ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সাক্ষাৎকার: ড. তাসনিম সিদ্দিকী সবার আগে আমলাতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১১:৫১ এএম
আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১১:৫২ এএম
সবার আগে আমলাতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন
ড. তাসনিম সিদ্দিকী

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি ছাত্রদের পক্ষে লেখালেখি করেছেন এবং পথে নেমে আন্দোলনে সমর্থন করেছেন। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন খবরের কাগজ-এর সিনিয়র সহ-সম্পাদক সানজিদ সকাল

খবরের কাগজ: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ জনগণের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ করবে বলে মনে হয়।

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: অধ্যাপক ড. ইউনূসের তত্ত্বাবধানে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, এর প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার খুবই দ্রুত গঠন করা হয়েছে। কারণ সময়টা ছিল খুবই ক্রান্তিকাল। যাদের নিয়ে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, তারা সবাই বিচক্ষণ এবং অন্তিম অভিজ্ঞতার মানুষ। অধ্যাপক ড. ইউনূস সাহেব অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অনেক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রতিকূলতা দূর করার জন্য ধীরে ধীরে হয়তো আরও উপদেষ্টা নিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। 

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি? 

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা একটা কঠিন ব্যাপার। সাধারণ ছাত্রছাত্রী, জনতা আস্থা রেখেছে এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্য শুধু নির্বাচন সম্পূর্ণ করা নয়, আরেক দল ক্ষমতায় এসে আবার যেন কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। তাহলে এত মানুষের প্রাণ দিয়ে কী লাভ হলো। এখন এই সরকারের দায়িত্ব প্রতিটা জায়গায় সংস্কার করা। 

বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি জায়গায় সংস্কার আনতে হবে। কারণ প্রতিটি জায়গা দলীয়করণ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ঠিক করতে গেলে একটু সময় প্রয়োজন। যদি উপদেষ্টারা তাদের কাজগুলো করতে একটা নির্ধারিত সময় পান, তাহলে তারা সঠিকভাবে করতে পারবেন। দেশে কীভাবে নিরপেক্ষ ও যৌক্তিক গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা যায়, পুরোনো যারা ডেমোক্র্যাট আছেন, তারা সহযোগিতা করবেন। যদি আমরা মনে করি, আগামী তিন মাস বা ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দেওয়া দরকার, তখন হয়তো আসল সংস্কার করা সম্ভব হবে না। 

খবরের কাগজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচিরেই খুলে দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না? 

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বন্ধ রাখার মতো পরিস্থিতি নেই। দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার। সবকিছুকেই স্বাভাবিক নিয়মে নিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখতে পারছি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টররা পদত্যাগ করছেন। তারা একেবারেই দলীয়-ভিত্তিক কাজ করতেন। ছাত্রদের দাবি ছিল, রাজনীতি চাই বাইরে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থাকবে রাজনীতিমুক্ত। অর্থাৎ গণরুম থাকবে না। সবাই স্বাধীনভাবে চলতে চায়। 

এই কাজগুলো করতে হলে সে ধরনের মেধা ও শক্তিসম্পন্ন ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করতে হবে। সেই সব প্রভোস্টকে নিয়োগ করতে হবে, যাদের কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে তাদেরই, যারা রাজনীতি করেন না। যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক বেশি, যারা সমাজ সম্পর্কে অনেক সচেতন, এমন শিক্ষকদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ ও দায়িত্ব দিতে হবে। এভাবে সংস্কার করলে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া সম্ভব। 

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে আন্তর্জাতিক সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে? এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?  

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: প্রফেসর ড ইউনূসকে বিশ্বের কে না চেনে? তিনি বিশ্বনন্দিত ও জ্ঞানী মানুষ। তিনি যদি বৈশ্বিক চাপ মোকাবিলা না করতে পারেন, তাহলে কে পারবে? আমেরিকা ড. ইউনূসকে সমর্থন করে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে ড. ইউনূসের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। চায়না ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আমদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এতদিন শুধু একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযোগ রেখে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক চালু রেখেছে। 

বাংলাদেশে এমন গণ-অভ্যুত্থান হতে পারে, ভারত কখনো ভাবতেই পারেনি। তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা গোয়েন্দা বিভাগের ওপর উষ্মা প্রকাশ করেছে। ভারতের বিশ্বাস ছিল- শেখ হাসিনা সরকার টিকে থাকবে এবং যেভাবেই হোক শেখ হাসিনার মাধ্যমে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে কী চাহিদা তা এখনো ভারত সরকার বুঝতে পারছে না। হাসিনা সরকার তিস্তা চুক্তি, মোংলা বন্দর এবং যেখানে ভারতের ব্যবসায়ীদের আগ্রহ আছে, সেখানেই তিনি ভারতকে ছাড় দিয়েছেন। 

ভারতের স্বার্থ যেভাবে রক্ষা হয় সেভাবে তিনি চুক্তি করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থের কথা সব সময় চিন্তা করা উচিত। ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং তাদের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। মূল অসুবিধা হলো, বাংলাদেশে পরপর তিনটা নির্বাচনে মোদি সরকার এভাবে একটা দলকে সহযোগিতা করে বিশ্ব জনমত তৈরি করে জনসাধারণের ভোটাধিকারকে একেবারে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। সে কারণেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ আছে। 

ভারতের এখন বন্ধুত্ব করতে হবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। কখনোই একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। ভারত এমন কিছু কাজ করছে, যা কূটনৈতিকভাবে ঠিক করছে না। এখন হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর সঙ্গে যা হয়েছে তা মোটেও উচিত হয়নি। বিষয়টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। অথচ ভারত সেটাই করছে। ভারত এটাকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত হানা হয়েছে বলে সারা বিশ্বে ছড়াচ্ছে। 

প্রকৃতপক্ষে বিষয় কিন্তু তা নয়। বাংলাদেশে যারা ঘোর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছে, তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত এসেছে।  আমাদের বোঝতে হবে এরা কোন হিন্দু জনগোষ্ঠী। এটা গণহারে সব হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হচ্ছে, নাকি যারা আওয়ামী লীগপন্থি রাজনীতি করে তাদের ওপর হয়েছে। সেটাও যদি হয়ে থাকে তাও অন্যায়। 

তবে এটা আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তোষ, কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। এই বিষয়গুলো ভারতকে বোঝতে হবে। ভারতের গণমাধ্যমে ভুল প্রচার করা হচ্ছে। ভারত সরকারের উচিত এই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা। বরং এই সরকারকে আরও অস্থিতিশীল করে দিচ্ছে। এটা ভারতের জন্যও ভালো নয়। 

