নদী আমাদের প্রকৃতির এক অমোঘ দান, প্রাকৃতিক মূলধন। নদী সৃষ্টি করা যায় না। বরং নদী দেশ-জনপদের জন্য ভূমি ও ভূমিরূপ সৃষ্টি করে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার জলে পরিপুষ্ট হয়ে জন্মলাভ করা এক সবুজ-শ্যামল মায়াবতী ব-দ্বীপ। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, চীন, ভারত, নেপাল, মায়ানমার ও পাকিস্তান সমন্বয়ে হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চল গঠিত।
এই অঞ্চলটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ওয়াটার টাওয়ার’ হিসেবে স্বীকৃত এবং এশিয়ার বৃহত্তম ১০টি নদীর উৎস। বাংলাদেশ হিন্দুকুশের নিম্নধারাভুক্ত একটি দেশ। তাই পরিপূর্ণ নদী ব্যবস্থাপনা করতে হলে আন্তর্দেশীয় জলকূটনীতিতে আমাদের অগ্রগামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এর অভাবে অকালবন্যা, নদীভাঙনে জনপদ ধ্বংস, ফসল নাশ এবং মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি হুমকি আরও ঘনীভূত হচ্ছে এব্রং জাতীয় জীবনে আমরা এরই ফল উপভোগ করছি।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা’ পুস্তিকায় নদীর সংখ্যা ১০০৮টি বলে প্রকাশ করেছে। তাই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর গতিরোধ করতে গিয়ে সংকটে জড়িয়ে পড়ছি। কারণ নদী সুরক্ষার কোনো কৌশল আমাদের জানা নেই।
উল্লেখ্য, এই দেশের কোনো উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নদী ও জলাভূমি নিয়ে পাঠদানের গুরুত্বকে আমলে নেওয়া হয়নি। আমাদের শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, নীতিনির্ধারক মহল, রাজনীতিবিদ ও শাসক গোষ্ঠী নদী কিংবা জলাভূমিকে আমাদের জাতীয় সম্পদ ও জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেছেন।
কেবল সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লে কিছু সভা কিংবা প্রতিবাদ হয়, তাতে একে রক্ষার জন্য সবাই একমত পোষণ করে। বরং নদীকে সরকারিভাবে কখনো বদ্ধ জলাশয়, কখনো খাল ইত্যাদি বলে মাইলের পর মাইল নদীকে আইনি মোড়কে বেআইনিভাবে ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়া হয়েছে। নদী দখল করেছে সরকার, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিত্তশালী দুর্বৃত্ত এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সহস্রাধিক নদী কীভাবে এই প্রবাহ হারাল, দখল হয়ে গেল কিংবা দূষণ করা হলো, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।
ভূমিকম্প ও উজানের দেশগুলো কৃত্রিমভাবে পানির প্রবাহের হ্রাস টানা এবং সর্বোপরি নদী ব্যবস্থাপনায় আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ক্রমেই সংকটাপন্ন অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। নদী বিষয়ে আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের সমঝদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় এর সংকটগুলোকে সুবিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হয়নি।
পানির প্রবাহ, ওয়াটার শেডের প্রভাব, নদীভাঙনের বৈজ্ঞানিক কারণ ইত্যাদি বুঝে ও গবেষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি ও জীবনধারা গড়ে ওঠার পেছনে নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা কৃষির অবদান প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে এর পানিতে মৎস্য চাষ ও পলিসমৃদ্ধ অববাহিকায় কৃষি ফসল উৎপাদন বাংলাদেশে এক প্রাকৃতিক স্নিগ্ধ জীবনব্যবস্থা প্রদান করেছে।
বাংলাদেশের নদীপারের জেলাগুলোতে জন্ম নিয়েছেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক এবং বহু সৃজনশীল ক্ষণজন্মা মানুষ। তারা বাংলার শিল্প ও সাহিত্যে অনবদ্য অবদান রেখে অমর হয়েছেন।
