ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, সে জন্য তাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে একসময় দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে দেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের একপর্যায়ে গণভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয় এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এ সময় দেশজুড়ে হত্যা, নৈরাজ্য, খুন, রাহাজানি ছড়িয়ে পড়ে এবং এখনো তা ব্যাপকভাবে বিদ্যমান আছে।
সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার ফলে কার্যত দেশে কোনো সরকার ছিল না। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথের মাধ্যমে সেই অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। বলা বাহুল্য, দেশের এই ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সামনে সম্ভাবনা ও সংস্কারের এক নতুন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কাজেই তাদের বেশ কিছু কাজ খুব দ্রুতগতিতে করতে হবে। পাশাপাশি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের ব্যাপারটিও অন্তর্বর্তী সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।
শেখ হাসিনা সরকারের সময় দেশে কোনো আইনের শাসন ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সব দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। এক কথায় বলা যায়, দেশব্যাপী এতদিন এক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা কায়েম ছিল। বিগত বছরগুলোতে সরকার তার নিজের লোকদের বিভিন্ন পদে বসিয়ে লেজুড়বৃত্তি করার একটি ধারা তৈরি করেছিল। ফলে পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছিল। আজ তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই পালিয়ে গেছেন। দুই দিন আগেও যাদের দাপটে কেউ কথা বলতে পারত না, আজ তাদের অনেকেই পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হচ্ছেন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একপেশে দাম্ভিক শাসকের অবসান ঘটেছে। এ জন্য মানুষ খুব খুশি। জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। দিনমজুর, কৃষক, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সর্বস্তরেরর মানুষের ভেতর এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ছিল।
তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারছে। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। ব্যাংক লুট করে যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যারা দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও চাঁদাবাজি করেছে, তাদের বিচার হওয়া দরকার। বিগত সরকারের সময় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল লাগামহীন।
সাধারণ মানুষের জীবন থেকে পুষ্টিসহ অনেক কিছুই কাটছাঁট করে বাদ দিতে হয়েছিল। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অশুভ ব্যবসায়ী চক্র সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজারে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। একই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট মূল্যতালিকা বেঁধে দিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
বর্তমান সরকারের প্রথম কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজানো। যাতে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং তাদের মধ্যে পুনরায় আস্থা ফিরে আসে। একই সঙ্গে দেশের প্রশাসনকে পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। গত সরকারের সময় প্রশাসন চরম দলীয়করণের শিকার ও ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। যার কিছু কিছু নজির আমরা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি।
যারা সরকারের নিজস্ব পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। দেশ থেকে প্রচুর অর্থকড়ি বাইরে পাচার করেছেন। সেখানে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসাসহ ব্যাংকে বিপুল অর্থের পাহাড় গড়েছেন। অনুসন্ধান করলে প্রশাসনের সর্বত্র এখনো এদের দৌরাত্ম্য পাওয়া যাবে। কাজেই নতুন সরকারকে এদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
সরকারকে প্রশাসনিক সংস্কারের কাজে হাত দিতে হবে। একটি জনবিরোধী প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন করে একটা কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রশাসনকে সুদক্ষ করে গড়ে তোলাই এখন প্রধান কাজ। এর কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া গত সরকারের আমলে দেশে কোনো নির্বাচনব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। সেগুলো মেরামতেও অন্তর্বর্তী সরকারকে নজর দিতে হবে।
নির্বাচন কমিশন, আদালত, জনপ্রশাসনসহ সবকিছুই ছিল বেদখল। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন দলীয়করণের ফলে মানুষের ভেতর এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছিল নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি। সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার হারিয়েছিল। দেশে কোনো নির্বাচনব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের ফলে অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের দখলে চলে যায়। কাজেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচন কমিশনের যে অবস্থা, এটি পুনর্গঠনের বিকল্প নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার কার্যকর কমিশন।
অতীত ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কোটা সংস্কারের মতো একটা ন্যায্য দাবি থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার চূড়ান্ত পরিণতি একটি অভ্যুত্থান ও সরকারের পতন। গত ১৫ বছর ধরে দেশে যে পরিমাণ অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন ঘটেছে, মানুষ তার চূড়ান্ত জবাব দিয়েছে সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা এ সরকার নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক।
ড. ইউনূস একজন সজ্জন ব্যক্তি ও সর্বমহলে সুপরিচিত। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তার একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি আছে। এবার বিশ্ব অলিম্পিকের তিনজন বিশেষ অতিথির মধ্যে তিনি একজন। একই সঙ্গে অলিম্পিক আয়োজনের তিনি একজন বিচারক। বহির্বিশ্বে তার একটি নিজস্ব পরিচয় গড়ে উঠেছে। তিনি তার কাজের ক্ষেত্রে একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করেছেন।
ছাত্রদের আহ্বানে তিনি সাড়া দিয়েছেন এবং দেশ পরিচালনায় এসেছেন, এটা দেশের মানুষের জন্যই মঙ্গলজনক বলে মনে হয়। প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয়ে গঠিত ইউনূস সরকার পরিস্থিতির আলোকে অগ্রাধিকারগুলোতে যেমন ত্বরিত পদক্ষেপ নেবেন, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রের সংস্কার বিষয়েও নজর দেবেন। তার নেতৃত্বে জনমানুষের জীবনে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং সুশাসনের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হবে বলে আমরা আশাবাদী।
লেখক: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)