খবরের কাগজ: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, এটা কতটুকু সার্থক হবে বলে মনে হয়?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: বিচার বিভাগকে তো সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের সময় যেভাবে আদালত নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন, আমরা দেখি- সরকার যেভাবে বলল কোর্ট সেভাবেই একটা রায় দিয়ে দিলেন অর্থাৎ কোটা বাতিল করা ভুল হয়েছে, পুরোনোটা বহাল থাকবে। এটা নির্বাহী আদেশ, বিচার বিভাগের এটা এখতিয়ার নেই। তবু তারা এই আদেশ দিয়েছিলেন। 

কেন দিয়েছিলেন? বিচার বিভাগ বলেছে, ‘শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন, তাই’। পরবর্তী যে নাটক, তা হলো- আবার আপিল করা হয়েছে। পরে ছাত্র আন্দোলন যদি না হতো, তাহলে তা বলবৎ রেখে সরকার বলত, আদালতের ওপর তো আমরা কথা বলতে পারি না। একই কাজ তারা করেছিলেন, আদালতের অজুহাত দেখিয়ে তিনি ওটাকে সঙ্গে সঙ্গে আইন করে অধ্যাদেশ বাতিল করালেন। উচ্চ আদালত সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। 

খবরের কাগজ: আমলাতান্ত্রিক সংস্কার কতটুকু প্রয়োজন বা এটা সংস্কার সম্ভব কি না?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: সবার আগে আমলান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন। আগে তো রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে হবে। সব বিভাগ চালাতে হবে। ঊর্ধ্বতন যারা সরকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন তারা অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে অফিসে আসছেন না। 

এই মানুষগুলোকে সরাতেই হবে। আর যারা ভালো মানুষ, ঠিকমতো কাজ করতে চান- এ ধরনের মানুষকে পুনরায় সংগঠিত করতে হবে। এটা বিশাল কাজ। আবারও আমি বলব, একটা কমিশন গঠন করতে হবে।

খবরের কাগজ এগিয়ে যাক, এই কামনা রইল।

খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ।

শিক্ষা খাতে সংস্কার: সবার ওপর মানবসম্পদের উন্নয়ন

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২০ এএম
শিক্ষা খাতে সংস্কার: সবার ওপর মানবসম্পদের উন্নয়ন
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
২০২৪-এর ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট ছিল ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে আয়-উপার্জন ও ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অধিকারপ্রাপ্তিতে বিদ্যমান প্রচণ্ড বৈষম্যের বিরোধিতা; বিরোধিতা ছিল মানবসম্পদ উন্নয়নে ও নিয়োগে মেধা অবমূল্যায়নের প্রয়াস-প্রচেষ্টাকে রুখে দেওয়া; ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্যগগনে অবস্থানকারী তাজা তরুণ জনগোষ্ঠীকে ডিজাস্টারে পরিণত করার কূটকৌশলের মর্মমূলে আঘাত হানা, যাতে শিক্ষিত বেকারের ভারে ন্যুব্জ দেশ, সমাজ ও অর্থনীতিকে একটি স্বনির্ভর অবয়বে গড়ে তোলা যায়। সে নিরিখে শিক্ষা খাতে সংস্কারকে অন্যতম এবং অগ্রগণ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা এবং চিন্তাচেতনার চৌহদ্দিতে আনা আবশ্যক। 
 
এই মুহূর্তে করণীয়: শিক্ষায় সবাইকে সর্বজনীন সক্ষমতা ও দক্ষতার পথে পেতে হলে এই মুহূর্তেও (১) প্রথম ও প্রধান করণীয় হলো সবাইকে পাঠকক্ষে ফিরতে হবে, ফেরাতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনের পর এখন শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষকসমাজ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দায়িত্ববোধ জেগে ওঠা দরকার হবে যে, যার যার পাঠক্রম ভালোভাবে শেষ করতে হবে। বকেয়া কোনো পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার যৌক্তিক দাবি থেকে সবার সার্বিক স্বার্থে সরে আসতে হবে। 
 
কিছুটা বাড়তি সময় নিয়ে হলেও সব পরীক্ষায় সবাইকে অংশ নিতে হবে এ জন্য যে, ভবিষ্যতের দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ পরীক্ষার সনদ দেশে কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা, এমনকি মধ্যপর্যায়ে চাকরি-বাকরি লাভের ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে দাঁড়াবে। তীব্র প্রতিযোগিতার বিশ্বে দুর্বল সনদ নিয়ে টিকে থাকা যাবে না। আমরা টিকতে না পারলে সে চাকরি ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে বিদেশিরা। বৈষম্য নিরসনের আন্দোলনের সফলতা ভণ্ডুল ও ভঙ্গুর করার ক্ষেত্রে পাঠবিমুখ হয়ে থাকার চেয়ে আত্মবঞ্চনা ও বৈষম্য বৃদ্ধি আর কোনো কিছু হতে পারে না। 
 
(২) শিক্ষককে, শিক্ষা প্রশাসনকে সম্মান ও সমীহ করতে হবে। যার যা দোষত্রুটি আছে তার প্রতিবিধান হবেই হবে, তবে এর জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। নিজেরা সজাগ, নিজেরা আইন ও ব্যবস্থাপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে, ঐক্যবদ্ধ থাকলে অপশক্তি পলায়ন করতে বাধ্য হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাম্প্রতিক সাফল্য তো তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। 
 
স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপসমূহ: বাংলাদেশে ইতোমধ্যে নানান শিল্পোদ্যোগে এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এর অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দেশটি কৃষি এবং ট্রেডিং-নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অগ্রসরমাণ। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ একটি দেশ। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই দেশের কর্মক্ষম জনগণকে কর্মকুশল-দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার অনিবার্যতা মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত। 
 
কেননা ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ সৃজনশীল কর্মক্ষম জনসমষ্টির আওতায় চলে এসেছে, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নামে পরিচিত। সনাতন শর্তানুযায়ী, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড মূলত তিন দশক পর্যন্ত সৃজনশীল এবং উন্নয়ন অভিসারী অভিযাত্রায় থাকে। ইতোমধ্যে তার এক দশকের বেশি সময় চলে গেছে; সামনে আরও দেড়-দুই দশক বাকি আছে। 
 
এ সময়ের মধ্যে বিদ্যমান কর্মোপযোগীদের উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করতে না পারলে বা তাদের উপযুক্ত কর্মসম্পাদনে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে কিংবা তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে তারা অলসতায় শয়তানের কর্মশালায় যোগ দিতে পারে কিংবা অকর্মণ্যতায়-হতাশায় নিমজ্জিত হতে পারে; যে পরিস্থিতিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। 
 
