বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলছে। অপরাধ মানুষের একটি মজ্জাগত বিষয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপরাধের উপস্থিতি বিদ্যমান। সমাজ যেভাবে সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছে অপরাধের বহুমাত্রিকতা ও পরিধিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া মানুষের মধ্যে অপরাধ সংঘটনের তীব্রতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুযোগ ও সময়ের সামঞ্জস্যতায় মানুষ অপরাধী হয়ে উঠছে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে এর বাস্তবতা বিদ্যমান। দেখা যাচ্ছে, যেখানেই যাকে দায়িত্ব প্রদান করা হচ্ছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই তিনি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছেন। অনেকেই সুযোগের অভাবে দুর্নীতিতে জড়াচ্ছেন না। কেবলমাত্র সুযোগ পেলেই দুর্নীতিতে উঠে পড়ছেন, লাগামহীন হয়ে পড়ছেন সবকিছুতেই। উপযুক্ত লক্ষ্য (suitable target) নির্ধারণের সুযোগ পেলেই মানুষ অপরাধী হয়ে উঠছেন। ধরুন কারও একটি ল্যাপটপের প্রয়োজন, তার সামনে ল্যাপটপের শো-রুম উন্মুক্ত থাকলে সেখান থেকে সহসাই ল্যাপটপ নিয়ে নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যিনি ল্যাপটপটি গ্রহণ করবেন তার কিন্তু চুরি করার মতো মানসিকতা থাকতে হবে, যাকে বলে অপরাধ সংঘটনে আগ্রহী হয়ে ওঠা তথা প্রলুব্ধকারী (motivated offender)। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি শো-রুমের নিরাপত্তাব্যবস্থার অনুপস্থিতি মূলত মালিকপক্ষের অসারতা (absence of capable guardian) সাপেক্ষে একজন অপরাধী অপরাধ সংঘটনে ব্রতী হয়ে উঠতে পারে। মূলত মানুষ কেন অপরাধ করে, অপরাধ সংঘটনের কার্যকারণকে বুঝতে উল্লিখিত তিনটি উপাদানের সমন্বয় প্রয়োজন। যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে এই তিনটি ফ্যাক্টরকে যদি মূল্যায়ন করা হয় তাহলে দেখা যাবে তিনটি উপাদানের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রে বিদ্যমান থাকে। এটি একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, অপরাধবিজ্ঞানের রুটিন অ্যাক্টিভিটিস তত্ত্বে অপরাধের কার্যকারণকে এই তিনটি উপাদানের মিশেলে উপস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া বিশ্লেষক ও গবেষকরা অপরাধের কারণ হিসেবে অসংখ্য ফ্যাক্টরকে গবেষণায় তুলে নিয়ে এসেছেন। তবে অপরাধের বৈচিত্র্যতা ও ধরনের ওপর নির্ভর করে কারণ ও ফলাফল ভিন্নতর হয়ে থাকে।
আপনি যদি রাজনৈতিক অপরাধের ক্ষেত্রেই কার্যকারণকে তুলে নিয়ে আসতে চান তাহলে দেখা যায়, রাজনৈতিক কারণেই মূলত রাজনৈতিক অপরাধ হয়ে থাকে। জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকলে সেটি কখনোই রাজনৈতিক অপরাধের অংশ হতে পারে না। কেবলমাত্র রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য যদি কেবলমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিপক্ষ তথা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কোনো কর্মী কিংবা নেতাকে হেনস্থা করে, সেসব রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা-হামলার ঘটনা দেখা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় জেল-জুলুমের ঘটনা দেখা যায়, প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য মিথ্যাশ্রিত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন রাজনৈতিক অপরাধ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অপরাধের মাত্রা ও ব্যাপকতা রয়েছে। সরকার প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে- এসব অপরাধ মূলত রাজনৈতিক অপরাধ। তবে রাজনৈতিক অপরাধের প্রভাব অন্য অপরাধের তুলনায় ব্যতিক্রম। পুরো একটি গোষ্ঠী কিংবা গ্রুপের ক্ষেত্রে ব্যাপারটির একটি প্রভাব থাকে এবং এ পর্যায় থেকে সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে অপরাধের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, ভয় ও উত্তেজনা বিরাজ করে।
