বিভেদ-বিভাজনের যে দেয়াল, সে দেয়াল ভালো ও মন্দ উভয়েরই জন্য সংকট সৃষ্টি করে। ভালোকে ভালো থাকতে না দেওয়া আর মন্দকে আরও মন্দ হতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে এই সংকটের সুনাম সুবিদিত। উভয়সংকটে পড়ে শুভচিন্তারা শুভ উদ্যোগের পাড়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়ে। আর নানান ধরনের অশুভ আচার-আচরণ পাড়া মাত করে ফেরে।
ষোলো শতকের ব্রিটিশ বণিক ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা স্যার টমাস গ্রেশাম (১৫১৯-১৫৭৯) অনেক বুঝেশুনে এ অবস্থাকে Bad money drive away good money from the market বলে বর্ণনা করেছেন। ভালো আর মন্দকে একসঙ্গে এক পাড়ায় বসবাস করতে দিয়ে ভালোর আলোয় মন্দকে কলুষমুক্ত হতে সাহায্য করা যেখানে উচিত, সেখানে ভালোকে পত্রপাঠ মাঠ থেকে সাজঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ওয়াকওভারের পরিবেশ সৃষ্টি করা সভ্যতার সংকট সৃষ্টির জন্য অতি উপাদেয় উপাদান। অতি সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের গতিধারা এ সত্যের জানান দিয়ে যায় যে, সমাজ ও অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভীপ্সা আকাঙ্ক্ষায় সব পক্ষ ও অনুষঙ্গকে নিরবচ্ছিন্ন নিঃশর্ত ঐকমত্যে পৌঁছানোর তাগিদে সবাইকে বিচ্যুতির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তির অবয়বে আনার বিকল্প নেই।
ঐকমত্যের ওজস্বিতা আর মতানৈক্যের মাশুল সম্পর্কে সবার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সুযোগ, কর্তব্য পালনে দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পোষণ, উদ্দেশ্য অর্জন তথা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোয় ঐকান্তিক প্রয়াসে সমর্পিতচিত্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস জরুরি। এ কথা বলা বাহুল্য যে, জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস-প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতাও একইভাবে অনস্বীকার্য। অপচয়-অপব্যয় রোধ, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সবার মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ ও একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার।
নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলব্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে ওঠে যে নিষ্ঠা ও আকাঙ্ক্ষা, তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন ত্যাগ স্বীকারের। নেতিবাচক মনোভাবের দ্বারা এবং দায়দায়িত্ব পালন ছাড়া গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতা মাত্র। উৎপাদনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেই ফসলের অধিক অধিকারপ্রত্যাশী হওয়াটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক এবং সংগত কর্ম ও ধর্ম নয়। কোনো কিছু অর্জনে বর্জন বা ত্যাগ স্বীকার যেমন জরুরি, তেমনি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বাস্তবতা এ জানান দেয় যে, ন্যায়নীতিনির্ভর, নিরপেক্ষ ও নির্ভার কাণ্ডজ্ঞানের বিকাশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অর্থবহ ও কার্যকর উপস্থিতির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।
উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও নিয়োগ নিয়োজনে বৈষম্যবিহীন পরিবেশ সৃষ্টি করে যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায়, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলতে দেওয়াটাই নানান অসন্তোষ ও দুর্ভোগের কারণ। স্রেফ সুযোগ সংরক্ষণের দ্বারা দায়দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়া কিংবা সরকারি সহায়তা প্রাপ্তির সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনীহা চলে আসে। মানবসম্পদ, মূল্যবান সময় এবং মহার্ঘ পাবলিক ফান্ড অপচয়ের চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণিনির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কীভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব, সেদিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং তা অপ্রদর্শিত রেখে রাষ্ট্রের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেওয়ার মতো অনৈতিক কর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের পরিবেশে বৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও ন্যায্য কর পরিশোধের প্রেরণাকে বিচ্যুতির বলয়ে ঠেলে দেওয়ার নামান্তর।
যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থীর সম্পদের হিসাব অস্পষ্ট রেখে যে অঢেল অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতা চলে, তা যেন এমন এক বিনিয়োগব্যবস্থাকে নির্দেশ করে, যে বিনিয়োগে অবৈধভাবে অধিক উশুলের সুযোগ আছে। জনসেবা সেখানে বণ্টনবৈষম্যের, সামাজিক অবিচারের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ায়। শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণে নিবেদিত চিত্ত হওয়ার বদলে নির্বাচিত নেতৃত্ব নিজেরাই যখন উৎপাদনবিমুখ আর জনস্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভূ বনে যায়, বিচ্যুতির সেই দুঃখজনক পরিবেশে দেখা যায়, যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে, তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। নিজেরা শুল্কমুক্ত সব সুবিধা নিয়ে অন্যদের ওপর নিবর্তনমূলক শুল্ক ও করারোপ প্রচণ্ড স্ববিরোধী, এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সম্পদ বণ্টন, উৎপাদন, উন্নয়ন তথা প্রজাস্বার্থ সংরক্ষণ- সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। নীতিনির্ধারক নিজেই যখন সমন্বিতকরণ ও সেবার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে স্ববিরোধিতায় শোষণের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় আর আত্মস্বার্থ উদ্ধারে আত্মঘাতী প্রবণতায় আকির্ণ হয়ে পড়ে, তখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভাবনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত অবস্থায় যে আপতিত হয় তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। উন্নয়ন বয়ানে প্রগলভপ্রবণ নেতৃত্বের সাম্প্রতিক পলায়ন প্রস্থানও তার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বঙ্গবন্ধুর একটি স্মরণীয় স্বগতোক্তি- ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনো দিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়’। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২৭৩)
সংসার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সবার সচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে অর্থবহ করতে ঐকান্তিক নিষ্ঠার দরকার। দরকার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির। সংসারে নানান বাদ-প্রতিবাদে মানুষ বেড়ে ওঠে, তার দায়দায়িত্ব তদানুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং তা যথাযথভাবে পালনে সংসারের গতির চাকা সচল থাকে নির্দিষ্ট নিয়মে। বিদ্যমান সংকট কাল থেকে দেশ, সমাজ অর্থনীতি এভাবেই প্রবৃদ্ধির পথে যাবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি সব অনুষঙ্গকে সঙ্গ করে সুনিশ্চিত হওয়া দরকার, মাথাপিছু আয়ের হিসাব বৃদ্ধি সব কাণ্ডজ্ঞান ও কর্মকাণ্ডের সমন্বিত অবয়বে হওয়া উচিত। ভোগবাদী সমাজে কতিপয়ের প্রচুর উন্নতির অঙ্ক সমষ্টির সঙ্গে কাগজে-কলমে বিভাজন দেখিয়ে তথাকথিত উন্নতির অবয়ব দেখানোর সংস্কৃতি আত্মপ্রবঞ্চনার প্রতীক।