কেননা সমাজে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেলে উৎপাদনশীলতায় বা জিডিপিতে তাদের অবদান বঞ্চিত হয় দেশ এবং তারা নিজেরাই নিজেদের, পরিবারের ও দেশের জন্য বোঝা বা বিপদের বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে জাতির জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর সময় এবং এর জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে বিশেষ মাশুল।
 
বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা এ দেশের জনগণকে বিশেষ করে যুবসমাজকে এখনো পর্যাপ্ত যথাযথ দক্ষ জনসম্পদে বা প্রশিক্ষিত লোকবল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। যার জন্য এ দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক আর বিদেশের দক্ষ জনবল এ দেশের মধ্য ও উচ্চতর পদগুলোতে বেশি বেতনে নিয়োজিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় সমাপনকারী ডিগ্রিধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু তাদের দেশের উদীয়মান শিল্পে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগযোগ্য হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে না। 
 
বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে প্রায়োগিক জ্ঞানের নিম্নগামিতা, প্রশিক্ষণ এবং অধিক শিক্ষা গ্রহণে যুগপৎভাবে সুযোগ ও আগ্রহের অভাব। বাংলাদেশের জন্য উঠতি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কিংবা অধিকতর যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো উপর্যুক্ত ও দক্ষ জনবলের যেমন প্রয়োজন, তেমনি টেকসই ও লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং সমন্বয়ে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তার সঙ্গে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকুশলতা। 
 
এই প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডে নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে, সেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে তা মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত ও উপর্যুক্ত লোকবলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
 
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের যে কর্মসম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে উপযুক্ত দেশীয় লোকবল সংস্থান করা যাচ্ছে না; অথচ সেগুলো বিদেশিদের দ্বারা পূরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্প একটি অতি সম্ভাবনাময় শ্রমিকনির্ভর শিল্প। সেখানে মধ্য পর্যায়ের অধিকাংশ ব্যবস্থাপক, পরিচালক, নকশাকার হিসেবে নিয়োজিতরা বিদেশি। 
 
এর ফলে দেশি শিক্ষিত বেকারকে কর্মসংস্থানের চাহিদায় টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় এবং চাকরি না পেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণরা হতাশায় নিমজ্জিত। একই সময়ে দেশের টেকনিক্যাল শিক্ষার পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকায় দক্ষ জনবল সরবরাহের পরিস্থিতি এমন একটি নেতিবাচক পর্যায়ে যাচ্ছে যে, দীর্ঘ মেয়াদে তাতে এক করুণ ও আত্মঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
 
এহেন পরিস্থিতি থেকে কার্যকরভাবে পরিত্রাণ পেতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। গালভরা শব্দমাখা, দেশি-বিদেশি কনসালট্যান্ট ও বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে অনুসন্ধান পরীক্ষা-পর্যালোচনার পথে থাকার চেয়ে একটি আত্মনির্ভরশীল পরিস্থিতি সৃজনে নিজেদের ভাবনায় বা উদ্যোগে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়-
 
১. দেশের জনবলকে দেশে নিয়োগ বা আত্তীকরণ নিশ্চিত করা। বাইরের বায়ারের চাপে কিংবা বাইরের কর্মীদের স্মার্টনেসের যুক্তিতে তাদের নিয়োগ করা থেকে বিরত থেকে দেশীয়দের নিয়োগে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তথা চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। দেশে কর্মসৃজনের সুযোগ সৃষ্টি না করে বিদেশে পুঁজি পাচার করা আত্মঘাতী অপরাধ। বিদেশে নয়, নিজেরা যদি নিজেদের দেশে লোকবল নিয়োগের জন্য পদ সৃষ্টি না করি, তা হলে দেশীয়দের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না। দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।
 
২. পেশাজীবী ও শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী লোকবল তৈরির জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন। ইতোমধ্যে বিজিএমইএসহ কয়েকটি সংস্থা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট গড়ে তুলছে। কিন্তু সেসবের বাস্তবায়ন বড্ড ধীরগতিসম্পন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ লোকবল তৈরির কাজ এখনো শুরু হয়নি, শুরু হলেও মানসম্মত ফল পেতে দেরি হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, সময় কারও জন্য বসে থাকবে না।
 
৩. বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে, তাদের ভাষা ও টেকনিক্যাল জ্ঞান বাড়াতে হবে। তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ-ভাবনা গতানুগতিক অবয়বে না রেখে তাদের জন্য নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি বিশেষ ব্যবস্থাপনাধীনে ভাষাচর্চা ও ব্যবহারের দক্ষতা অর্জনের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তা না হলে বিদ্যমান শিক্ষার্থীরা শ্রমবাজারে গতানুগতিক অদক্ষ অবস্থায় প্রবেশ করবে। 
 
৪. অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণের পথ পরিহার করে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণের লক্ষ্যে এবং দেশে দক্ষ জনবল সৃষ্টির জন্য আলাদাভাবে বিশেষ তহবিল গঠন করে বিশেষ কার্যক্রম/উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যমান সব বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকৃতপক্ষে কি শেখানো হচ্ছে, তা কঠোর তদারকিতে এনে সেখানে গুণগত শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
 
৫. অদক্ষের পরিবর্তে দক্ষ জনবল প্রেরণ করতে পারলে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। দেশে দক্ষ জনবল পাওয়া গেলে, বিদেশিদের নিয়োগ বন্ধ হলে ব্যাপক বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় ঘটবে। সরকারকে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এই লাভ-লোকসানের সমীকরণটি যথাবিবেচনায় নিয়ে সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি মনোযোগী এবং যেখানে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গুণগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে কড়া তদারকি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যেসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করবে, তাকে সুলভ করতে কর রেয়াত কিংবা প্রণোদনা দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে।
 
৬. কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রমে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ভাষা শিক্ষাসহ বিশেষ প্রায়োগিক জ্ঞানের পাঠ্যসূচি কার্যক্রম সংযুক্তকরণ। উচ্চ মাধ্যমিকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রাক্কালে দেশি-বিদেশি ভাষায় দখল ও দক্ষতা যাচাই করতে হবে। প্রয়োজনে ২-৩ মাসের একটা কোর্স করিয়ে ভর্তিতে উপযুক্ততা যাচাই করার পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।  
 
৭. বিদেশে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণে সচেষ্ট থাকা। অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে তাদের প্রেরণ-ব্যয় যাতে সীমিত থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখা। কেননা অদক্ষ শ্রমিকরা বিদেশে বেশি বেতন পায় না, অথচ তাদের যেতে যদি বেশি অর্থ ব্যয় হয়, তা হলে তাদের প্রত্যাবসনের দ্বারা প্রকৃতভাবে অর্থনীতি কোনোভাবে উপকৃত হবে না।
 
