপ্ত বিনিয়োগ সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ইতিবাচক আশ্বাসও পাওয়া গেছে। স্থানীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় বিনিয়োগে খরা চলছে। সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে এ সম্মেলন অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়তে বিদেশি বিনিয়োগের পালে হাওয়া দ্রুত বাড়ে। এ জন্য চিহ্নিত বাধাগুলো দূর করে বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বিনিয়োগে চলমান অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। অবস্থা এ রকম চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এ বিষয়ে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক না হওয়ায়, অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায়, অবকাটামোগত সুবিধা না বাড়ায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনেকদিন ধরেই জিডিপির আনুষঙ্গিক হারে একই পর্যায়ে অর্থাৎ ২২-২৩ শতাংশেই রয়ে গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এসব বিষয়ে সচেতন। তবে দৃশ্যমান তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।’ এটি পরিষ্কার যে, ‘যে দেশে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে না, সে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না।’ কারণ দেশি বিনিয়োগকারীরা যদি বিনিয়োগ না করেন তাহলে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, এখানে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নেই। কাজেই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আগে স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। সে জন্য বিনিয়োগের অন্যতম বাধা সুশাসন, দুর্নীতি, ঋণের উচ্চ সুদহার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অবকাটামোগত সমস্যা এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট দূর করতে হবে।

বিনিয়োগের বাধাগুলো দূর করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করছে এমন বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট সেবা এক ছাদের নিচে সরবরাহে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশের বিনিয়োগকারীদের দেশে বিনিয়োগে আহ্বান জানানো হয়েছে। সে আলোকে দেশে আয়োজন করা হয়েছে ‘বিনিয়োগ সম্মেলন’। এখানে অংশ নিয়েছেন হাজারের ওপর বিদেশি বিনিয়োগকারী। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এ সম্মেলন নিয়ে আশাবাদী। তারা বলেছেন, দেশে অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত না হলে সম্মেলনের সুফল আসবে না। 

বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে যখন অন্তর্বর্তী সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেছেন এর কয়েকদিনের মধ্যে বিনিয়োগের অন্যতম উপাদান গ্যাসের দাম বাড়ল। ফলে শিল্প খাত ধ্বংসের আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। বছরখানেক ধরে ডলারসংকটের ফাঁদে আটকে আছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। খরচ বেড়েছে আকাশছোঁয়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে। ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে গ্যাসের দাম কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে, গণশুনানিতেও দাম না বাড়িয়ে ‘সিস্টেম লস’ কমিয়ে দাম কমানোর কথা বলা হয়েছে। এসব আমলে না এনে সরকার উল্টোপথে হাঁটল। গ্যাসের দাম একঝটকায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দিল। শিল্প খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এটা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে গোটা শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এতে অর্থনীতির গতি কমবে।’

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৃহৎ বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তা ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনও গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে হয়রানি ও বিড়ম্বনার বিষয়ে এবং যথাযথ সেবা না পাওয়ার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। দেশের জ্বালানি সেক্টরে হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ উত্থাপিত হলেও এতে কোনো কর্ণপাত করে না। এ সেক্টরে যারা কাজ করে তারা সবাই যেন শাসক এবং সেবাগ্রহীতারা তাদের অধীনস্ত প্রজা। বিপণন কোম্পানির কার্যালয়ে গ্রাহকদের সেবা বা সংযোগ না দেওয়ার জন্য যত রকম অসহযোগিতা এবং আইন প্রয়োগের প্রয়োজন সেগুলো তারা প্রয়োগ করে কিন্তু গ্রাহককে সেবা দেওয়ার জন্য যা প্রয়োজন তা কখনো করা হয় না।
১৫ এপ্রিল গ্যাসের নতুন মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণার পর থেকে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সংগঠন, অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে বিনিয়োগে খারাপ প্রভাব পড়বে।’ ব্যবসায়ী সংগঠন চেম্বারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একতরফাভাবে গ্যাসের জন্য ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ মূল্য বাড়ানো হলেও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ পাননি শিল্পমালিকরা।

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারী সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, নতুন গ্রাহক, প্রতিশ্রুত গ্রাহক ও বিদ্যমান গ্রাহকদের জন্য আলাদাভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা বৈষম্যমূলক। এ মূল্যবৃদ্ধি শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য অশনিসংকেত।

