ঢাকা ১ আশ্বিন ১৪৩১, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিভেদ বিভাজনের দেয়াল দূর করতে হবে

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:২১ পিএম
আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০২:১৩ পিএম
বিভেদ বিভাজনের দেয়াল দূর করতে হবে
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বিভেদ-বিভাজনের যে দেয়াল, সে দেয়াল ভালো ও মন্দ উভয়েরই জন্য সংকট সৃষ্টি করে। ভালোকে ভালো থাকতে না দেওয়া আর মন্দকে আরও মন্দ হতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে এই সংকটের সুনাম সুবিদিত। উভয়সংকটে পড়ে শুভচিন্তারা শুভ উদ্যোগের পাড়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়ে। আর নানান ধরনের অশুভ আচার-আচরণ পাড়া মাত করে ফেরে। 

ষোলো শতকের ব্রিটিশ বণিক ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা স্যার টমাস গ্রেশাম (১৫১৯-১৫৭৯) অনেক বুঝেশুনে এ অবস্থাকে Bad money drive away good money from the market বলে বর্ণনা করেছেন। ভালো আর মন্দকে একসঙ্গে এক পাড়ায় বসবাস করতে দিয়ে ভালোর আলোয় মন্দকে কলুষমুক্ত হতে সাহায্য করা যেখানে উচিত, সেখানে ভালোকে পত্রপাঠ মাঠ থেকে সাজঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ওয়াকওভারের পরিবেশ সৃষ্টি করা সভ্যতার সংকট সৃষ্টির জন্য অতি উপাদেয় উপাদান। অতি সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের গতিধারা এ সত্যের জানান দিয়ে যায় যে, সমাজ ও অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভীপ্সা আকাঙ্ক্ষায় সব পক্ষ ও অনুষঙ্গকে নিরবচ্ছিন্ন নিঃশর্ত ঐকমত্যে পৌঁছানোর তাগিদে সবাইকে বিচ্যুতির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তির অবয়বে আনার বিকল্প নেই।

ঐকমত্যের ওজস্বিতা আর মতানৈক্যের মাশুল সম্পর্কে সবার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সুযোগ, কর্তব্য পালনে দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পোষণ, উদ্দেশ্য অর্জন তথা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোয় ঐকান্তিক প্রয়াসে সমর্পিতচিত্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস জরুরি। এ কথা বলা বাহুল্য যে, জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস-প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতাও একইভাবে অনস্বীকার্য। অপচয়-অপব্যয় রোধ, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সবার মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ ও একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার।

নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলব্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে ওঠে যে নিষ্ঠা ও আকাঙ্ক্ষা, তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন ত্যাগ স্বীকারের। নেতিবাচক মনোভাবের দ্বারা এবং দায়দায়িত্ব পালন ছাড়া গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতা মাত্র। উৎপাদনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেই ফসলের অধিক অধিকারপ্রত্যাশী হওয়াটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক এবং সংগত কর্ম ও ধর্ম নয়। কোনো কিছু অর্জনে বর্জন বা ত্যাগ স্বীকার যেমন জরুরি, তেমনি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বাস্তবতা এ জানান দেয় যে, ন্যায়নীতিনির্ভর, নিরপেক্ষ ও নির্ভার কাণ্ডজ্ঞানের বিকাশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অর্থবহ ও কার্যকর উপস্থিতির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। 

উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও নিয়োগ নিয়োজনে বৈষম্যবিহীন পরিবেশ সৃষ্টি করে যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায়, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলতে দেওয়াটাই নানান অসন্তোষ ও দুর্ভোগের কারণ। স্রেফ সুযোগ সংরক্ষণের দ্বারা দায়দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়া কিংবা সরকারি সহায়তা প্রাপ্তির সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনীহা চলে আসে। মানবসম্পদ, মূল্যবান সময় এবং মহার্ঘ পাবলিক ফান্ড অপচয়ের চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণিনির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কীভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব, সেদিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং তা অপ্রদর্শিত রেখে রাষ্ট্রের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেওয়ার মতো অনৈতিক কর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের পরিবেশে বৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও ন্যায্য কর পরিশোধের প্রেরণাকে বিচ্যুতির বলয়ে ঠেলে দেওয়ার নামান্তর। 

যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থীর সম্পদের হিসাব অস্পষ্ট রেখে যে অঢেল অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতা চলে, তা যেন এমন এক বিনিয়োগব্যবস্থাকে নির্দেশ করে, যে বিনিয়োগে অবৈধভাবে অধিক উশুলের সুযোগ আছে। জনসেবা সেখানে বণ্টনবৈষম্যের, সামাজিক অবিচারের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ায়। শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণে নিবেদিত চিত্ত হওয়ার বদলে নির্বাচিত নেতৃত্ব নিজেরাই যখন উৎপাদনবিমুখ আর জনস্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভূ বনে যায়, বিচ্যুতির সেই দুঃখজনক পরিবেশে দেখা যায়, যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে, তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। নিজেরা শুল্কমুক্ত সব সুবিধা নিয়ে অন্যদের ওপর নিবর্তনমূলক শুল্ক ও করারোপ প্রচণ্ড স্ববিরোধী, এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সম্পদ বণ্টন, উৎপাদন, উন্নয়ন তথা প্রজাস্বার্থ সংরক্ষণ- সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। নীতিনির্ধারক নিজেই যখন সমন্বিতকরণ ও সেবার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে স্ববিরোধিতায় শোষণের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় আর আত্মস্বার্থ উদ্ধারে আত্মঘাতী প্রবণতায় আকির্ণ হয়ে পড়ে, তখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভাবনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত অবস্থায় যে আপতিত হয় তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। উন্নয়ন বয়ানে প্রগলভপ্রবণ নেতৃত্বের সাম্প্রতিক পলায়ন প্রস্থানও তার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বঙ্গবন্ধুর একটি স্মরণীয় স্বগতোক্তি- ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনো দিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়’। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২৭৩) 

সংসার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সবার সচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে অর্থবহ করতে ঐকান্তিক নিষ্ঠার দরকার। দরকার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির। সংসারে নানান বাদ-প্রতিবাদে মানুষ বেড়ে ওঠে, তার দায়দায়িত্ব তদানুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং তা যথাযথভাবে পালনে সংসারের গতির চাকা সচল থাকে নির্দিষ্ট নিয়মে। বিদ্যমান সংকট কাল থেকে দেশ, সমাজ অর্থনীতি এভাবেই প্রবৃদ্ধির পথে যাবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি সব অনুষঙ্গকে সঙ্গ করে সুনিশ্চিত হওয়া দরকার, মাথাপিছু আয়ের হিসাব বৃদ্ধি সব কাণ্ডজ্ঞান ও কর্মকাণ্ডের সমন্বিত অবয়বে হওয়া উচিত। ভোগবাদী সমাজে কতিপয়ের প্রচুর উন্নতির অঙ্ক সমষ্টির সঙ্গে কাগজে-কলমে বিভাজন দেখিয়ে তথাকথিত উন্নতির অবয়ব দেখানোর সংস্কৃতি আত্মপ্রবঞ্চনার প্রতীক। 