৮. সাধারণ শিক্ষা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত রেখে সাধারণ শিক্ষা এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রায়োগিক বা বৃত্তিমূলক টেকনিক্যাল শিক্ষার দিকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে ধাবিত করা। শুধু উচ্চ মেধাসম্পন্ন ও গবেষণা-ইচ্ছুকরা উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে যেতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষা পর্যায়ক্রমে নিরুৎসাহিত করা।
 
৯. শিক্ষা পাঠ্যক্রমে নীতি-নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং বিভাজন ও বৈষম্য 
 
বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সজ্ঞান প্রতীতি ও প্রত্যয় জাগাতে হবে। 
 
জনসম্পদ উন্নয়নে বিদ্যমান এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং উন্নত পর্যায়ে উত্তরণ শুধু জরুরি নয়, অনিবার্যও বটে। এখনই যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের দিকে নজর না দেওয়া হয়, তা হলে আগামী ১৫ বছরের আগে সেই দক্ষ জনবলের সাক্ষাৎ মিলবে না। 
 
ততদিনে বর্তমানে বিদ্যমান বেকার ও অদক্ষ শিক্ষিত জনসম্পদ ওপরে ও নিচের জন্য জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকবে। ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান পর্যায়ে বিদেশিদের নিয়োগ অব্যাহত থাকলে বা রাখলে দেশের চাকরির বাজার দেশীয়দের জন্য আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এ বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। 
 
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান

ওয়াসায় জনগণের মালিকানা কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৭ এএম
ওয়াসায় জনগণের মালিকানা কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?
এস এম নাজের হোসাইন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হলো। ইতোমধ্যে স্বৈরাচারের অনেক দোসর নিজেরাই পদত্যাগ ও পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। বহুল আলোচিত ঢাকা ওয়াসায়ও তার ধাক্কা লেগেছে। আজীবন লিজ নেওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ঢাকা ওয়াসাসহ সব ওয়াসার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও জনগণের মালিকানা নিয়ে অনেক আলোচনা করা হলেও তার সুফল পাওয়া যায়নি। 
 
কারণ এগুলো কাউকে কাউকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। প্রায় সময় গ্রাহক পর্যায়ে পানির দাম বৃদ্ধির খড়্গ নেওয়া হতো লোকসান কমানোর কথা বলে। যদিও ক্যাবসহ নানা নাগরিক সংগঠনের ভিন্নমত থাকলেও সেটি আমলে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। রাবার স্ট্যাম্পের মতো একটি পরিচালনা পর্ষদ ছিল, যা অনেকটাই লোক দেখানো।
 
পানি প্রত্যেক নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করবে। সে আলোকে রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় জনগণের অত্যাবশ্যকীয় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ঢাকা ওয়াসাকে। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে রয়েছে নানা মহলের অভিযোগ। 
 
শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানিও সরবরাহ করতে পারে না ওয়াসা। এ ছাড়া পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। তবু নিয়মিতই মুনাফা করে আসছিল ঢাকা ওয়াসা। প্রতিনিয়তই ঢাকা ওয়াসা প্রতি অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করে আসছে। এর পরও নানা অজুহাতে প্রতিবছর পানির মূল্য বাড়ায় ঢাকা ওয়াসা। আর মন্ত্রণালয় সেখানে সায় দেয়। 
 
আলোচনার সুবিধার্থে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ঢাকা ওয়াসার আর্থিক প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। এতে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওয়াসা মুনাফা করেছিল প্রায় ৩৯৭ কোটি টাকা। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২৯৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি। লোকসানের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, পরিচালন তথা বেতন-ভাতা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিক্রয় ও বিতরণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। এ ছাড়া সরকার থেকে গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি অর্থবছরও ওয়াসা লোকসান করবে বলে প্রাক্কলন করেছে।
 
ক্যাবসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার মূল সমস্যা হলো ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নিত্যনতুন প্রকল্প নিতে বেশি আগ্রহী। পানি উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবহারে অনিয়ম দূর করা গেলে এবং ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটানো হলেই লোকসান কমানো সম্ভব। কারণ ঢাকা শহরে যেখানে পানি আছে সেখানে প্রচুর পানির অপচয় হচ্ছে, আর যেখানে নেই সেখানে শুধু হাহাকার। কয়েক দিন আগে পুরো পানি সরবরাহ লবণাক্ত ও ঘোলাটে হয়ে পড়েছিল। 
 
ওয়াসার নীতিনির্ধারকদের হাতে সে খবর ছিল না। পরে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির কারণে কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে তদারকি ও কাজের গুণগত মান উন্নয়নে কোনো তৎপরতা নেই। আর অবৈধ সংযোগ, সিস্টেম লস পুরোটা খামচে ধরেছে ওয়াসাকে। অনেক জায়গায় ওয়াসার পানির পাইপ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি নিঃসরণ হয়ে স্যুয়ারেজের লাইনে চলে গেলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো খবরই রাখে না। ওয়াসা চলমান প্রকল্পগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নকাজে তদারকিতে বিরূপ মনোভাব রয়েছে। 
 
এ ছাড়া যেটি সবচেয়ে ভয়ংকর তা হলো, ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদে ভোক্তাদের কোনো সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব নেই। ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬ অনুসারে ঢাকা ওয়াসা পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি, সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি, বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি এবং পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। 
 
প্রত্যেক প্রতিনিধি তাদের সংশ্লিষ্ট সংগঠন কর্তৃক মনোনীত হলেও পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক তারই আজ্ঞাবহকে মনোনীত করে থাকেন। বর্তমান ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যানও একই প্রক্রিয়ায় মনোনীত। স্বাভাবিক কারণেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক মনোনীত বোর্ড সদস্য বা চেয়ারম্যান যে-ই হোক না কেন, তার পক্ষে তার মনোনয়নদানকারীর কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা কি আদৌ সম্ভব? আইনের মারপ্যাঁচে বলা আছে, একজন ব্যক্তি কীভাবে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী হতে পারেন? 
 