দেশের শিল্প ও বিনিয়োগের এমন নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেও কীসের ভিত্তিতে দাম বাড়ানো হলো এবং এর ফলে শিল্প ও বিনিয়োগ আরও কমে যাবে কি না- এর জবাবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমদ বলেন, ‘বিইআরসি আইনি আওতার মধ্য থেকেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বিনিয়োগ কমার বিষয়টা এখনই বলা যাবে না। বিনিয়োগে প্রভাব বাড়বে কি না তা নজরে রাখা হবে। নতুন যারা আসবেন, তারা যদি দেখেন তাদের পোষাবে, তাহলে তারা আসবেন। তারা বিকল্প জ্বালানিও ব্যবহার করতে পারেন।’
চট্টগ্রামের গ্যাস চাহিদার পুরোটাই মেটানো হয় আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে। শিল্পনগরী, বাণিজ্যনগরী, বন্দরনগরী হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ পুরোটাই আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরশীল।

 সিলেট বা কুমিল্লা অঞ্চলের দেশি উৎপাদনকৃত গ্যাস চট্টগ্রামে আনার সুযোগ কারিগরিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে যখন আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহে বিঘ্ন দেখা দেয় তখন দেশি গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় চট্টগ্রামে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়; যা বিগত সময়ে আমরা দেখেছি। এখানেও চট্টগ্রামের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহে বৈষম্যমূলক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামবিদ্বেষী ষড়যন্ত্র সব সময় কার্যকর দেখা যায়। দেশের জ্বালানি উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামের, এ বিষয়ে তাদের দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। অর্থনীতিকে গতিশীল করা, নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন এবং শিল্প খাতকে সচল রাখার স্বার্থে গ্যাসের দাম কমানো এবং কারিগরি দিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও গ্রাহক হয়রানি বন্ধ ও শিল্পোদ্যোক্তাদের দ্রুততম সময়ে সেবা প্রদানে নিশ্চয়তা ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চিয়তা প্রভৃতি বিবেচনায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ে দাবি। আশা করি, দেশের স্বার্থে দেশের অগ্রগতির স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থ বিবেচনায় এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
[email protected]

 

চতুর্দিকে অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৪৭ পিএম
চতুর্দিকে অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
একশ চার বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন কমার্স বলে কোনো আলাদা বিভাগ ছিল না। কমার্স ছিল পলিটিক্স ও ইকোনমিক্স বিভাগের একটি অঙ্গমাত্র। এর পরে অর্থনীতির শক্তি ও চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইকোনমিক্স পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কর্মাস যে কেবল একটি নতুন অনুষদ হিসেবেই গড়ে উঠেছে তা-ই নয়, তার প্রসারও বেড়েছে। কমার্স ফ্যাকাল্টিতে এখন ৯টি বিভাগ। তারই পাশাপাশি আমরা তো চোখের সামনেই দেখলাম আইবিএ কেমনভাবে যাত্রা শুরু করল এবং অতিদ্রুত অত্যন্ত বিশিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। আইবিএর শিক্ষার্থীরা এখন দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন, যেখানেই আছেন তারা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়াটা এখন অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত বিষয়; ভর্তি হওয়ার প্রতিযোগিতাটা খুব কঠিন। 
 
কমার্স অনুষদের নামও বদলেছে, নতুন নাম বিজনেস স্ট্যাডিজ অনুষদ। ইনস্টিটিউট নামও শুরু থেকেই ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্টেশন। এ নামকরণ বিশ্বব্যাপী বিরাজমান ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পৃথিবীর মানুষ একটি নয়, দুই দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। আশঙ্কা ছিল যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বুঝি অনিবার্য। না, আনুষ্ঠানিক অর্থে বড় আকারে কোনো যুদ্ধ বাধেনি এটা সত্য। কিন্তু নীরবে একটি যুদ্ধ তো চলছেই। সেটা বাণিজ্যযুদ্ধ। এই যুদ্ধে সারা বিশ্বই কোনো না কোনোভাবে জড়িত। এতে লাভ হচ্ছে সুবিধাভোগীদের। তারা মুনাফার পাহাড় গড়ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দরিদ্র মানুষের অন্যকিছু নেই। তারা তাই নিজেদের শ্রম বিক্রি করেন এবং সেই শ্রমশোষণেই পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য উন্নতির ঘটনা ঘটেছে।
 
 কিন্তু বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রম-বিক্রয় করে বাঁচার চেষ্টায় ব্যস্ত মেহনতি মানুষ। প্রকৃতিও পরিণত হয়েছে ক্রয়-বিক্রয়ের সামগ্রীতে, এমনকি যে পুঁজি ছাড়া ব্যবসায় অচল সেই পুঁজিও পণ্যের চরিত্র নিয়েছে। ওদিকে সবচেয়ে রমরমা ব্যবসায় চলছে দুটি ভয়াবহ পণ্যের, তাদের একটি হচ্ছে মারণাস্ত্র, অপরটি মাদক। ব্যবসা চলছে পর্নোগ্রাফিরও। বলা হচ্ছে আমরা বিশ্বায়নের যুগে আছি। সেটা সত্য; এবং সত্য এটাও যে, বিশ্বায়ন আসলে বাণিজ্যযুদ্ধেরই নামান্তর। এবং এর অপর নাম হচ্ছে বাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন আর আন্তর্জাতিকতা কিন্তু এক বস্তু নয়। বিশ্বায়নের ভিত্তি হচ্ছে বাণিজ্য, অপর পক্ষে আন্তর্জাতিকতার ভিত্তি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা। 
 