মানবসম্পদ সৃষ্টি, গণসুস্থতা আর আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার সরোবরে উন্নয়ন অর্থনীতির ফুল বিকশিত হয়। যে সমাজে শিক্ষকতা, চিকিৎসা আর আইন ব্যবসা মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ দিনে দিনে তিরোহিত হয় সে সমাজে বুদ্ধি বৃত্তির বিকাশ ও সমাজসেবার আদর্শ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেখানে সামাজিক সুবিচার ও গণকল্যাণ আকাঙ্ক্ষায় চিড় ধরতে বাধ্য। সুশাসন ও জবাবদিহির পরিবেশ পয়মাল হতে হতে সমূহ সর্বনাশও সহনশীল হয়ে ওঠে। পরীক্ষায় উত্তরণনির্ভর বিদ্যাচর্চায় বাস্তব শিক্ষার লেশমাত্র যে থাকে না, সে উপলব্ধি করতে রূঢ় বাস্তবের মোকাবিলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়লেই দেশে শিক্ষার উন্নতিসহ জনসম্পদ বৃদ্ধি ঘটে না, বরং তাতে স্বল্পশিক্ষিত বেকারের বিকারজনিত সমস্যারই উদ্ভব ঘটে। অসম্পন্ন শিক্ষা সমাধান আনে না বরং সমস্যা বাড়ায়। যে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের করের টাকায় বেতন পান, তার বিনিময়ে তার যে দায়িত্ব পালনের কথা তা পালন না করে বরং তার শিক্ষকতার পরিচয়কে পুঁজি করে অত্যধিক পারিশ্রমিকে গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারই শুধু করেন না, গণশিক্ষার ব্যয় বাড়িয়ে চলেন। সমাজের কাছে যে সম্মান ও সমীহ তার প্রাপ্য, তা তার এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে যায়। অথচ এই একই সমাজে এই কিছুদিন আগেও এমনকি ঔপনিবেশিক পরাধীন পরিবেশেও স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে (তখন সরকারি অনুদান ছিল যৎসামান্য) শিক্ষাদান ছিল নিঃস্বার্থ জ্ঞানদানের বিষয় এবং আত্মত্যাগের আদর্শে ভাস্বর। আর সে সুবাদে শিক্ষক পেতেন সমাজের সর্বোচ্চ সমীহ ও সম্মান। শিক্ষক দায়িত্ববোধের আদর্শ হতেন শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার্থীদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালানোকে ব্রত মনে করতেন শিক্ষকরা। আর আজ কিছু শিক্ষকের মনের দৈন্য অধিক অর্থ উপার্জনের অভীপ্সায় অন্তর্লীন। চিকিৎসাবিদ্যার প্রধান লক্ষ্যই যেখানে হওয়ার কথা দুস্থ-পীড়িতজনকে রোগমুক্তির সন্ধান দেওয়া, সেখানে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি যেন মুখ্য হয়ে না দাঁড়ায় এ মহৎ পেশা। অসুস্থ ব্যক্তির উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়া যেখানে মৌলিক অধিকার সেখানে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাব্যবস্থার নাজুক অবস্থা ও অবহেলায় ক্লিনিকের কসাইয়ের সামনে হাজির হতে হচ্ছে অগণিত অসহায় অসুস্থ মানুষকে। এনজিও দ্বারা কমিউনিটি চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, সেখানে হাসিমুখে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে নবীন-প্রবীণ স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু সরকার পরিচালিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কেন সেবার মান উন্নত হবে না, যদিও সেখানে বাজেটের বিপুল বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় দেখানো হয়ে থাকে। জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাজেটে বিপুল ব্যয় বরাদ্দ দিয়েও সেই সেবা পাওয়ার জন্য সুবিধাপ্রার্থীকে আবার বাড়তি ব্যয়ের বোঝা যাতে বহন করতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করা কর্তব্য। আইনের মারপ্যাঁচে নিজের ন্যায্য দাবি যাতে হারিয়ে না যায়, সে সহায়তা চেয়েই তো অসহায় অশিক্ষিত মক্কেল আসে আইনজীবীর দ্বারে। নিজের পেশাগত দায়িত্ব ও মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অনুক্ষণ অনুযোগ বিচারপ্রার্থীর বোবাকান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশ ও সমাজের স্বার্থকে থোড়াই কেয়ার করে অনেকে বিদেশি বহুমুখী কোম্পানির অনেক অন্যায্য দাবির সপক্ষে অনেকে লবিং করেন স্রেফ পেশাগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থে। ‘সেবা পরম ধর্ম’ কিংবা ‘সততা সর্বোত্তম পন্থা’ এ মহাজন বাক্যরা কি শুধু নীতিকাহিনিতে ঠাঁই পাবে, বাস্তবে তাদের সাক্ষাৎ মেলাতেই হবে। 

লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]

বিশেষ সাক্ষাৎকার: তানজীমউদ্দিন খান সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমেই শুরু হোক রাষ্ট্র সংস্কার

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০০ পিএম
সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমেই শুরু হোক রাষ্ট্র সংস্কার
তানজীমউদ্দিন খান

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন রূপরেখা নিয়ে কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান তানজীমউদ্দিন খান। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পূর্ণকালীন সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিনিয়র সহ-সম্পাদক সানজিদ সকাল

খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের ইতিহাস পরিবর্তনের এক ক্রান্তিকালে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্র সংস্কার কিভাবে করা যায় বলে আপনি মনে করেন?

তানজীমউদ্দিন খান: সংবিধানের ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রকে সংস্কার করতে হলে সংবিধান পর্যালোচনা জরুরি। বর্তমান সময়ের রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। কারণ গত ১৬ বছর দেশে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট সরকার রাজত্ব করেছে। এই ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা। এই সরকার এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে সংবিধানে এমন কিছু উপাদান যুক্ত করা আছে, যার মাধ্যমে এক কর্তৃত্ব বা আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে একক কর্তৃত্ব বা ব্যক্তিবাদী রাজনীতিকে নিশ্চিত করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে সংবিধান প্রণীত হওয়ার ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। যার ফলে সংসদের যিনি সরকারি দলের নেতা থাকেন, তিনিই সরকারপ্রধান হন। ঠিক একইভাবে যারা এমপি থাকেন, তারাই সরকারে থাকেন। তাদের মধ্য থেকেই মন্ত্রী বা ক্যাবিনেট গঠন করা হয়। যার ফলে কে বা কাকে জবাবদিহি করবে? আইন প্রণেতারা যখন নিজেই মন্ত্রী হন, তখন কে কাকে জবাবদিহির আওতায় আনবে। উপরন্তু, যিনি সরকারি দলের সংসদীয় নেতা বা নেত্রী হন, তিনিই আবার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। বর্তমান পদ্ধতিতে জবাবদিহির আর কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে সংবিধান সংশোধনের বা সংস্কারের জন্য কাজ করা বিশেষ জরুরি। স্বৈরাচারী কাঠামো সংবিধান থেকে দ্রুতই বিলুপ্ত করতে হবে।

খবরের কাগজ: দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা কিভাবে সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?