তবে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি হতে হলে তাকে ভোক্তাদের সঙ্গে সংযোগ থাকতে হবে। আর সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। যেখানে ধারা নং ৫-এর ১৬ উপধারায় বলা আছে, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে। তারই ধারাহিকতায় ক্যাব সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভোক্তা র্স্বাথসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী ও কমিটিগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করে এলেও ঢাকা ওয়াসায় তা মানা হয়নি। 
 
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আর একটি জটিল সমস্যা হলো শাসনব্যবস্থায় সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের অভাব। যদিও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক সব জনগণ বলা হলেও বর্তমানে শাসনব্যবস্থায় সমাজের সকল পর্যায়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। এ জন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা আবশ্যক। এই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টি রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, অবজ্ঞা ও সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। 
 
যার প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনায়ও। যেখানে অনেক খাতে শুধু সরকারি কর্মকর্তা আর ব্যবসায়ী মিলেমিশে নীতিনির্ধারণ করে থাকেন। অথচ এখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বা যাদের জন্য এই সেবা সার্ভিস, তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। তবে অনেক জায়গায় এসব পদও সমাজের ওপরতলার লোকজন দখল করে নেন। নীতিনির্ধারক মহল চিন্তাও করে না, যার জন্য এই সেবা বা বিধান, তাদের কোনো মতামতের প্রতিফলন দরকার আছে কি না? 
 
তাই এখন ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি দূর করা, শুধু গ্রাহক পর্যায়ে প্রতিনিয়তই দাম বাড়ানোর চেয়ে সরকারি সেবা সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অনেক বেশি জরুরি। একই সঙ্গে পানির দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানির আয়োজন করে ভোক্তাদের মতামত নিয়ে সেবার মান ও দাম নির্ধারণে ভূমিকা নিতে হবে। 
 
কারণ ওয়াসা রাষ্ট্রীয় প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। জনগণের করের টাকায় এর ব্যয়ের একটি বড় অংশ নির্বাহ করা হয়। সে কারণে জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পরিচালন ব্যয়, ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধসহ নানা অজুহাতে ভোক্তা পর্যায়ে পানির দাম বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তি থেকে বের হয়ে এসে সেবা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনার মান, পানি ব্যবহারকারীদের সত্যিকারের অংশগ্রহণ, কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা কাটানো সম্ভব। 
 
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

বিশেষ সাক্ষাৎকার: সিরাজুল ইসলাম চোধুরী শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন, তাহলে শিক্ষাই লাঞ্ছিত হয়

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:০১ এএম
শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন, তাহলে শিক্ষাই লাঞ্ছিত হয়
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের এই ক্রান্তিকালে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রথিতযশা এই শিক্ষাবিদ। শিক্ষকদের যখন লাঞ্ছিত, অপমানিত ও জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, ঠিক তখনই এর লাগাম টেনে ধরতে চান সমাজ রূপান্তরকারী এই শিক্ষক। এ ব্যাপারে তিনি কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র সহ-সম্পাদক সানজিদ সকাল

খবরের কাগজ: সরকার পতনের পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষকরা লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, এই বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা আঘাত আনে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এটা শুধু শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে লাঞ্ছনা করা হয় না, পুরো জাতি লাঞ্ছিত হয়। শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন, তাহলে শিক্ষাই লাঞ্ছিত হয়। শিক্ষক যদি অপমানিত হন ও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়, সেটা হবে জাতির জন্য কলঙ্ক। যদি কোনো শিক্ষককে জুতার মালা গলায় পরানো হয়, তাহলে সেই শিক্ষক আর শিক্ষক থাকেন না। সেই আঘাতটা শুধু একজন শিক্ষকের ওপর আসে না, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আসে। শিক্ষকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। 

ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কটাই বদলে ফেলতে হবে এবং মধুর হতে হবে। ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। এটা মানতেই হবে যে, ছাত্ররা সব সময়ই শিক্ষকদের আদর্শ হিসেবে মানবে। শিক্ষককে বীর হিসেবে অনুকরণ করতে হবে। সেই অনুকরণীয় মানুষটাকে যদি খাটো করে ফেলা হয়, তাদের যদি কোনো সম্মান না থাকে, তাহলে শিক্ষায় তার অধিকারই থাকে না। তখন তিনি আর শিক্ষক থাকেন না। 

শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ করাটা সংক্রামক ব্যাধির মতো। একবার এক শিক্ষকের ওপর আক্রমণ করলে সব জায়গাতেই এর প্রভাব পড়ে। সবাই পাওয়ার বা শক্তি প্রয়োগ করতে চায়। আমরা দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিলাম। আমাদের ক্ষমতার অভাব আছে। ক্ষমতা যখন যে যতটুকু পায়, সেই ক্ষমতাটার অপব্যবহার করে। ক্ষমতা পেলেই মানুষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যারা ক্ষমতা থেকে একসময় বঞ্চিত হয়, তারাই ক্ষমতা পেলে সেটাকে অপব্যবহার করে। 

এমনিতেই ক্ষমতা সব সময়ই অপব্যবহারমুখী। শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োগ করা হয়নি। এখন শিক্ষার যে পদ্ধতি তাতে শিক্ষার্থীরা স্কুল শেষ করে কোচিং সেন্টারে চলে যায়। তারা গাইড বই ব্যবহার করছে। তারা ক্লাসরুমে বেশি সময় দিচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্য সৃজনশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে না। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। শিক্ষা এখন কেনাবেচার পণ্যতে পরিণত হয়েছে।  

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন আনা দরকার কি না। অন্যদিকে ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা আগের দিনে এমন সম্পর্ক ছিল না। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: জাতি গঠনে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সুনিবিড় সম্পর্ক থাকা উচিত। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হলে অবশ্যই শিক্ষকের মর্যাদা দিতে হবে। এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দুর্দশাগ্রস্ত। আমাদের দেশের সন্তানরা প্রাথমিক পর্যায়ে এসেই ঝরে পড়ে। আমাদের দেশের শিক্ষার বড় দুর্বলতা হলো তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। বর্তমান বিশ্বে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। একটা শ্রেণির ওপর নির্ভর করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তিন ধারায় ভাগ করে রেখেছে। এই তিন শিক্ষা ধারা একদিন অবলুপ্ত হবে। 

বর্তমানে এই তিন ধারা ছাড়াও আরও শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো শ্রেণি বিভাজন। মাতৃভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষা তা আমরা জাতিকে দিতে পারছি না। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়াকেই প্রধান ধারা করার কথা ছিল। বাঙালি জাতি বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষাকে কেন শিক্ষার মাধ্যম করা গেল না, সেটা আমাদের জাতির একটা বড় দুর্বলতা। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই জায়গাটায় আমাদের ভাবতে হবে। লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জবরদখল চলছে। রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে এমন অনৈতিক কাজগুলো করা হচ্ছে। দেশে সরকার পতন হলে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনভাবে দখল করতে হবে? এমনকি বিদ্যালয়ও এর থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। শিক্ষকদের অপমান করা হচ্ছে, লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। 