আন্তর্জাতিকতা বিপর্যস্ত হচ্ছে বিশ্বায়নের পদাঘাতে। ফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, গত শতাব্দীর বিশ্বযুদ্ধ মনুষ্যত্বকে যে বিপদে ফেলেছিল, সেই বিপদ এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। জলবায়ুতে বিরূপ পরিবর্তন ঘটছে, ধরিত্রী তপ্ত হয়েছে, সমুদ্রের পানির স্তর ফুঁসে উঠছে, ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, বন্যা, দাবদাহ, সব কিছু ক্রমাগত ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। মহামারি এসে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ হরণ করছে। খাদ্যের প্রাচুর্যে ভরপুর এই পৃথিবীতে না খেয়ে মারা যাচ্ছেন মানুষ, আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা রেকর্ড ভাঙছে। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও বেকারত্ব উন্নতির গল্পকে বিদ্রূপ করছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগমন ভরসার তুলনায় শঙ্কারই অধিক কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ এর প্রধান অবদান যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তা বহু মানুষকে বেকার এবং অনেক মানুষকে অলস করে তুলবে। আর এর মালিকানা যদি চলে যায় কতিপয়ের হাতে তবে বাদবাকিদের পক্ষে সুস্থ থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। 
 
এসব বিপদের ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সরকার উদাসীনই বলা যায়। কারণ বিশ্বব্যাপী ধনীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে অনেকেই ভালোভাবে জানেন। আমাদের ইতিহাসও বাণিজ্যের বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে বিলক্ষণ নিজেদের সজ্ঞান করেছে। বাংলাদেশ একসময়ে অত্যন্ত সম্পদশালী ছিল। সেই সম্পদ ইউরোপীয় লোভাতুর বণিকদের এখানে টেনে এনেছিল। তাদের ভেতর সবচেয়ে চতুর ছিল ইংরেজরা; তারা বাণিজ্যের পাশাপাশি ষড়যন্ত্রও করেছে, এবং শেষ পর্যন্ত গোটা দেশকেই দখল করে নিয়েছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার শোষণ ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে তারা আমাদের সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করেছে, এবং আমরা দরিদ্র একটি দেশে পরিণত হয়েছি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আবরণে দেশভাগের ফলে বাংলার অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। এরপর পাকিস্তানি শাসকরা এসে ইংরেজদের মতোই পূর্ববঙ্গকে একটি উপনিবেশে পরিণত করতে আদাজল খেয়ে লেগেছিল।
 
 আমরা সেই শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ১৯৭১-এ আবার আমরা স্বাধীন হলাম। কিন্তু শোষণের যে পুঁজিবাদী ধারা ইংরেজ শাসকরা তৈরি করেছিল এবং পাকিস্তানি শাসকরা অব্যাহত রেখেছিল, তার হাত থেকে আমাদের মুক্তি ঘটল না। কারণ স্বদেশি শাসকরাও বিদেশি শাসকদের মতোই শোষণ শুরু করল। তারাও লুণ্ঠনের নতুন সব পন্থা উদ্ভাবন করেছে এবং লুণ্ঠিত অর্থ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। উন্নয়ন কিছু কিছু হয়েছে। কিন্তু যত উন্নতি ঘটেছে তত বেড়েছে বৈষম্য, এবং অবনতি ঘটেছে দেশপ্রেমের। দেশপ্রেম সুযোগবঞ্চিত মানুষের মধ্যে ঠিকই আছে। কিন্তু সুযোগপ্রাপ্তদের মধ্যে তা ক্রমাগত কমে এসেছে।
 
 এখনকার বাংলাদেশকে যদি নব্যধনিকদের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ বলা হয়, তাহলে অন্যায় করা হবে না। এই ধনীদের ধারণা, বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই যত দ্রুত পারা যায় এখান থেকে দুই হাতে টাকা সংগ্রহ করে বিদেশে পাচার করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এবং সে কাজেই তারা ব্যস্ত। আর যে উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান তার অভ্যন্তরে মস্ত বড় একটা ফাঁকও রয়ে গেছে। সেটা হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না-করা। বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বেকারত্ব বাড়লে অপরাধও বাড়ে, বাংলাদেশে সেটাই ঘটছে। বেপরোয়া এবং সংঘবদ্ধ গণ-ডাকাতির খবর এমন হারে পাওয়া যাচ্ছে, যেমনটি আগে কখনো পাওয়া যায়নি। এই লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন সংবাদপত্রগুলোর প্রত্যেকটিতে একটি খবর ছিল, যেটিকে বিদ্যমান অবস্থায় মোটেই চাঞ্চল্যকর মনে হবে না; কিন্তু সেটি গভীর এক বাস্তবতার এক ঝলক উন্মোচক বটে। ঘটনাটি হলো সুরক্ষিত বলে পরিচিত রাজধানীর একটি এলাকায় ভোর রাতে সংঘবদ্ধ গণ-ডাকাতি। ডাকাতদের সংখ্যা ছিল ২০-২৫ জন। তারা এসেছে তিনটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেট কারে চেপে। নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করে, নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দেয়। 
 