তানজীমউদ্দিন খান:  গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে গেলে আমাদের কাঠামোগত নীতির পরিবর্তন করতে হবে। নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়েও নতুন করে ভাবনা খুবই জরুরি। আমাদের নির্বাচনি ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের নির্বাচনি ব্যবস্থা। যে রাজনৈতিক দল সবচেয়ে বেশি আসন পায়, তারা সবকিছুই তাদের অধীনস্থ করতে চায়। কিন্তু যারা সংখ্যায় কম আসন পায় বা যাদের জন সমর্থন কম, তাদের কিন্তু সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকে না। সে অর্থে নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় কিভাবে সবার আংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়টা ভাবতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এই আন্দোলন বা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টা আলোচনায় আসছে তা হলো রাষ্ট্র সংস্কার। রাষ্ট্র সংস্কারের যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে তা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে গণতান্ত্রিক কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। সব মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠভিত্তিক যে নির্বাচনি ব্যবস্থা, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আনুপাতিক ভোটের প্রেক্ষাপটে সংসদের আসন বণ্টন করা যায় কি না সেটা ভাবতে হবে। আমাদের মূল লক্ষ্যটা হবে সত্যিকারের একটা জন-গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ৫৩ বছর ধরে যে বিভক্তির রাজনীতি হয়ে আসছে, তাতে একেকজন একেক ধরনের বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। বিভক্তির রাজনীতিকে জনপ্রিয় করার মধ্য দিয়ে পুরো দেশের সংহতি বিনষ্ট হয়েছে। এবারের গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা তা হচ্ছে মানুষের মধ্যে সংহতি, ঐক্যবদ্ধতা ও একতা তৈরি হয়েছে। তবে এই  ঐক্যবদ্ধতাকে যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হয়, তা হলে সংবিধানের সংশোধন বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। ঠিক একইভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থাপনা ঠিক করা খুবই জরুরি। শুধু এখানে থেমে থাকলেই হবে না, আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলছি- সেই গণতন্ত্রের চর্চা প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের মধ্যেও করতে হবে। শুধু প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবে না- এটা নিশ্চিত করলেই হবে না। কেউ যদি পরপর দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, তা হলে তার তৃতীয়বারের মতো হওয়ার সুযোগ থাকে। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই তার জনপ্রিয়তা থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও সংস্কার করা দরকার। রাজনৈতিক দলের সভাপতি যিনি হচ্ছেন, তিনিই সারা জীবন ওই দলের সভাপতি থেকে যাচ্ছেন। এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলের যদি নিজস্ব গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে না ওঠে, গণতন্ত্রের চর্চা যদি না হয়, শুধু জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র, সেই গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে না। জাতীয় পর্যায়ে যেমন জন-গণতান্ত্রিক কাঠামো নিশ্চিত করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে এককভাবে কারও আধিপত্য বা দলের ভেতরে কেউ স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে টিকে থাকতে না পারে। 

খবরের কাগজ: প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো ভাটা পড়েছে কি না, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?  

তানজীমউদ্দিন খান: প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুপ্রতিম হওয়া উচিত। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যেভাবে তার ন্যায্য পাওনা ছিল, তা যথাযথভাবে সেই স্বার্থ রক্ষা করতে পারেনি। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রেও যে বিষয়গুলো  ভারতের গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তা দেয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশের যে বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যেমন- সীমান্ত সংঘাত ও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, পানির হিস্যা, ট্রেড ব্যালেন্স, বাণিজ্য ঘাটতি- সেগুলোতে ভারতের যতটুকু সোচ্চার থাকার কথা ছিল, তা থাকেনি। তার মানে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে একটা রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেকটা রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক, তা বজায় ছিল না। দুই দেশের সম্পর্ক ছিল ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক। আমাদের সরকারপ্রধানের ব্যক্তি সম্পর্ককে ঘিরেই জাতীয় স্বার্থকে তুচ্ছ করে ভারতের নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বন্দরের স্বার্থকে রক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো দরকষাকষির উপাদান রয়েছে, সেগুলোতে আমাদের নিজেদের স্বার্থকে রক্ষা না করে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য আদানির সঙ্গে যে চুক্তি, সেখানেও আমাদের দেশের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না। অল্প কয়েক দিনেই বাংলাদেশের কাছে যে পাওনার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে, তা অচিন্তনীয়।  ভারত সরকারের সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ীর সুসম্পর্ক, সেইসব ব্যবসায়ীকেই বাংলাদেশে ব্যবসা ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহণে স্বার্থ নিশ্চিত করেছে। ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতে যে চুক্তিটা হয়েছে, তা অসম চুক্তি। অনেক বেশি মূল্য দিয়ে বাংলাদেশকে আদানি থেকে বিদ্যুৎ আনতে হয়েছে। ভারতের সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবসায়ী বা দলকে সন্তুষ্ট করতে শেখ হাসিনা সরকার অনেক বেশি মনোযোগী ছিল। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের যে নির্বাচনি ব্যবস্থা ছিল তা অগণতান্ত্রিক, যার কোনো বৈধতা ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করতেই ভারতকে সমর্থন করে গিয়েছে। এভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষিত হয়নি।

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে কি আপনি মনে করেন? সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো ঘাটতি বা পরিবর্তন হতে পারে কি না?     

তানজীমউদ্দিন খান: চীনের সঙ্গে আগে থেকেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন ছিল। কিন্তু কোনোমতেই একদম বৈরী সম্পর্ক ছিল না। ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্কটা এতটায় একপেশে ছিল যে, দেশে একজন ব্যক্তির অনুপস্থিতির কারণে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে মানুষ বেশি চিন্তা করছে। এই জিনিসটা  স্বাভাবিকভাবেই হতো না, যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক তৈরি হতো। অনেকেই মনে করতে পারে যে, এই মুহূর্তে আমেরিকা ও চীন বেশি সুবিধা আদায় করতে পারে বাংলাদেশ থেকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে কিন্তু সব সময় এমন দেখা যায় না। কেউ কেউ প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে এটা ঠিক। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এশিয়া নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এশিয়া প্যাসিফিক ও চীনের সিল্ক রোড নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, সেহেতু বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মানেই হচ্ছে আমাদের এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দরকষাকষির একটা সুবিধা আছে। আমাদের সেই দরকষাকষির জায়গাটা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারছি কি না দেখতে হবে। বাংলাদেশের এখন অর্থনৈতিক মুক্তি দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আমাদের চিন্তামুক্ত রাখতে পারছি কি না তা দেখতে হবে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কতটুকু দক্ষতার পরিচয় দেয় ও তৎপর থাকে, তার ওপর নির্ভর করছে।

খবরের কাগজ: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন? 

তানজীমউদ্দিন খান: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কের ঘাটতি অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। গত ১৬ বছরে আমরা যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ছিলাম, তাতে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। এটাকে স্বৈরাচারী শাসনও বলতে চাই না। কারণ এটিকে ফ্যাসিজম বা অটোফ্যাসিজমের চাইতেও বেশি কিছু। যার কারণেই এটাকে আমি এক ব্যক্তিবাদী শাসনব্যবস্থা বলে থাকি। শিক্ষাব্যবস্থাও এক ব্যক্তিবাদী শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যারা প্রধান ছিলেন, তারা দলীয় পরিচয়টাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে অপব্যবহার করেছেন। যার ফলে শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কটা হচ্ছে ক্ষমতার সম্পর্ক। যে দলের কারণে ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেই দল এখন ক্ষমতা নাই, সে কারণেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আজকের এই অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

খবরের কাগজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে।  শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার?