কাজেই অপরাধের কার্যকারণের উদ্ভূত বিষয়সমূহ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণাও হচ্ছে এবং নতুন নতুন বিষয় বের হয়ে আসছে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অপরাধকর্মে যুক্ত হওয়ার রেকর্ড হয়েছে। আবার লোভ কিংবা জবাবদিহির অভাবের কারণে মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। হতাশা, বিশেষ করে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়ায় অনেকেই সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়ে। সমাজ উদ্ভূত বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ বিচ্ছিন্নতায় দিনাতিপাত করে এবং এক সময় হতাশা নিয়ে আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজও সম্পাদন করে। আধুনিক সভ্যতায় সাইবার ক্রাইম ও ক্রিমিনালদের রাজত্ব দেখা যায়। ইন্টারনেট মাধ্যমকে ব্যবহার করে অপরাধীরা দ্রুততর সময়ে একটি সিস্টেমকে হ্যাক করে ফেলতে পারে, বিভিন্ন আইডির মাধ্যমে প্রতারণা করা যায়, বিভিন্ন অপকর্মে বাচ্চাদের আসক্ত করা যায় ইত্যাদি। হোয়াইট কলার ক্রাইম, অর্গানাইজড ক্রাইম, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, সম্পত্তি বিষয়ক অপরাধ, সেক্সচুয়াল হেরেসমেন্ট, সহিংস অপরাধ, নৈরাজ্য ইত্যাদি অপরাধের ভিন্নতর কার্যকারণ রয়েছে।
অন্যদিকে আমেরিকার ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ জেরোমি হলের মতে, একটি অপরাধ সংঘটনের জন্য সাতটি উপাদানের প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ সাতটি উপাদানের সংযুক্ততাই একটি কর্মকে অপরাধ কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অ্যাক্ট; এখানে ব্যক্তির শরীর ও মনের মধ্যে একটি যোগসূত্রতা থাকবে এবং যোগসূত্রতার ভিত্তিতে সেটির শারীরিক প্রতিক্রিয়া থাকবে। অন্য একটি হচ্ছে খারাপ মানসিকতার প্রতিচ্ছবি অর্থাৎ যেখানে মানসিক ভিত্তিস্বরূপ একটি অস্বচ্ছতাকে নিরূপণ করে; মানুষের নীতি-নৈতিকতাকে অবজ্ঞা করা হয়। কেবলমাত্র এই খারাপ মানসিকতা মনে লালন করলেই অপকর্ম সম্পাদিত হয়। অগ্রহণযোগ্য কার্যকলাপের হেতু যখন বাস্তবে রূপদান পায় তখনি সেটি অপরাধে পরিগণিত হয়। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকটি ঘটনার একটি প্রতিক্রিয়া থাকে অর্থাৎ যে অপকর্মই সম্পাদিত হোক না কেন তার একটি ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিরূপিত হয়ে থাকে। অবশ্য যিনি অপরাধী হয়ে ওঠেন তার কাছে ব্যক্তিগত একটি যোগ্যতর অবস্থান তৈরি হয়, যেখানে দেখা যায় অপরাধী নিজে তার কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় না। তিনি মনে করেন তিনি যে কাজটি করেছেন, এর বাইরে কিছু করার সুযোগ তার ছিল না। সর্বশেষ, যে কাজটি সম্পাদিত হয় তার বিপরীতে যদি শাস্তির বিধান নিশ্চিত হয় তাহলে সেটি একটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রীয় আইনের ব্যত্যয় হয় এমন সব কর্মকাণ্ডই অপরাধমূলক কাজ। বাংলাদেশে দণ্ডবিধিতে উল্লিখিত সব কার্যবিধি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। উল্লিখিত বিষয়ের সংযোজনের মাধ্যমেই একটি অপরাধের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা যায়।
সমাজ যতদিন থাকবে অপরাধ ও অপরাধীদের আস্ফালন ততদিন থাকবে। অপরাধীদের কার্যক্রমকে কীভাবে কমিয়ে নিয়ে আসা যায় তথা চিহ্নিত অপরাধীদের কীভাবে স্বাভাবিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়, সে ব্যাপারে বিস্তর গবেষণার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সময়ে সময়ে অপরাধীদের আত্মসমর্পণের ঘটনা দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে যাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাদের সামাজিক অবস্থান, কাজের পরিবেশ এবং যারা মুক্তি পেয়েছে তারা পুনরায় অপরাধকর্মে যুক্ত হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে গবেষণা করে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া অপরাধ প্রতিকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিশেষ করে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং প্রত্যেকটি সেগমেন্টে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ নিমিষেই কমে আসবে। সর্বোপরি পুলিশ বাহিনীকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া অপরাধ প্রতিরোধমূলক উদ্ভাবনী ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণই পারে অপরাধীদের অপরাধকর্ম থেকে নিবৃত্ত করতে হবে। যেসব কারণে অপরাধীরা অপরাধে যুক্ত হচ্ছে সেসব কারণ উদঘাটিত করে তা সমূলে উৎখাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অপরাধীদের সার্বিকভাবে নিবৃত্ত করা যেতে পারে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়