এমনকি নারী শিক্ষিকাদের লাঞ্ছিত করে তার কক্ষ থেকে বের করে দিচ্ছে তারই শিক্ষার্থীরা। এমন তো কখনো হওয়ার কথা নয়। 
শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। শিক্ষদের বিরুদ্ধে তালিকা করা হচ্ছে। এসব কাণ্ড করা হচ্ছে একবারেই নিজস্ব স্বার্থের কারণে। এটা কোনো আদর্শ হতে পারে না। শিক্ষক লাঞ্ছনা, শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন এবং জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা খুবই খারাপ কাজ। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঘটছে না। এমনকি কওমি মাদ্রাসাগুলোতেও ঘটছে না। এই ঘটনাগুলো ঘটছে মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মূলধারার শিক্ষাতেই তারা আঘাত করছে। মূলধারার শিক্ষাটা নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

খবরের কাগজ: বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম কি আগের কারিকুলামে ফিরিয়ে আনা হবে? বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে কি? বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামে কোনো পরিবর্তন দরকার আছে বলে কি আপনি মনে করেন? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সবকিছুই পরিবর্তন হয়। তারও একটা নিয়মনীতি আছে। শিক্ষা কারিকুলাম আগের কারিকুলামে গেলে ভালো হবে, নাকি মন্দ হবে সেটা কোনো বিষয় নয়। হঠাৎ করে শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন করা হলো একধরনের স্বৈরাচারী মনোভাব। শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে বিশদ আলোচনা করা ও প্রস্তুতির দরকার ছিল। শিক্ষা কারিকুলাম বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। 

একবার সৃজনশীল, আবার নতুন কারিকুলাম। পরীক্ষার বিষয় কখনো বাড়ানো হয়, আবার কমানো হয়। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। যারা দলনিরপেক্ষ, সেসব শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে পরামর্শ নিতে হবে। শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা প্রস্তুত নন, অভিভাবকরাও প্রস্তুত নন। অভিযোগ উঠেছে যে, ছাত্ররা এখন পড়তে চায় না। কী এমন করা হলো যে ছাত্ররা পড়তে মনোযোগী হচ্ছে না। এটা জাতির জন্য অশনিসংকেত। 

খবরের কাগজ: শিক্ষার্থীরা কেন পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে না। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অটোপাস দেওয়া হচ্ছে, এতে কি শিক্ষার্থীরা মেধাহীন হয়ে পড়বে না? এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এইচএসসি পরীক্ষায় অটোপাস দেওয়াটা মোটেও ভালো হয়নি। এর আগেও একবার অটোপাস দেওয়া হয়েছিল। আইয়ুব খানের আমলে তিন বছরের বিএ কোর্স চালু করা হয়েছিল। ওই সময়েও ছাত্ররা বিএ কোর্সের মেয়াদ দুই বছর করার জন্য আন্দোলন করেছিল। তখন যারা বিএ কোর্সে দুই বছর অতিক্রম করেছিল তাদের অটোপাস দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই দুর্বলতাটা এখনো আমাদের দেশে রয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে একধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। 

এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় যেভাবে অটোপাস দেওয়া হলো, তাতেও একধরনের শূন্যতা তৈরি হবে। ছাত্ররা নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে না। এসব ছাত্র দিন দিন হীনম্মন্যতায় ভুগবে। তাদের মনের ভেতরে সব সময় একধরনের ব্যাধি কাজ করবে যে, আমরা পরীক্ষা না দিয়েই পাস করেছি। অন্যরাও এদের দেখে বলবে যে, পরীক্ষা না দিয়েই এরা এসেছে। এটা ব্যক্তি মানুষের যেমন সারা জীবনের দুঃখ, তেমনি জাতির জীবনেও এক ধরনের দুঃখ।

খবরের কাগজ: খবরের কাগজের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: খবরের কাগজকেও ধন্যবাদ।

এবার চলো ক্লাসে ফিরে যাই!

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৫৩ এএম
এবার চলো ক্লাসে ফিরে যাই!
রেজানুর রহমান

হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকের অংশ। বাবা আসাদুজ্জামান নূর তার দুই শিশুসন্তানের সঙ্গে কথা বলছিলেন। স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তারা। হঠাৎ স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। বাবা তার দুই সন্তানের (একজন ছেলে অন্যজন মেয়ে) উদ্দেশে বললেন, স্বাধীনতা হচ্ছে নিজের ইচ্ছেমতো বাঁচবার অধিকার। ধরো, আমি যদি নিজের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করি, অন্যের কথায় না, তাহলে আমি স্বাধীন বলা যাবে। মানে আমি যদি কিছু করতে চাই, সেটা অন্য কারও কথায় নয়। 

বাবার কথা শুনে ছেলে বলল, বাবা আমার যে খুব স্বাধীন হতে ইচ্ছে করে। 
বাবা অবাক হয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, বুঝলাম না। স্বাধীন হয়ে তোমরা কী করবে?
ছেলে বলল, নিজের ইচ্ছেমতো থাকব। স্কুলে যাব না। সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসব না। 
বাবা ও ভাইয়ের কথা বেশ মনোযোগসহকারে শুনছিল ছোট্ট মেয়েটি। ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে বলল, দুধ খাব না।
ছেলে বলল, ভাতও খাব না। 

বাবা ভেবে নিয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, এখন থেকে তোমাদের যে কাজ করতে ইচ্ছে করবে না, সে কাজগুলো আর তোমাদের করতে হবে না। তোমরা পুরোপুরি স্বাধীন। 
ছেলে খুশি হয়ে বাবাকে বলল, সত্যি..?
বাবা বললেন, হু...।
ছোট্ট মেয়ে বলল, বাবা আমি জামা খুলে ফেলব?