ডাকাতরা তখন নিজেদের র‌্যাবের সদস্য বলে পরিচয় দেয়, কয়েকজনের গায়ে র‌্যাবের পোশাকও ছিল। তারা দাবি করে তাদের সঙ্গে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও আছে। ছাত্ররাও রয়েছে। বাড়িতে তারা নাকি যৌথ তল্লাশি অভিযান চালাবে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললে ডাকাতরা বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীদের মারধর করে। তারপর বাড়িটির বিভিন্ন তলায় ঢুকে ৩৬ লাখ টাকা ও বেশ কিছু স্বর্ণালঙ্কার লুণ্ঠন করে। জরুরি বার্তা পেয়ে টহল পুলিশ এলে ডাকাতরা তাদের ওপরও চড়াও হয়। পরে স্থানীয় লোকেরা এসে পড়লে পুলিশের পক্ষে ডাকাতদের চারজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়, পরে আরও দুজন ধরা পড়ে। বোঝা যাচ্ছে এরা একটি সংগঠিত দল। এ রকম দল নিশ্চয়ই আরও আছে। পুলিশ জানাচ্ছে যে, গ্রেপ্তার করা ছয়জনের মধ্যে তিনজন আবার নিজেদের পরিচয় দিয়েছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো না মেনে উপায় নেই যে ‘উন্নতি আমাদেরকে মোটেই উন্নত করছে না’। এর বহুবিধ প্রমাণও বিদ্যমান। 
 
সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। কিশোররা ব্যাপকহারে মাদকাসক্ত হচ্ছে, গ্যাং তৈরি করছে এবং হেন অপরাধ নেই যা করছে না। ধর্ষণ আগেও ছিল। কিন্তু গণধর্ষণের ঘটনার কথা শোনা যায়নি। পাকিস্তানি হানাদাররা জঘন্য ওই অপরাধ করে, কিন্তু তারা তো ছিল শত্রুপক্ষে, নেমেছিল গণহত্যায়। কিন্তু এখন কেন এমনটা ঘটবে? বাংলাদেশের মেয়েরা অনেক এগিয়ে এসেছে, সর্বত্র তাদের উপস্থিতি দৃশ্যমান, কিন্তু তারা যে পথে-ঘাটে কর্মস্থলে, এমনকি গৃহের অভ্যন্তরেও নিরাপদে নেই সেটি তো কোনো ভালো খবর নয়। ওদিকে আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণদের এবং মেয়েদের মধ্যে।
 
 দেশজুড়ে বিষণ্নতা ও হতাশা ঘন কুয়াশার মতো বিছিয়ে রয়েছে। এই বাস্তবতা কারও অজানা তা নয়। দেশপ্রেমিক তরুণরাই ব্যবস্থাকে বিশেষভাবে চেনেন ও বোঝেন। বুদ্ধি দিয়ে চিনেন, হৃদয় দিয়েও বোঝেন। তাদের অধ্যায়নের যে বিশেষ ক্ষেত্র সেখানেও বিদ্যমান বাস্তবতার কথা আসে। 
 
প্রশ্ন দাঁড়ায় এই ব্যবস্থাটাকে কী আমরা মেনে নেব, নাকি সচেষ্ট হব একে বদলাতে? বদলানো কী সম্ভব? তাছাড়া বিদ্যমানকে বদলিয়ে কোন ব্যবস্থা আনব? চালু ব্যবস্থাটার সংস্কার অবশ্যই আবশ্যক, একে মানবিক করার চেষ্টা চাই। কিন্তু কতটা মানবিক করা সম্ভব? পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যবস্থা, তাকে বিচ্ছিন্নভাবে এক দেশে বদলানো সম্ভব নয়। এবং সংস্কারে যে কুলাবে অবস্থা এমনো নয়। কারণ গোটা ব্যবস্থাই এখন মনুষ্যত্ববিরোধী হয়ে পড়েছে। মানুষকে সে আর মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। সুবিধাভোগীরাও সুখে নেই, তারাও অসন্তুষ্ট; দুই কারণে, ভোগলিপ্সা এবং নিরাপত্তার অভাব। দেয়াল তুলে পাহারা বসিয়ে কতক্ষণ আর নিরাপদে থাকা যায়, চতুর্দিকে যখন অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে?
 
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়