মানবসম্পদ সৃষ্টি, গণসুস্থতা আর আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার সরোবরে উন্নয়ন অর্থনীতির ফুল বিকশিত হয়। যে সমাজে শিক্ষকতা, চিকিৎসা আর আইন ব্যবসা মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ দিনে দিনে তিরোহিত হয় সে সমাজে বুদ্ধি বৃত্তির বিকাশ ও সমাজসেবার আদর্শ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেখানে সামাজিক সুবিচার ও গণকল্যাণ আকাঙ্ক্ষায় চিড় ধরতে বাধ্য। সুশাসন ও জবাবদিহির পরিবেশ পয়মাল হতে হতে সমূহ সর্বনাশও সহনশীল হয়ে ওঠে। পরীক্ষায় উত্তরণনির্ভর বিদ্যাচর্চায় বাস্তব শিক্ষার লেশমাত্র যে থাকে না, সে উপলব্ধি করতে রূঢ় বাস্তবের মোকাবিলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়লেই দেশে শিক্ষার উন্নতিসহ জনসম্পদ বৃদ্ধি ঘটে না, বরং তাতে স্বল্পশিক্ষিত বেকারের বিকারজনিত সমস্যারই উদ্ভব ঘটে। অসম্পন্ন শিক্ষা সমাধান আনে না বরং সমস্যা বাড়ায়। যে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের করের টাকায় বেতন পান, তার বিনিময়ে তার যে দায়িত্ব পালনের কথা তা পালন না করে বরং তার শিক্ষকতার পরিচয়কে পুঁজি করে অত্যধিক পারিশ্রমিকে গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারই শুধু করেন না, গণশিক্ষার ব্যয় বাড়িয়ে চলেন। সমাজের কাছে যে সম্মান ও সমীহ তার প্রাপ্য, তা তার এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে যায়। অথচ এই একই সমাজে এই কিছুদিন আগেও এমনকি ঔপনিবেশিক পরাধীন পরিবেশেও স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে (তখন সরকারি অনুদান ছিল যৎসামান্য) শিক্ষাদান ছিল নিঃস্বার্থ জ্ঞানদানের বিষয় এবং আত্মত্যাগের আদর্শে ভাস্বর। আর সে সুবাদে শিক্ষক পেতেন সমাজের সর্বোচ্চ সমীহ ও সম্মান। শিক্ষক দায়িত্ববোধের আদর্শ হতেন শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালানোকে ব্রত মনে করতেন শিক্ষকরা। আর আজ কিছু শিক্ষকের মনের দৈন্য অধিক অর্থ উপার্জনের অভীপ্সায় অন্তর্লীন। চিকিৎসাবিদ্যার প্রধান লক্ষ্যই যেখানে হওয়ার কথা দুস্থ-পীড়িতজনকে রোগমুক্তির সন্ধান দেওয়া, সেখানে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি যেন মুখ্য হয়ে না দাঁড়ায় এ মহৎ পেশা। অসুস্থ ব্যক্তির উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়া যেখানে মৌলিক অধিকার সেখানে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাব্যবস্থার নাজুক অবস্থা ও অবহেলায় ক্লিনিকের কসাইয়ের সামনে হাজির হতে হচ্ছে অগণিত অসহায় অসুস্থ মানুষকে। এনজিও দ্বারা কমিউনিটি চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, সেখানে হাসিমুখে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে নবীন-প্রবীণ স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু সরকার পরিচালিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কেন সেবার মান উন্নত হবে না, যদিও সেখানে বাজেটের বিপুল বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় দেখানো হয়ে থাকে। জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাজেটে বিপুল ব্যয় বরাদ্দ দিয়েও সেই সেবা পাওয়ার জন্য সুবিধাপ্রার্থীকে আবার বাড়তি ব্যয়ের বোঝা যাতে বহন করতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করা কর্তব্য। আইনের মারপ্যাঁচে নিজের ন্যায্য দাবি যাতে হারিয়ে না যায়, সে সহায়তা চেয়েই তো অসহায় অশিক্ষিত মক্কেল আসে আইনজীবীর দ্বারে। নিজের পেশাগত দায়িত্ব ও মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অনুক্ষণ অনুযোগ বিচারপ্রার্থীর বোবাকান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশ ও সমাজের স্বার্থকে থোড়াই কেয়ার করে অনেকে বিদেশি বহুমুখী কোম্পানির অনেক অন্যায্য দাবির সপক্ষে অনেকে লবিং করেন স্রেফ পেশাগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থে। ‘সেবা পরম ধর্ম’ কিংবা ‘সততা সর্বোত্তম পন্থা’ এ মহাজন বাক্যরা কি শুধু নীতিকাহিনিতে ঠাঁই পাবে, বাস্তবে তাদের সাক্ষাৎ মেলাতেই হবে।
লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]