তানজীমউদ্দিন খান: দেশের আইন-শৃঙ্খলা এখনো স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসেনি। এর প্রভাব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা প্রথম উদাহরণ যে, কোনো দলের প্রধান বা একজন ব্যক্তি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রভিসিরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পালিয়েছেন। পৃথিবীর কোনো দেশে কখনো এমন হয়নি।  দলীয়করণ কেমন মাত্রায় গেলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়! বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা ওই রাজনৈতিক দলের অংশ হয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবর্তে দলের স্বার্থটাই তারা বড় করে দেখেছেন। যার ফলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোটাই ভেঙে পড়েছে।  শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ফিরিয়ে আনার জন্য তৎপর থাকা উচিত ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা কীসের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে? সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে কি না, তাও অস্পষ্ট। অল্প কিছুদিনের মধ্যে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসতে যতটুকু আশা করেছিলাম, ততটুকুও আসছে না।  

খবরের কাগজ: খবরের কাগজকে সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

তানজীমউদ্দিন খান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষায় সিরাত চর্চার প্রাসঙ্গিকতা

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ পিএম
ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষায় সিরাত চর্চার প্রাসঙ্গিকতা
ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন

সিরাতের প্রধান উৎস কোরআন এবং সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের ঘটনাগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্মে অন্তর থেকে মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে এবং তা অত্যন্ত যত্নসহকারে সংরক্ষিত হয়েছে। মুসলিম পণ্ডিতরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের বর্ণনাগুলো সংরক্ষণের জন্য নির্ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। মিথ্যা বা ভুল তথ্যের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকেছেন। সিরাতের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, এটি শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক বিবরণ নয়; বরং এটি নবুয়তের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং অলৌকিক ঘটনার বর্ণনাও ধারণ করে। মুসলিম পণ্ডিতরা সিরাতের বর্ণনাকে এই বৈশিষ্ট্যগুলোসহ গ্রহণ করেছেন, যা ইসলামি বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত এবং আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিফলিত করে।

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনী অধ্যয়নে প্রাচ্যবিদদের সিরাত অধ্যয়নের পদ্ধতির ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি, কারণ তারা প্রায়ই সিরাত বোঝার মৌলিক দিকগুলো উপেক্ষা করে। তারা সিরাতের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা কৌশলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন দিকের ওপর প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যে ফেতনা ছড়িয়েছে। এজন্য সিরাতুন্নবিকে শুধু একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিচার না করে; বরং ইসলামের মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতিফলন হিসেবে দেখা উচিত।

সিরাতুন্নবি ইসলামের মূল শিক্ষা ও মূল্যবোধের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন কোরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা—যা মুসলমানদের জন্য অনুপম আদর্শ। সিরাত পাঠের মাধ্যমে শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো বোঝা যায়। এই শিক্ষা শুধু আইনগত দিক নয়; বরং সমাজের মানবিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন কোরআনের পাঠ ও উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে। সিরাতের ব্যাখ্যা ছাড়া কোরআনের গভীর তত্ত্ব ও আদর্শ সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব নয়। তাই সিরাতুন্নবির পাঠ কোরআনের মূল উদ্দেশ্য এবং ইসলামিক শিক্ষার গভীরতার প্রতিফলন। আয়েশা (রা.)-এর পরিভাষায় সমগ্র কোরআনই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত তথা জীবনকর্ম। যে সামগ্রিক কর্ম অন্যান্য সকল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকারের সঙ্গে নারীর মুক্তি ও অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীদের অধিকার সমুন্নত করেছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সাম্যের শিক্ষার যে ঘাটতি আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী থেকে এর শিক্ষা ও দীক্ষা নিতে হবে। 

সিরাতুন্নবি থেকে আমরা যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও মূল্যবোধ পাই, এর মধ্যে অন্যতম হলো সমাজের ন্যায়পরায়ণতা, মানবিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। সিরাতের শিক্ষা হলো শ্রেণিবিভাগ, দাসত্ব, এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে সমান মানবিক মর্যাদা প্রদান করা। মদিনার জীবনে নবিজি (সা.)-এর সংগ্রাম এবং হিজরতের ঘটনা মানবসমাজের মুক্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। হিজরত ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা ঈমান রক্ষার জন্য আত্মত্যাগের নির্দেশ দেয়। এটি মুসলমানদের জন্য একটি প্রতিরোধের প্রতীক, যা তাদের বিশ্বাস ও মানবিক মর্যাদা রক্ষায় উৎসাহিত করে।

সিরাতের শিক্ষা শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য ও বিধানগুলো সঠিকভাবে বুঝতে সহায়ক। সিরাতের মাধ্যমে মুসলিম পণ্ডিতরা শরিয়তের বিধানগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন এবং এর রুহ বা আত্মা সম্পর্কে ধারণা পান। শরিয়তের রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক দিকগুলো সিরাতের আলোকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন—যাতে তা সমাজের কল্যাণে প্রয়োগ করা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে দুর্নীতির যে রাহুগ্রাস, সামাজিক অবিচার আর বৈষম্যের মাধ্যমে নৈতিকতার যে খরা চলছে; এ থেকে উত্তরণে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী উত্তম নেয়ামত হতে পারে। এ জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনকর্ম ইসলামি চিন্তা ও আদর্শের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সিরাতের শিক্ষা ইসলামি সমাজের বিকাশের জন্য অপরিহার্য—কারণ এটি মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু সমাজ গঠনের নির্দেশ দেয়। সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সমাজের কল্যাণের জন্য ত্যাগ ও আত্মত্যাগ অপরিহার্য এবং ইসলামের মূল মূল্যবোধগুলো সর্বদা সমাজে প্রতিফলিত হতে হবে। সিরাতুন্নবি আমাদেরকে সমাজের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে এবং আমাদের বিশ্বাস ও নৈতিক আদর্শকে সবসময় রক্ষা করতে শেখায়। এই শিক্ষাগুলো ইসলামি সমাজের জন্য একটি স্থায়ী আদর্শ হিসেবে কাজ করে, যা তাদের নৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয়। আরলন্ড, বেকনসহ অনেক পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরাও জীবন চলার পথে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন চেতনা থেকে শিক্ষার অপরিহার্যতা স্বীকার করেছেন। 

সত্যিকারার্থে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ইসলামি মূল্যবোধের একটি অনন্য উৎস—যা শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য এবং ইসলামের নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি তৈরি করে। সিরাতুন্নবি মানবসমাজের জন্য একটি আদর্শ—যা সমাজের নৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের লক্ষে কাজ করে। ইসলামের মূল আদর্শ ও মূল্যবোধ বোঝার জন্য সিরাতের পাঠ অপরিহার্য। 

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে প্রশ্ন ও প্রত্যাশা

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ এএম
অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে প্রশ্ন ও প্রত্যাশা
ড. তোফায়েল আহমেদ

বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট, ২০২৪-এ শপথ গ্রহণ করে। এ সরকার পূর্ববর্তী তিন বা চারটি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের ঐতিহ্যের অনুবর্তী হলেও প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকার, বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও লতিফুর রহমানের দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের বিধানবলে গঠিত এবং সংবিধান নির্ধারিত সময়ে তারা দায়িত্ব শেষ করেন। 

বিরাজিত সরকার কাঠামোয় একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থায় তারা কাজের সুযোগ পান। তুমুল একটি হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার অকার্যকর হয়ে পড়লে ২০০৭-০৮-এ ভিন্ন প্রকৃতির একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ভালো বিকল্প না পাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলেরই দায় ছিল। বিএনপি বিচারপতির অবসরের বয়স বাড়ানোয় আওয়ামী লীগ সিরিয়ালে থাকা সর্বশেষ অবসরে যাওয়া বিচারপতি মাসুদকে মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং বিএনপিও অন্য বিকল্প অনুসন্ধান না করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দায়িত্ব দিয়ে বসে। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। 

১/১১-এর সরকারের কাজকর্ম নিয়ে ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে নানা কটু মন্তব্য করলেও তারাই জাতীয় সংসদে দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব কাজকর্ম ও পরিবর্তন সাপেক্ষে আইনকানুনের বৈধতা দান করে। কিছু ধারা পরিবর্তনের নমুনা, যেমন- উপজেলা পরিষদ আইনে ‘জাতীয় সংসদ সদস্যকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করা ও পরিষদ উপদেষ্টার উপদেশ শুনবে’- এ জাতীয় ধারা সংয়োজন করা হয়। 

যেটি ছিল পরিষদকে অকার্যকর করার একটি অন্যতম হাতিয়ার। আবার ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ আইনটি তারা রেকটিফাই করেননি। ফলে কমিশন অকার্যকর হয়ে পড়ে। দুই বছরের শাসনকালের সেই সরকার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ বেশুমার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির মামলা দায়ের করে। আওয়ামী লীগের সরকার গঠিত হওয়ার পর শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের সবার কয়েক হাজার মামলা প্রত্যাহার হয়ে যায়। 

কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দল বিএনপির সবার মামলা বহাল থাকে এবং দ্রুততার সঙ্গে বিচার ও শাস্তি-প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন ও কর্ম-প্রক্রিয়া আলোচনার আগে এ প্রাসঙ্গিক ইতিহাস অনেক কারণে মনে করার প্রযোজন রয়েছে। কারণ কোনো নতুন ঘটনা-দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে আমরা অবলীলাক্রমে অতীত ভুলে যাই বা ভুলে যাওয়ার ভান করি।

২০২৪-এর অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে আলোচনার প্রথম বিষয় হচ্ছে, এ সরকারের সঙ্গে পূর্ববর্তী চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে প্রেক্ষাপটগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও সমস্যার বিচারে পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য রয়েছে। অনেক প্রশ্ন অনেকে ওঠাচ্ছেন, এ সরকার কবে যাবে? কিন্তু এ প্রশ্নগুলো যৌক্তিকভাবে ওঠাতে গেলে বেশি না হলেও অন্তত দুই বছর এ সরকারকে সময় দেওয়ার প্রশ্ন আসবে। 

লাগলে হয়তো আরও বেশিও দিতে হতে পারে। সরকারের কাজ শুরুর আগে যদি কেউ বলতে শুরু করেন- আপনি কবে যাবেন, তা খুব অন্যায্য ও হঠকারিতা। ৮ আগস্ট ২০২৪-এ শপথ নেওয়ার পর মাত্র এক মাস গত হলো। যদি প্রশ্ন করা হয়,  ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থান না হলে আওয়ামী লীগ আরও কয় বছর ক্ষমতায় থাকত? কখন কবে নাগাদ নির্দলীয় সরকারের অধীনে রাজনৈতিক সমতলভূমিতে নির্বাচন পাওয়া যেত। তার সদুত্তর পাওয়া কঠিন।

সব ধরনের শূন্যতার মাঝে একটি ‘সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু ‘শাসন’ এখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শুধু একটি নির্বাচন করার জন্য এ সরকার গঠিত হয়নি। এ সরকারের ম্যান্ডেট অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। দেশে পরিপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রের নানামুখী সংস্কার কর্মসূচির। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা পাওয়া গেছে। বিশেষত সংস্কার বিষয়ে কমিশন গঠন তার একটি স্পষ্ট ও বাস্তব পদক্ষেপ। সংস্কারের ক্ষেত্রেও সবকিছু অন্তর্বর্তী সরকার পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে তা হলফ করে বলা যায় না, না পারলেও একটি পথ রচনা করে দিয়ে যেতে পারবে।

এ সময়ের মধ্যে বিএনপিসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল বা জোটকে একটি ভালো নির্বাচনের জন্য নিজেদের পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত করতে হবে। প্রতিটি দলের গঠনতন্ত্র ও সাংগঠনিক কাঠামোর গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং প্রত্যেক প্রার্থীর উচ্চ গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থীর শিক্ষা, নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা, অপরাধ, কালোটাকা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি নিয়ে সংবিধানে অনেক কিছুই সর্বজনীনতার খাতিরে অনুপস্থিত হলেও আরপিও, আচরণবিধি এবং হলফনামার আট তথ্যের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি মনোনয়নকে জনপ্রত্যাশার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়। এবার সে প্রচেষ্টা আন্তরিকভাবে করতে হবে। 

স্বাভাবিক রাজনৈতিক কারণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত এবং গণতন্ত্রমনা অন্যান্য ডান, বাম ও মধ্যপন্থি দলগুলো আওয়ামী লীগের বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ নেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা নিশ্চয়ই সেভাবে নিজেদের সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত করছেন। কিন্তু দেশ পরিচালনার নীতিনির্ধারণ ও যোগ্য নেতৃত্ব বাছাইয়ে তারা কতটুকু প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন, সেটি জাতি দেখতে চাইবে। সে জন্য এখন একটি স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশ তারা পাচ্ছেন। আশা করি, সে সুযোগ গ্রহণ করে তারা নিজেদের ভালোভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন এবং দল পুনর্গঠন করে নেবেন।

ইতোমধ্যে বিএনপি-জামায়াতসহ সব বাম দল ও মোর্চা সরকারের সঙ্গে সভা করে তাদের মতামত দিয়েছে, সে জন্য তাদের অভিনন্দন। এটিই জাতি আশা করছিল। এখানে জাতীয় পার্টি নিয়ে বড় একটি প্রশ্ন আছে। রাজনীতিতে সুবিধাবাদের জনবিরোধী ভূমিকাকে চিরতরে শেষ করার প্রচেষ্টা হিসেবেই জাতীয় পার্টির ভূমিকার বিষয়টি মনে রাখতে হবে। এ দলটি গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বৈধতা দিয়েছে। সময়-সুযোগে বর্তমানে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের অনুগ্রহের দায় শোধে এ ভদ্র ও শিষ্ট চেহারা ভবিষ্যতে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। 