আমাদের অনেকের ধারণা, নদীকে শাসন করলে এর উত্তম ও অর্থবহ ব্যবহার করা যায়। আর নাব্যর জন্য ড্রেজিং করলেই চলবে। কিন্তু পানির ভাষা বা হাইড্রোলজি, নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে চীন কীভাবে সফল হয়েছে- এসব কখনো তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি না।
তাই কোন স্থানে কতটুকু গভীরতায় ও কতটুকু প্রশস্ত করে নদীর পাড় ও তলদেশ কেটে ড্রেজিং করতে হবে, কোন কোন মাসে খনন চলবে, নদীর উত্তোলিত মাটি ও বালু কোন স্থানে কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে ইত্যাদি বিষয় অনুসরণ না করার জন্য চরম অব্যবস্থপনায় ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় পড়ে ড্রেজিং-উত্তর নদীগুলো।
সংগৃহীত ড্রেজিংয়ের বালু ও মাটি নদীর পাড়ে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে, যা বর্ষাকালে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। নাব্য হ্রাসের পাশাপাশি নদীর দখল ও দূষণ বাড়ছে। শহর ও শিল্পের নোংরা ও দূষিত পানি নালারূপী জলপ্রপাত তৈরি করে নগর ও শিল্পাঞ্চলে। বলতে দ্বিধা নেই, বিভিন্ন স্থানে তৈরি এসব নোংরা জলপ্রপাত স্থানীয় সরকারের এক মহাপ্রজ্ঞাপরাধের ফল। এতে নদীর বাস্তুপরিবেশ নষ্টের জন্য মাছ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাস হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
এ অবস্থায় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের প্রয়াস আমাদের মুক্তি দিতে পারে। এ ভাবনা থেকে কতিপয় বিষয়কে বিবেচনার কোনো বিকল্প দেখি না। প্রথমেই নদীপারের মিথ সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী এর অগ্রগতির লক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। নদী খনন করা হলে তা নিয়মিতভাবে পর্যালোচনার জন্য একটি মনিটরিং ছায়া টিম গঠন করা, যা নাব্য পরিমাপসহ নদীর চলমান অবস্থাকে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ মনিটরিংয়ে সহায়তা করবে।
নদীপারের সংবাদকর্মী ও মিডিয়াকে সম্পৃক্ত করে একটি মিডিয়া টিম গঠন করা যেতে পারে। যারা নিয়মিতভাবে প্রতিটি নদীর সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে নদীবিষয়ক পাঠ্যক্রম যুক্ত করাও ভবিষ্যৎ নাগরিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ববিদ্যালগুলোয় ‘নদীবিজ্ঞান’ নামে একটি নতুন বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চালু করা উচিত।
উল্লেখ্য, ভারতের কাবেরী নদী অধ্যয়নের জন্য কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে এক বছরমেয়াদি একটি কোর্স চালু করেছে। নদীবিষয়ক লেখক, গবেষক, পাঠদানকারী, বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে নদী রক্ষা কমিশন নিয়মিত বিরতিতে একটি জাতীয় কনফারেন্সের আয়োজন করতে পারে। নদীর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অগ্রগতির সঙ্গে তীরের মানুষের অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং নদীর বিজ্ঞোচিত ব্যবহার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা বিশেষ দরকারি।
মানুষের সাধারণ ও ঐতিহ্যগত সম্পদের সংমিশ্রণে নদীকেন্দ্রিক জীবনধারা উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে একটি গবেষণা সেল তৈরি করা এবং সর্বোপরি, সফল জলকূটনীতির সূচনা করা অত্যন্ত জরুরি। এই পদক্ষেপ আমাদের হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের সব নদীর সংরক্ষণ ও পরিবীক্ষণে ভূমিকা রাখবে।
আমাদের অনাদর, অবহেলা ও অনাচারে মাতৃরূপী নদীগুলো এখন বিপন্নপ্রায় মৃত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কখনোই এর দিকে সুদৃষ্টি দেয়নি। যদিও আদালত ২০১৬ সালে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
লেখক: পর্যটনবিষয়ক গবেষক