প্রিয় পাঠক, নাটকের আরও কিছু অংশ বাকি আছে। পরে লিখছি। তার আগে একটু বরিশালে যেতে চাই। বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ ক্যাম্পাসে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে অতি সম্প্রতি। সংঘর্ষে উভয় পক্ষে প্রায় দেড় শ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহত অনেকের অবস্থা গুরুতর। ঘটনার সূত্রপাত কিন্তু লেখাপড়াসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে নয়। 

আশফিয়া আক্তার নামে বিএম কলেজের এক শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা চৌধুরীর পরিবারের জমিজমা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। দুই শিক্ষার্থীর বাড়ি বরিশাল শহরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডে। আশফিয়া ও তাসনুভা একে অন্যের প্রতিবেশী। যত দূর জানা যায়, দুই পরিবারের বিরোধ মেটাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিএম কলেজের একজন সমন্বয়কের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী প্রথমে আশফিয়াদের বাড়িতে যান। 

পরে তারা আশফিয়াদের পক্ষ নিয়ে তাসনুভাদের বাড়িতে গেলে আলোচনার একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। ঘটনার সময় তাসনুভা ফোনে বিষয়টি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহপাঠীদের জানালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী আশফিয়াদের বাড়িতে ছুটে আসেন। দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিএম কলেজ শাখার সমন্বয়ক লাঞ্ছিত হন। এরপর উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারমুখী উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। রাতভর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত চলে। উভয় পক্ষে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেন। 

এখন প্রশ্ন হলো, বরিশালে দুটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন, তা কি সমর্থনযোগ্য? কার জমি কে দখল নেবে? অথবা কে দখল করে দেবে এটাও কি শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে? অবিস্মরণীয় ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মূল রূপকার আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা। তারা দেশ গঠনের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই বলে কারও জমি দখল করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তারা নিতে পারেন কি না, তা ভেবে দেখা জরুরি। 

তবে আমরা বরিশালের ঘটনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তার আগে আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই দেশ গঠনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগান্তকারী ভূমিকার কথা। স্বৈরাচার পতনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে ‘শহিদি মার্চ’ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দুরন্ত সাহস এবং অটুট ঐক্যের দ্যুতি ছড়িয়ে সব বৈষ্যমের বিরুদ্ধে আবারও শিক্ষার্থীরা দীপ্ত স্লোগান দিলেন। 

আবারও স্যালুট শিক্ষার্থীদের। আমরা এবার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে চাই। করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই দেশের শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষাব্যবস্থা। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগেই দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের কাঁধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে। কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন তারা। সময়ের প্রয়োজনে এই আন্দোলন সরকারবিরোধী ছাত্র গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে টিকতে না পেরে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। 

শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থানের ফলস্বরূপ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নতুন রূপে আবিষ্কার করেছি আমরা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সবার প্রিয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন দেশে নতুন প্রত্যাশা, নতুন সম্ভাবনার আলো দেখতে পারছে দেশের মানুষ। 

সারা দেশে এই আলো ছড়িয়ে দিতেই এবার শিক্ষাঙ্গনকে ব্যস্ত দেখতে চায় দেশের সাধারণ মানুষ। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসুক। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখতে চায় দেশের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদ কার্যকর হোক। খেলাধুলার সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসুক। 

মেধাচর্চায় ব্যস্ত হয়ে উঠুক দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- এই প্রত্যাশা দেশের সাধারণ মানুষের। অচিরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সচল না হলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মারাত্মক সেশনজট দেখা দেবে। দেশের ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৯টিরই উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিন-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ভিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যোগ্যতর শিক্ষাবিদ খুঁজে না পাওয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগ বিলম্বিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। সত্যিকার অর্থে এটি আশঙ্কার কথা। 

একটি নতুন দেশ উপহার দেওয়ার জন্য স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে আবারও স্যালুট জানাই। দেশে বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই ভ্যানগার্ড হিসেবে এই সরকারকে সহযোগিতা করবেন। দেশের ১২টি জেলার ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিক্ষার্থীরা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এবার বোধকরি তাদের উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও বেশি সক্রিয় হওয়া। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি ধরি। টিএসসি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব গণতন্ত্রমনা মেধাবী শিক্ষার্থী বিশেষ করে সংস্কৃতিকর্মীদের মেধা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। অথচ বিগত ১০-১৫ বছরে টিএসসি ছিল অনেকটাই অবরুদ্ধ। এবার শিক্ষার্থীরা অচলায়তন ভেঙেছেন। বানভাসি মানুষকে ত্রাণসহায়তা দেওয়ার কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে টিএসসি আবার তার অতীত গৌরব ফিরে পেয়েছে। 

সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার সাংস্কৃতিক চর্চার সেই গৌরবোজ্জ্বল পরিবেশ ফিরে আসুক। ডাকসু আবার সরব হোক। তাহলে গোটা দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে জাগরণ শুরু হবে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের উচিত আরও বেশি করে ক্লাস, পরীক্ষা ও লাইব্রেরিমুখী হওয়া। শহিদি মার্চ কর্মসূচি পালনের দিনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং শিক্ষার্থীদের এবার ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এবার হুমায়ূন আহমেদের সেই নাটকের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। স্কুলে না যাওয়ার আনন্দে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন শিশু, দুই ভাইবোন। তাদের সামনে দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল ৫-৭ জন ছেলেমেয়ে। তাদেরই একজন দুই ভাইবোনকে জিজ্ঞেস করল- কী রে, তোরা স্কুলে যাবি না। 

ভাই উত্তর দিল- আমরা স্কুলে যাব না। কারণ আমরা স্বাধীন। স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা দুই ভাইবোনকে কোনো গুরুত্বই দিল না। তারা স্কুলের দিকে হাঁটতে থাকল। দুই ভাইবোন ফিরে এল বাবার কাছে। পোশাক পাল্টে স্কুলের পোশাক পরতে পরতে ছেলে বাবাকে বলল- বাবা আমরা স্কুলে যাচ্ছি... বাবা খুশি হয়ে বললেন- গুড, ভেরি গুড...।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার
সম্পাদক, আনন্দ আলো

অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকটি জরুরি কাজ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫৫ এএম
অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকটি জরুরি কাজ
আনু মুহাম্মদ

১৫ বছরের স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে অর্থনীতি পরিচালিত হওয়ার পর তরুণদের নেতৃত্ব এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা এসেছে। এমন পরিবর্তনের সম্ভাবনা এর আগেও এসেছিল ১৯৭২ এবং ১৯৯০ সালে। রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার কারণে সেই দুটি সুযোগের কোনোটিই কাজে লাগানো যায়নি। 

এবার কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসেনি। তাই প্রত্যাশার পাশাপাশি আমরা আগের সময়ের ব্যর্থতাকে স্মরণ করি। এখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানি। কিন্তু এই সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বগুলোও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এই সরকার একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। এই সরকারের পেছনে জনগণের সমর্থন রয়েছে। বড় পরিবর্তনের জন্য এই সরকারের তাই অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এই সরকার আগামী এক বা দুই মাসে কী করতে পারে তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি।  