গোলাম মোহাম্মদ কাদের নির্বাচনের আগে ভারত গিয়ে সবকও নিয়েছিলেন। আবার তা জনসমক্ষে প্রকাশে অস্বীকারও করেছিলেন। এসব কুকাজের জন্য তারা কি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বা তাদের বর্তমান অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন বলে জানা নেই। আওয়ামী লীগ যদি ফ্যাসিস্ট ও গণহত্যাকারী দল হিসেবে চিহ্নিত হয়; জাতীয় পার্টিও তার অনুগত ও বিশ্বস্ত দোসর হিসেবে দোষী হবে।

দেশের মানুষ একটি স্বচ্ছ রাজনীতি ও সুষ্ঠু নির্বাচন, দলনিরপেক্ষ পেশাদার প্রশাসন, নীতিনৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, সুদক্ষ অর্থব্যবস্থা তথা পেশাদার ও দায়িত্বশীল ব্যাংক, ব্যাংকার ও ব্যবস্থাপক দেখতে চায়। দেশের সব নাগরিক ও পেশাদার সংঘ-সমিতি একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের রূপ নিয়েছিল, অনেকে সরকারের দায়িত্বশীল পদে বসে রাজনীতির স্লোগান ধরেছেন এবং দুহাতে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়েছেন, পাচার করেছেন, তাদের বিচার নিশ্চয়ই হবে। 

ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশের স্বার্থে কাউকে ছাড় দিতে হবে- এ কথা যেন না বলা হয়। কোনো কোনো দল ও মহল বলতে শুরু করেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, এমন কিছু যেন না করা হয়। অনেকে রপ্তানি করে তার জন্য প্রণোদনার অর্থ গ্রহণ করে; আবার রপ্তানির মাধ্যমে আয় করা অর্থ বিদেশে রেখে জালিয়াতি করেছেন। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নানা খাতে অন্যায্য মুনাফা, ব্যাংকের অর্থ ও নানা সংস্থার পদ-পদবি বাগিয়ে লুটপাট করেছেন, তাদের ছাড় ও ছেড়ে দেওয়া চলবে না। 

সংবিধানের প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। সে জন্য দ্বিকক্ষবিশিস্ট জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা একটি অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে। নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার, যেমন- ‘সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ও অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য ‘পোস্টাল ব্যালট’ চালুর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। শিকড় থেকে শিখর পর্যন্ত দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনের অধিকর্তাদের নিজ নিজ পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকবে। তারা কখনো কোনো দলের আজ্ঞাবহ নয়, তারা হবেন প্রজাতন্ত্রের গর্বিত জনসেবক। 

স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে গণতন্ত্রমুখী ধারায় পুনর্গঠিত করতে হবে। ‘দেশের মালিক দেশের জনগণ’- এ বোধ ও সংস্কৃতি হবে সরকারের মূল দর্শন এবং সরকার হবে স্মল ও স্মার্ট। এগুলো হলো এ সরকার থেকে গণপ্রত্যাশা। সবটা এ সরকার করতে পারবে তা নয়। এখানে এসব প্রত্যাশার দিকগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি পথরেখা তৈরি করবে এবং আগামীর নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে এগুলো নিয়ে বোঝাপড়ার বিষয় আছে। জাতি স্পষ্টভাবে সে রকম একটি বোঝাপড়া দেখতে চাইবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
tofailahmed.info

জেন জেড এবং দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২১ এএম
জেন জেড এবং দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি
ড. মতিউর রহমান

জেন জেড প্রজন্ম, যারা সাধারণত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন, সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে তারা বেড়ে উঠেছে। 

ফলে তারা তাদের পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা চিন্তাধারা ও আচরণধারাসম্পন্ন। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এবং ভোক্তা বাজারে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথে তাদের প্রভাব আরও বেশি করে প্রতিফলিত হবে। জেন জেড প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তাদের ডিজিটাল দক্ষতা। ইন্টারনেটের যুগে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্ম স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত। তাদের এই প্রযুক্তিগত পারদর্শিতা বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম।

প্রজন্ম জেডের ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং খুচরা বিক্রিসহ সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটছে। এই প্রজন্মের ডিজিটাল পেমেন্ট এবং অনলাইন শপিংয়ের প্রতি আগ্রহ বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। প্রযুক্তি দক্ষতার কারণে জেন জেড প্রজন্ম উদীয়মান গিগ অর্থনীতিতে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। প্রচলিত চাকরির বাজারের কঠিন নিয়মের পরিবর্তে গিগ অর্থনীতি তাদের স্বাধীনতা ও নমনীয়তার স্বাদ দিয়েছে।

বাংলাদেশের যুবকদের বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক হলেও গিগ অর্থনীতি তাদের জন্য আয়ের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট ওয়ার্ক এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে তরুণরা তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বাড়ি থেকেই আয় করার সুযোগ পাচ্ছে। এই নতুন কর্মসংস্থান পদ্ধতি শ্রমবাজারে বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বিতরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে গভীর প্রভাব ফেলছে।

জেন জেড প্রজন্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাদের উদ্যোক্তা মনোভাব। তারা অনেকেই নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে বা স্টার্টআপে যোগ দিতে আগ্রহী। এই উদ্যোক্তা মনোভাবের পেছনে স্বাধীনভাবে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা এবং প্রচলিত চাকরি বাজারের সীমাবদ্ধতার প্রভাব লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশের এসএমই খাতে প্রজন্ম জেডের উদ্যোক্তাদের আগমন অর্থনীতিকে আরও বৈচিত্র্যময় ও উদ্ভাবনী করে তুলতে পারে। যদি তাদের যথাযথভাবে অর্থায়ন, পরামর্শ এবং অবকাঠামোগত সহায়তা দেওয়া হয়, তা হলে তারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

জেন জেড প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরিদের থেকে ভিন্ন মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকার নিয়ে গড়ে উঠেছে। সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্ববোধের প্রতি তাদের গভীর আগ্রহ তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নৈতিক ভোগের মতো বিষয়গুলো তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে তারা এমন ব্যবসা ও ব্র্যান্ডকে সমর্থন করে, যাদের মূল্যবোধ তাদের নিজস্ব মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়।

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার অনেক তরুণ-তরুণী মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে ভুগছে। এর ফলে তারা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। জেন জেড প্রজন্মের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ডিজিটাল দক্ষতা, সমালোচনামূলক চিন্তা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করা জরুরি। এই দক্ষতাগুলো অর্জন করলে বাংলাদেশের তরুণরা বৈশ্বিক কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে এবং দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। 

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তনে জেন জেড প্রজন্মের জনসংখ্যাগত বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তরুণ ও বর্ধনশীল এই জনগোষ্ঠী দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী এবং ভোক্তা বাজারের একটি বড় অংশ গঠন করে। যদি এই জনগোষ্ঠীর যোগ্যতা ও উদ্যোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়, তা হলে দেশ টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে। যদি আমরা জেন জেড প্রজন্মের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরতে চাই, তা হলে তাদের সামনে দাঁড়ানো বেকারত্ব, অধিকারহীনতা এবং সামাজিক বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। 

তাদের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন নিশ্চিত করা এবং সামাজিক সেবায় সহজ প্রবেশাধিকার দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শুধু তাই নয়, একটি সমৃদ্ধ এবং সবার জন্য সমান অধিকারসম্পন্ন একটি সমাজ গড়তে হলে এই তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও জরুরি।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ওপর জেন জেড প্রজন্মের রাজনৈতিক সচেতনতা ও সক্রিয়তার গভীর প্রভাব পড়তে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার এবং তথ্যের সহজলভ্যতা এই প্রজন্মকে রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে আগের চেয়ে বেশি সচেতন করে তুলেছে। ফলে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে এবং তাদের মতামত প্রকাশ করছে।

সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে জেন জেড প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের পরিবর্তন ও জবাবদিহির প্রতি গভীর আগ্রহের পরিচয় দেয়। এই প্রজন্ম যখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরও প্রভাবশালী হবে, তাদের স্বচ্ছতা, সুশাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও সুস্থ করে তুলবে এবং টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করবে।


বিশ্বায়নের প্রভাবে জেন জেড প্রজন্মের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত পৃথিবীতে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্ম বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ধারণা এবং বাজারের সঙ্গে পরিচিত। ফলে তারা বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা কার্যকলাপের সুযোগ খুঁজতে আগ্রহী।

তরুণ বাংলাদেশিরা তাদের নতুন চিন্তাধারা ও বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার করছে। তাদের এই উদ্যমী মনোভাব উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতাকে আরও জোরদার করছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। তবে এই একীকরণের পাশাপাশি নানা ধরনের চ্যালেঞ্জও সামনে আসছে। 

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির টেকসই বৃদ্ধির জন্য প্রজন্ম জেডের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ মহামারি স্পষ্ট করেছে যে জনস্বাস্থ্য একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি। তরুণদের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটি দক্ষ ও উৎপাদনশীল কর্মশক্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। মহামারি-পরবর্তী সময়ে শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও এই সমস্যাগুলোর সমাধান না করা হলে প্রজন্ম জেডের অর্থনৈতিক সাফল্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে জেন জেড প্রজন্মের অবদান অপরিহার্য হবে। তাদের শক্তিশালী ডিজিটাল দক্ষতা, উদ্যোক্তার মনোভাব এবং সামাজিক-পরিবেশগত দায়বদ্ধতার কারণে তারা বিভিন্ন খাতে নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। এই প্রজন্মের তরুণরা তাদের দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

পরিশেষে জেন জেড প্রজন্মের সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে তাদের সামনে দাঁড়ানো বেকারত্ব, বৈষম্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অসমতাসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা জরুরি। এই প্রজন্মের উন্নয়ন ও কল্যাণে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ তাদের তরুণ জনগোষ্ঠীর সৃজনশীলতা ও উদ্যমকে কাজে লাগিয়ে একটি টেকসই এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

হত্যা মামলার বিচার এবং সাম্প্রতিক প্রেক্ষিত

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৬ এএম
আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৩ এএম
হত্যা মামলার বিচার এবং সাম্প্রতিক প্রেক্ষিত
মাসুদ আহমেদ

সরকার পতনের পরপরই শুরু হয়েছে গণহত্যার জন্য দায়ী সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, পুলিশ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একাদিক্রমে হত্যার অপরাধে ফৌজদারি মামলা দায়ের। যদিও ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের গণহত্যা এখনো স্বীকৃত হয়নি। ঢাকা মহানগরসহ আরও ছয়টি স্থানে এ পর্যন্ত ৪১০টি মামলা হয়েছে। ডেপুটি কমিশনারের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। এসবে আসামি ও সাক্ষীর সংখ্যা মোট ৬০ হাজার। 

এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে প্রাথমিক চার্জশিট দিতে প্রয়োজন হবে তাদের নাম, বাবা ও মায়ের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, অপরাধের ধরন, সিআরপিসির প্রযোজ্য ধারা, সাক্ষীদের নাম ও ঠিকানা, সাক্ষ্য, আলামত ও অকুস্থলের বর্ণনা। এ ছাড়া লাগবে ভিডিও ক্লিপ, এফআইআর, নিহতের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন, লাশ শনাক্তকারীর স্বাক্ষর, ধ্বংসকৃত সরকারি সম্পত্তির চিত্র এবং বিমাকারীর প্রতিবেদন ইত্যাদি। 

একেকজন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এর একেকটি মামলায় শুধু এই বিষয়গুলো প্রথমে হাতে লিখে এবং পরে টাইপ করে চার্জশিটের ছকে পেশ করতে কমপক্ষে প্রায় দুই বছর সময় লাগবে। তার পর তার ওপরস্থ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সার্কেল এএসপি, অতিরিক্ত এসপি ও এসপির সঙ্গে এবং কখনো কখনো সিনিয়র কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এগুলো যাচাই-বাছাই শেষ করে আদালতে পাঠাতে আরও তিন মাস করে সময় লাগবে। এগুলো হচ্ছে সেই সব মামলাসংক্রান্ত, যেগুলোর চার্জশিট সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার অনুমোদন করে আদালতে পাঠাতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। 

আরেক শ্রেণির মামলা এর মধ্যেই পাওয়া যাবে, যেগুলোর চার্জশিট প্রণয়নে জেলা জজ আদালতে শুনানি সম্পন্ন করতে হবে। এই মামলাগুলো যেহেতু হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংসসংক্রান্ত এবং এগুলো দায়ের হচ্ছে ঝড়ের গতিতে, সেহেতু এগুলোর বিচার করার জন্য প্রবল জনচাপ এবং ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দলের প্রবল চাপ থাকবে দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে। বাংলাদেশে বিচারকের সংখ্যা ২ হাজার ১০০ জনের মতো। বিচারাধীন এবং অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। নতুন দায়েরকৃত মামলার দ্রুত বিচার দাবি করা মানেই পুরোনো মামলার বাদীদের প্রতি অন্যায় করা। 

কারণ এতে ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং আগে আসলে আগে পাবেন’- সাধারণ ন্যায়বিচারের ভিত্তির চরম লঙ্ঘন। দ্রুত বিচার মানেই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিচারকরা আগের মামলার শুনানি স্থগিত করে এই ৪১০টি মামলার বিরতিহীন শুনানি গ্রহণ ও বিচারকাজ সম্পন্ন করা; যেমন সাম্প্রতিকালে নোয়াখালীর মাদ্রাসা মামলায় নুসরাত হত্যাকাণ্ডে এবং চট্টগ্রামে ওসি প্রদীপের মামলায় আদালত একাদিক্রমে শুনানি ও বিচারকার্য সম্পন্ন করে রায় দিয়েছিলেন। 

ধরা গেল, সেই বেদম বিচারকাজ আরম্ভ হলো। তখন এই মামলাগুলো যাদের কলমের ভেতর দিয়ে আগাতে থাকবে, তাদের মানসিকতা এবং অবস্থানের ওপর বিচারের মান ও গতি নির্ভর করবে। যেমন প্রধান উপদেষ্টা প্রথমেই বলেছেন, ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে প্রাণহানি, সম্পদহানি এবং নৈরাজ্য হয়েছে তার জন্য আন্দোলনকারী ছাত্রদের দায়ী করা যায় না, দায়ী করা যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। বাস্তব হলো এই যে, আন্দোলনকারীদের হাতে ৪২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। সরকারি গাড়ি ও মেট্রোরেলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তাহলে এই দুটি বিষয়ে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কি মামলা বা শাস্তি হবে না? 