গত ১৫ বছরে ব্যাপক দুর্নীতি, অসংলগ্ন চুক্তি, ব্যাংক ডাকাতি, ঋণখেলাপি এবং মেগা প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। এই সরকারের প্রথম যে কাজটি করা উচিত তা হলো এসব বিষয়ে সব তথ্য প্রকাশ করা। অন্তর্বর্তী সরকার এখন ক্ষমতায় রয়েছে, তাই তাদের উচিত সবকিছুতে স্বচ্ছতা নিয়ে আসা। 

জুলাই-আগস্টের কয়েক সপ্তাহে আমরা যে হত্যাকাণ্ড ও দমন-পীড়ন প্রত্যক্ষ করেছি তার তদন্ত খুব দ্রুত যথাযথভাবে করে দায়ী ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা উচিত। বাংলাদেশে এ ধরনের গণহত্যা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

বিগত সরকারের আমলে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ বিশ্লেষণ করা উচিত। বাংলাদেশে এত উচ্চমাত্রার বৈদেশিক ঋণ এর আগে কখনো ছিল না। সব চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্তদের শনাক্ত করা ও বড় চুক্তিগুলোর বিশদ বিবরণ অবশ্যই জনসমক্ষে আনতে হবে। 

বাংলাদেশের জনগণ এসব ব্যয়বহুল চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানে না। অথচ জনগণকেই এই ঋণ শোধ করতে হবে। এমনভাবে কাজ করা দরকার যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের চুক্তির বিবরণ লুকানো সম্ভব না হয়। কোনো ঋণ নেওয়া বা চুক্তি করা হলে তা অবশ্যই সর্বজনীনভাবে প্রকাশ করা উচিত। কারণ জনগণকেই ঋণ পরিশোধের ভার বহন করতে হয়। 

অনেক মেগা প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোকে গত এক দশকে সরকারের অর্জন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবু সেগুলোর অনেকই এখন বিপর্যয়কর, অনির্ভরযোগ্য ও ঝুঁকিপ্রবণ, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এই মেগা প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করা এই সরকারের দায়িত্ব। উদাহরণস্বরূপ রামপাল প্রকল্প সুন্দরবন ধ্বংস করার ঝুঁকি বহন করছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী আমাদের একমাত্র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। কেন এই প্রকল্প ক্ষতিকর এবং হুমকিস্বরূপ তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা ও বিশ্লেষণ হয়েছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে এক দশক ধরে জনগণ আন্দোলন করেছে। একটি নির্দিষ্ট প্রকল্পের বিরুদ্ধে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য দীর্ঘতম আন্দোলন হয়েছে এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ সমর্থন করেছে। 

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র আমাদের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি। বন এবং নদীবেষ্টিত এমন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এর মতো আর কোনো পারমাণবিক কেন্দ্র বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ধরনের পারমাণবিক প্ল্যান্টের ঝুঁকি যদি কখনো বাস্তবে পরিণত হয়, তাহলে কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। এমনকি এ ধরনের একটি প্রকল্পের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও দেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।

তাই রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালীর মতো প্রকল্পগুলো বাতিল করতেই হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রকল্প বাতিলের জন্য কাগজপত্র ও আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। এখন সবার মনে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘যেহেতু আমরা ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ নিয়েছি এবং অনেক টাকা খরচ করেছি, তাহলে এটা কি বড় আর্থিক ক্ষতি হবে না?’ যে ঋণ জনগণের স্বার্থবিরোধী, সেই ঋণ পরিশোধের দায় জনগণের ওপর বর্তায় না। এই আইন বা কনভেনশন ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে বিদ্যমান এবং সরকার এটি ব্যবহার করতে পারে। 

এমনকি যদি আমরা সেই ছাড় নাও পাই, তার পরও যদি আমাদের এই ঋণ পরিশোধ করতেই হয়, তবু আমি বলব, এই প্রকল্পগুলো চালু রাখার চেয়ে বাতিল করা অনেক বেশি উপকারী হবে।

জ্বালানি খাত বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্নীতির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এই সেক্টরে বড় আকারের ক্ষতি করার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু বেসরকারি কোম্পানি। 

বাংলাদেশে সামিট, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, ইউনাইটেডের মতো বহু প্রতিষ্ঠান এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনা থেকে লাভবান হয়েছে। ভারতের এনটিপিসি এবং আদানি ও আম্বানি, রাশিয়ার রোসাটম ও গাজপ্রম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন ও কনোকো ফিলিপস এবং চীনের চায়না পাওয়ারের মতো প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য ও ক্ষতিকর প্রকল্প থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা আবশ্যক। 

গত দেড় দশক ধরে সম্পূর্ণরূপে বিদেশি পরামর্শদাতাদের তৈরি মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত চলছে। আমাদের এটি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যেসব প্রকল্প পরিবেশগত বিপর্যয়, প্রকৃতির জন্য ধ্বংসাত্মক, আমদানিমুখী এবং বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত, সেগুলো বাতিল করতে হবে। 

পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ, দুর্নীতিমুক্ত নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ খুবই সম্ভব। এতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমবে এবং পরিবেশগত হুমকি দূর হবে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে জোর দিয়ে আমরা এটি অর্জন করতে পারি। অন্তর্বর্তী সরকারকে এই যাত্রা শুরু করতে হবে।

সর্বজনের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যা অবহেলিত হয়েছে। প্রধান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে: সর্বজন শিক্ষা, সর্বজন স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং গণপরিবহন। এসব খাত প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত কম বাজেট এবং উচ্চ অনিয়ম শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে অনেক দিন ধরেই প্রকট হয়ে আছে। সরকার বিশ্বব্যাংকের এমন নব্য উদারনীতি অনুসরণ করে যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাকে মুনাফা সর্বাধিক করার জন্য বেসরকারি খাতের দিকে ঠেলে দেয়। 

গণপরিবহন কিছু অপরাধকারী মাস্টারমাইন্ডের হাতে নিয়ন্ত্রিত। ২০১৮ সালের শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এই সরকারকে অবশ্যই এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য একটি ভিত্তি স্থাপন করতে হবে, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ সম্ভব। 

সংবিধান সংস্কারের আলোচনা শুরু করতে হবে। এটা কীভাবে অত্যন্ত বৈষম্যমূলক, স্বৈরাচারী এবং জনবিরোধী হয়ে উঠেছে, তা চিহ্নিত করতে হবে। কীভাবে জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এক হাতে এত ক্ষমতা কেন? সংবিধানে লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতিগত, ধর্মীয়সহ সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য থাকার পরও একই সংবিধানে বিপরীত ধারা থাকার কারণে এই প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি ভিআইপি সংস্কৃতি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সরকারি অফিসগুলো সর্বজনের জন্য সহজ ও মসৃণ হওয়া উচিত। এ ছাড়া সরকারি দপ্তরের সব কাজের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