কারণ তারা তো নির্দোষ বলে সরকারপ্রধান উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কোনো ইনডেমনিটি জারি করা হয়নি। সরকারি সম্পত্তি না হয় রেহাই পেল, কারণ সেগুলো অপ্রাণীবাচক। কিন্তু ৪২ জন পুলিশের মারা যাওয়ার মামলা থেকে রেহাই দেবে কে? সন্তর্পণে পুলিশ বা নিহতদের স্বজন বাদী হয়ে মামলাগুলো করবেন, তা নিশ্চিত। তাতে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এদের সহকর্মীরা এবং সমর্থকরা পুলিশের নানা স্তরে কর্মরত। 

চার্জশিট প্রণয়ন এবং আদালতে অনুমদিত হওয়ার স্তর পর্যন্ত এরা চার্জশিটের উপজীব্যকে তাদের মনমতো না হলে কৌশলে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন। তেমনি রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি সহানুভূতিশীল গোয়েন্দা ও পুলিশ সদস্যরাও মামলার চার্জশিটের উপজীব্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন। প্রধান রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সমন্বয়করা সরকার পতনের প্রথম দিন থেকেই বলে আসছেন যে, জেলা, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারকদের অধিকাংশ আওয়ামী প্রেতাত্মায় ভরপুর। 

এই বিশ্বাসে প্রথম কয়েক দিন বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট স্তর পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং পদত্যাগ করানো হয়েছে। কিন্তু একজন জেলা জজ বা উচ্চতর আদালতের বিচারকের শূন্যস্থান কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ এই না যে, এই সার্ভিসে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এমনকি ৫০ জন বিচারক রিজার্ভ রাখা হয়। একজন বিচারক তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লাগে।

ফলে এই শূন্যস্থান পূরণ করে দ্রুত বিচার করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হবে। অন্যদিকে আবার আগের আমলের মতো শাসন বিভাগ যদি বিচারকদের মামলার রায়ের ব্যাপারে তাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, তা হলে সেই সংস্কৃতি আগের আমলের মতোই নিচু হবে। বিচার কোনো তড়িঘড়ির বিষয় নয়। জেলা জজ পর্যায়ে যে রায়ই হোক, পরবর্তী দুটি স্তরে আপিল নিষ্পত্তিতে কী রকম সময় লাগে, তা স্মরণ করতে তিনটি মামলার উদাহরণই যথেষ্ট। 

প্রথমত, শাজনীন খুনের মামলায় বিচার শেষ হতে ১৮ বছর; দ্বিতীয়ত, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় ১২ বছর; তৃতীয়ত, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার বিচার হতে ৮ বছর লেগেছিল। এই সর্বশেষ মামলাটি এখন ডেথ রেফারেন্স হিসেবে ৫ বছর ধরে উচ্চতর আদালতে বিবেচনাধীন আছে। অপরদিকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সংঘটিত খুনের মামলার বিচার ও রায় কার্যকর হতে ৩৫ বছর সময় লেগেছে। এর মধ্যে ৬ বছর সংক্ষুব্ধ পরিবারের সদস্যরা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও। আবার বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলায় বিচার আরম্ভ হওয়ার পর সাড়ে ১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রায় এখনো অনিশ্চিত। 

পুলিশের সাবেক আইজি মামুন পলাতক ও কমিশনার আসাদুজ্জামান গ্রেপ্তার। তারাসহ ওই বিভাগের যারা সাবেক সরকারের অবৈধ সুবিধা ভোগ করেছেন এবং তাদের আমলে অধস্তন পুলিশ কর্মচারী নিয়োগ করেছেন, তাদের প্রভাব এই বিশাল বাহিনীতে অনেকাংশেই অক্ষুণ্ন রয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ড হাইকোর্টের একটি স্থান থেকে অযৌক্তিকভাবে আগত এক নির্দেশে মামলাটির বিচারকাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়। 

তারা সমাজের খুব প্রভাবশালী লোক ছিলেন না। তার পরও ক্ষমতার রশিতে এভাবে প্রভাব বিস্তার করা এই সমাজেই সম্ভব। মামলাটি শেয হতে ৩৮ বছর লেগেছে। সাম্প্রতিক মামলাগুলোর বাদী, আসামি ও সাক্ষীর মধ্যে মৃত ব্যক্তি, শিশু, বিদেশে অবস্থানরত এবং একেবারেই অসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারণ তাড়াহুড়ো। আমরা আত্মরক্ষায় সমর্থ একটা জাতি। ফলে প্রসিকিউশনের দক্ষতা আমাদের সামান্য। সরকারি মামলায় বিবাদীর উকিল যতটা দক্ষতা দেখান, সরকারি উকিল ততটা দক্ষতা তো দেখানই না বরং অনেক সময় নীরব থাকেন। ফলে আসামি খালাস পেয়ে যান। 

এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও কোর্ট দারোগা, পেশকার, পিপি, জিপি এবং আদালতের অন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বৃহৎ অংশ অভিযোগ প্রমাণের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নেবেন বলে মনে হয় না। অভিযুক্তরা অত্যন্ত শক্তিশালী, বিখ্যাত, প্রভাবশালী এবং ব্যয়বহুল আইনজীবী নিয়োগ করবেন। তাদের সামনে অখ্যাত সরকারি উকিলরা দুর্বলতার পরিচয় দেবেন। কাঁচাভাবে মামলা দায়েরের ফলে তা বৃদ্ধি পাবে। মুন সিনেমার পাকিস্তানি মালিক বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ৩২ বছর মামলা লড়ে ওই সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পান। 

১৯৭২ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর দালালদের মামলায় বিবাদীদের সমর্থন করেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। এমনিতেও মৌলিকভাবে ব্রিটিশ আইন অপরাধীর পক্ষে থাকে। বাদীর উকিল অত্যন্ত মেধাবী, সৎ ও প্রভাবশালী না হলে অভিযোগ প্রমাণ করা প্রায় ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। এ দেশে নারী নির্যাতনসংক্রান্ত মামলার শতকরা ৯৫ ভাগ অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় অত্যন্ত সম্পদশালী এবং প্রভাবশালী এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলো খুব দক্ষতার সঙ্গে দায়ের এবং চার্জশিট প্রণয়ন না করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে বলে মনে হয় না। 

মামলাগুলোতে অনেকেই হুকুমের আসামি, অনেক সাক্ষী বিদেশ চলে গেছেন, অনেকেই মৃত ও আহত, অনেকে সময়ের পরিসরে এই বিষয়ে আর আগ্রহী থাকবেন না। অনেক ক্ষেত্রে বিচারকও রাজনৈতিক কারণে অভিযুক্তের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, কেউ কেউ আবার বোধ করবেন বিব্রত। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইনজীবীর পরামর্শ ছাড়া মামলাগুলো দায়ের করা বিচারপ্রার্থীর জন্য আশাপ্রদ হবে না। ব্রিটিশদের প্রণীত ফৌজদারি আইন অক্ষুণ্ন আছে। তা একান্ত নৈর্ব্যত্তিক। সেগুলোর অন্তর্নিহিত লক্ষ্যের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে মামলাগুলো দায়ের করা উত্তম হবে। 

লেখক: সাহিত্যিক 
[email protected]